ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৩ বছর ” কথা রাখেননি প্রধানমন্ত্রী “

Spread the love

ilias ali1বাংলা সংলাপ রিপোর্ট
আজ ১৭ এপ্রিল । ইলিয়াস নিখোঁজের তিন বছর । খোঁজ মিলেনি বিএনপির এই নেতার । অপেক্ষা শেষ হয়নি সিলেটবাসীর। এখনও বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের প্রিয় নেতার
ফেরার অন্তহীন অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের বিশ্বাস ইলিয়াস আলী ফিরবেন। অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর জন্য লন্ডন ও সিলেটে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। তারা জানিয়েছেন, আন্দোলন ছাড়া ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার পর থেকে সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া তদন্ত কাজে সরকারি সংস্থাগুলোর রহস্যময় নীরবতাও জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তার স্ত্রী – সন্তানরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। ইলিয়াস আলীকে শিগগির খুঁজে বের করা হবে বলে এমন আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ইলিয়াস স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে প্রধানমন্ত্রী এও বলেছিলেন যে রাজনীতি থেকে মানবতা উর্ধে , তিনি একজন নারী ,তাই স্মামী হারার বেদনা তিনি বুঝেন । কিন্তু কথা রাখেননি প্রধানমন্ত্রী । নিখোঁজ হওয়ার পর ইলিয়াস আলীকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছিল সে খবরটি প্রধানমন্ত্রী জানতেন ! তাঁরই দলের মন্ত্রী আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যে এমনটা স্পস্ট ইংগিত ছিল । স্থানিয় সরকার মন্ত্রী আশরাফ নিখোঁজের ১ সপ্তাহের মধ্যে বলেছিলেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী পারেন ইলিয়াস আলীকে জীবীত উদ্ধার করতে । আর মন্ত্রীর এই বক্তব্যের আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই ইলিয়াস স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সন্ত্রানদের নিয়ে সাক্ষাত করেন । তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মানবিক আবেদন করেন । স্বামীকে খোঁজে বের করে ফেরত দেয়ার দাবী জানান । কিন্তু এখনও তার কোনো সন্ধান মেলেনি। ইলিয়াসপত্নীকে দেয়া কথা যেমন রাখেনি প্রধানমন্ত্রী তেমনি তাঁর কোন আইনশৃংখূলাবাহিনীও হদিস দিতে পারেনি ইলিয়াস আলীর।
11130284_886471611412607_538360998533715544_nসাইফুর জমানায় সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে ধুমকেতুর মতো আভির্ভাব হয় এম ইলিয়াস আলীর। বিশ্বনাথের রামধানের গ্রামের যুবক ঢাকায় ছাত্রদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে রাজকীয়ভাবেই অন্তর্ভুক্ত হন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর সিলেট বিভাগে বিএনপির রাজনীতির কর্তৃত্ব চলে এসেছিলো তার কাছে। এরপর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ইলিয়াস আলী সিলেটে বিএনপিকে চাঙ্গা করে তোলেন। বিরোধী দলে থেকেও তিনি রাজনীতির মাঠে দাপট খাটান একতরফা। এর বাইরেও সিলেটবাসীর অন্যতম দাবি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ, সীমান্তে ভূমি দখল ও মানুষ হত্যাসহ নানা ইস্যুতে সিলেটে লংমার্চ, রোডমার্চ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করেন ইলিয়াস আলী। আর এই কর্মসূচি পালনে ইলিয়াস পেয়েছিলেন সিলেটবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আকস্মিকভাবে নিখোঁজ হন সিলেট বিএনপির অন্যতম এই রাজনীতিবিদ। নিখোঁজের পর থেকে সিলেট সহ গোটা দেশে দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। তার সন্ধান দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ। সিলেটের বিশ্বনাথে বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান বিএনপির ৩ নেতাকর্মী। গোটা দেশে মারা যান ১১ জন। তখন সিলেট বিভাগে টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন চললেও ফিরে আসেননি ইলিয়াস আলী। তার খোঁজ দিতে পারেনি কেউই। ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে নিয়ে র‌্যাব অভিযান চালালেও তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিন বছরের তদন্তে প্রশাসন এখনও ইলিয়াসের সন্ধান দিতে পারেনি।
ইলিয়াস আলীর ছোটো ভাই লন্ডন প্রবাসী আসকির আলী জানিয়েছেন, ‘আমাদের দাবি একটাই, আমরা অক্ষত অবস্থায় ইলিয়াস আলীকে ফেরত চাই। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আমরা এখনও পথ চেয়ে আছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি সব কিছুর চেয়ে মানবতার ঊর্ধ্বে। আর এই মানবিকতার দিক বিবেচনা করে জনতার ইলিয়াসকে তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হবে।’ ইলিয়াস আলীর জন্য প্রতি সপ্তাহেই সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ইলিয়াস আলীর শুভাকাঙক্ষীরা আশায় বুক বেধে প্রার্থনায় ব্যস্ত রয়েছেন।
545281_369315719811026_1568555685_nইলিয়াস আলী সিলেটের মানুষের প্রিয় নেতা। সিলেটবাসী মনে করেন, ইলিয়াস আলীকে সরকারই গুম করে রেখেছে। এ কারণে ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন তারা। দেশে বিদেশে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ ।তারা জানিয়েছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে ইলিয়াস আলীকে সরকারের গুম নামক কারাগার থেকে মুক্ত করা হবে।
ইলিয়াস আলী বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন । তিনি সিলেটের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য নেতা। তার নেতৃত্ব সিলেটে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সিলেটের প্রাণ সুরমা-কুশিয়ারা নদীর উজানে ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে তিনি তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। এছাড়া অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তরের নামে বাংলাদেশের জমি ভারতের কাছে তুলে দেয়া, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জমি দখল, সিলেটের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন ইলিয়াস আলী।
বিএনপির এই নেতা অপহূত হওয়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ‘তদন্ত চলছে’। আর বিভিন্ন সভায় বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, ‘সবই লোক দেখানো’। এখন পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর খোঁজ মেলেনি। জানা যায়নি কারা তাঁকে কেন অপহরণ করল, তাঁর পরিণতিই বা কী হলো।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার আগে ২০১২ সালের ১ এপ্রিল সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমেদ ওরফে দিনার ও তাঁর বন্ধু ছাত্রদলকর্মী জুনেদ আহমেদ রাজধানীতে মামলাসংক্রান্ত কাজে এসে নিখোঁজ হন। তখন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত হয়েছি, র্যাব-১-এর সদস্যরা তাঁদের ধরেছে।’ এর পরে ১৭ এপ্রিল রাতে গাড়িচালকসহ ইলিয়াসও নিখোঁজ হন।
নিখোঁজ হওয়ার পরে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর বনানী থানায় একটি জিডি করেছেন। সেই জিডির তদন্ত চলছে এখনো। উচ্চ আদালত ৪৮ ঘণ্টা পরপর ইলিয়াস আলী নিখোঁজের বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশকে। একই প্রতিবেদন কয়েক দিন পরপর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দাখিল করছেন বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী মাইনুল ইসলাম। প্রতিবেদনগুলোতে ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা গাড়ির বিবরণ, ওই দিন সিলেট থেকে ফেরার পরে ইলিয়াসের কর্মকাণ্ডের বিবরণী, রূপসী বাংলা হোটেলে ইলিয়াস যাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তার বিবরণী, ইলিয়াসের বাসার বর্ণনা ইত্যাদিই ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। পুলিশের ২০তম ও ২৪তম প্রতিবেদন মিলিয়ে দেখা গেছে, দুই প্রতিবেদনের কিছু অনুচ্ছেদ কেবল ওলট-পালট করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তথ্যগত কোনো ফারাক নেই। ২০১২ সালের ৮ সেপেটম্বর ২০তম এবং পরের বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ২৪তম প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
10418418_858381094221659_5795755351588398703_nএখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। ২৪তম প্রতিবেদনের শেষ প্যারায় বলা হয়, ‘জিডি অনুসন্ধানকালে গৃহীত ব্যবস্থা, প্রাপ্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণপূর্বক ফলাফল আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের সাক্ষ্য বহন করে। জিডির ফলাফল বাদীকে অবহিত করলেও সে বা তার পরিবারের পক্ষ হতে কোনো প্রকার মামলা দায়েরের বিষয়ে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। বিধায় জিডির আলোকে ব্যাপক অনুসন্ধানকার্য অব্যাহত আছে।’
যেভাবে গুম হলেন ইলিয়াস আলী :
১৭ এপ্রিল ২০১২ মধ্যরাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গুম হন বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী। ওই সময়ে গুম হওয়ার ওই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানকার অনেকেই। দৈনিক আমার দেশ-এ প্রত্যক্ষদর্শী এক ডাব বিক্রেতার বিবরণ ছাপা হয়েছে। সহযোগী দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং দৈনিক সমকাল-এ আরও দুই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ছাপা হয়েছে। এদের একজন ডিউটিরত পুলিশের এসআই ও একজন ডাব বিক্রেতার ছেলে সোহেল রানা। এরই মধ্যে বনানী থানার তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের জবানবন্দি নিয়েছেন। সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা আমাদের পাঠকদের জানার জন্য দেয়া হলো :
ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয় পুলিশ কর্মকর্তাকে : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণ ও গুম ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তা ধস্তাধস্তির সময় ঘটনাস্থলে হাজির হন। তিনি ছিনতাইকারী ভেবে অপহরণকারীদেরই (!) একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন এবং কৌশলগতভাবে হুমকিও দেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলে ওঠেন, ‘কেউ নড়বে না, গুলি করে দেব কিন্তু।’ এ সময় ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত একজন মাইক্রোবাসের সাইডে এগিয়ে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজেদের একটি বিশেষ বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। বাধার সৃষ্টি করবেন না, সরে দাঁড়ান। এ সময় মাইক্রোবাসের ভেতরে ওই বাহিনীর কিছু নমুনা প্রমাণ হিসেবে দেখতে পেয়ে কথিত অভিযান পরিচালনাকারীর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে তিনি দুই পা পিছিয়ে যান। কিন্তু মাইক্রোবাসের লোকটি আবার পেছন দিকে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আবার ধমক দিয়ে বলেন, ‘সরে যেতে বললাম না, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।’
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাটি আর এক মুহূর্তও ঘটনাস্থলে অবস্থান করা নিরাপদ ভাবেননি। তাই তিনি জোর কদমে হেঁটে গলি রাস্তাটির দক্ষিণ পাশের জলখাবার হোটেলের সামনে চলে যান। সেখানে ওই পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলটি রাখা ছিল। সেখান থেকে তিনি গুলশান জোনেই তার কর্মস্থল থানায় পৌঁছে তার অফিসার ইনচার্জ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে পুরো বিষয়টির বর্ণনাও দিয়েছেন। কিন্তু অফিসার ইনচার্জ বিভিন্ন স্থানে টেলিফোনে আলাপ করে ওই সাব-ইন্সপেক্টরকে এ বিষয়ে আর মুখ খুলতে নিষেধ করে দেন। পাশাপাশি তাকে সাবধানে চলাফেরারও পরামর্শ দেন। এ ঘটনার পর রাতেই পুলিশ কর্মকর্তাটি ঘটনাস্থলে ইলিয়াস আলীকেই অপহরণ করা হয়েছে বলে জানতে পারেন। তিনি ঘটনাস্থলেও যান। এর পর থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাটি চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
13157_733274573429039_7039972895832353574_nতার ঘনিষ্ঠ একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘ইলিয়াস আলীর অপহরণ ও গুমের ঘটনায় কোনো রকম তথ্যসূত্র-প্রমাণাদি রাখতে চাননি অপহরণকারীরা। এ কারণে তার গাড়িচালককেও জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এভিডেন্স (সাক্ষ্য-প্রমাণ) হিসেবে ছিলেন শুধু ওই পুলিশ কর্মকর্তাটি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সম্পৃক্ত থাকা প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘অপহরণকারীরা’ অবিশ্বাস করেননি মোটেও। সহকর্মী ওই পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা, পরে ইলিয়াস আলীর অপহরণের বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলার পরই দ্বিতীয় এভিডেন্স হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তাটি নিজের জীবন নিয়েও চরম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাটি যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান তার সত্যতা পাওয়া গেছে মহাখালী মোড়ের পেট্রল পাম্পসংলগ্ন জলখাবার হোটেল থেকে। ওই হোটেলের একজন কর্মী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ওই রাতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাটি সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলে মহাখালীর অদূরে ডিউটি দিচ্ছিলেন। থানায় ফেরার আগে তিনি রাস্তায় মোটরসাইকেলটি থামিয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসেন। হঠাত্ উল্টো দিকের গলি থেকে দুই পথচারী এসে জানায়, রাস্তার মধ্যে ছিনতাই আর মারামারি হচ্ছে। এটুকু শুনেই ওই সাব-ইন্সপেক্টর গলির দিকে ছুটে যান। তার পেছনে আরও দু-একজন এগিয়ে গেলেও তারা অজ্ঞাত আশঙ্কায় নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শী এসআই মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারের মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছেই কথিত অপহরণকারীদের একজনের শার্টের কলার চেপে ধরেন। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাটি তার অফিসার ইনচার্জের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় আরও জানান, তাকে যখন ধমক দিয়ে সরানো হচ্ছিল তখনও ৪-৫ জন মিলে একজনকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিচ্ছিলেন। গাড়ির ভেতর থেকেও ধস্তাধস্তি ও ধমকাধমকির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় পাশের একটি ভবনের আড়াল থেকে একজন মোবাইল ফোনে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন। সেখানে মোবাইল স্ক্রিনের আলো তিনি এবং অপহরণকারীদেরও একজন খেয়াল করছিলেন। তবে মোবাইলে ভিডিও ধারণকারী যুবকটিকে পরদিন থেকে আর পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী একমাত্র সাব-ইন্সপেক্টর কর্মরত থানার অফিসার ইনচার্জকে আরও বলেন, ইলিয়াস আলীর গাড়ির পেছন দিকে কালো রঙের মাইক্রোটি ধাক্কা মারায় চালক ক্ষিপ্ত হয়ে নেমে যান এবং মাইক্রো চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় মাইক্রো থেকে আরও ৪-৫ জন নেমে গিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ির চালককে জোর করে ধরে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে বেঁধে ফেলেন। পরক্ষণেই ৩-৪ জন নেমে গিয়ে প্রাইভেটকারে বসে থাকা ইলিয়াস আলীকেও ধরে গাড়িতে তোলার সময় ধস্তাধস্তির সৃষ্টি হয়।
11081083_874386679287767_5017385210077380551_nউদ্ধার হলো না ১১ দিনেও : একে একে ১১ দিন কেটে গেল, তবুও ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করতে পারল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী। গত তিন দিন তাকে উদ্ধারের জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা অভিযান চালালেও সেই অভিযান ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।জোর করে গাড়িতে তোলার সময় ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিত্কার দিচ্ছিলেন : ‘বনানীতে পার্কের বেঞ্চে ঘুমাচ্ছিলাম। তখনও গভীর ঘুম ধরেনি। হঠাত্ চিত্কার-চেঁচামেচির শব্দ পাই। এতে পাতলা ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। পার্কের বেঞ্চে বসেই দেখতে পাই, একটি লোককে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে চার ব্যক্তি। গাড়িতে উঠতে না চাওয়ায় ওই ব্যক্তিকে কিলঘুষি মারা হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় ধস্তাধস্তির পর জোর করে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় ওই ব্যক্তি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিত্কার করছিল। পরদিন সকালে জানতে পারি, বনানীর পার্কের পাশের সড়ক থেকে যে ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তিনি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। গাড়িতে উঠিয়ে বনানী এক নম্বরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।’
১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত সোয়া ১২টায় বনানীর ২ নম্বর সড়কের পাশের সড়ক থেকে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. আনসারকে তুলে নেয়া হয়। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ডাব বিক্রেতা সোহেল রানা। বাসায় ফিরতে দেরি হলে প্রায়ই বনানীর পার্কে ঘুমান সোহেল। ওই পার্কের পাশেই তার বাবা ডাব বিক্রি করেন। সোহেল ডাব বিক্রেতা বাবাকে সাহায্য করেন। ইলিয়াসকে তুলে নেয়ার পুরো ঘটনটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন সোহেল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সোহেলকে তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। গতকাল বনানী থানায় সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোহেলের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলেন। সোহেলের কথায় উঠে আসে সেই রাতের চিত্র। সোহেলের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড কাছে রয়েছে। এ নিয়ে ইলিয়াস গুমের ঘটনায় অন্তত ৩ প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাদের সবার বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে।
সোহেল রানা জানান, হঠাত্ দেখলাম পার্কসংলগ্ন সড়কে একটি সাদা রঙের গাড়িকে আটকে দেয়া হয়েছে। ওই গাড়িটির সামনে-পেছনে আরও দুটি গাড়ি। গাড়িতে উঠতে না চাওয়ায় কয়েকজন লোক একজনকে লক্ষ্য করে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করছিল আর বলছিল, ‘গাড়িতে ওঠ। তোকে গাড়িতে উঠতেই হবে।’
যারা গাড়িতে তুলছিল তাদের পরনে কী ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানা জানান, যারা টানাহেঁচড়া করে গাড়িতে তুলছিল তাদের পরনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পোশাক ছিল না। তাদের পরনে উজ্জ্বল রঙের কাপড় ছিল। পরনের কাপড় ঝিকমিক করছিল।
সব সময় কি পার্কে রাত কাটান—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানা জানান, আমার সঙ্গে ওই রাতে একজন পার্কে ঘুমিয়ে ছিল। ওই ব্যক্তিকে আমি চিনি না। সে আমাকে এসে বলে, গ্রাম থেকে এসেছি, থাকার কোনো জায়গা নেই। ঘটনাস্থলে কোনো ব্যক্তিকে কারও শার্টের কলার চেপে ধরতে আমি দেখেনি। ওই সময় অন্য কাউকে ঘটনাস্থলে জড়ো হতেও দেখিনি। গভীর ঘুমে থাকায় আমার পাশের লোকটি ঘটনাটি টের পায়নি।যারা ধরে নিয়ে গেছে, তারা দেখতে কেমন—এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল বলেন, ‘তারা লম্বা ছিলেন। কেউ মোটাসোটা আবার কেউ হ্যাংলা-পাতলা।’ আপনি পার্কে ঘুমান কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল জানান, রাত ১২টার দিকে বাসার গেট বন্ধ হয়ে যায়। যেদিন কাজ করতে বেশি রাত হয়ে যায়, সেই দিন পার্কে রাত কাটাই। রাজধানীর একটি বস্তিতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন বলে জানান সোহেল।
নূরানী টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুত্ফরের বক্তব্য : এ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বনানীর ২ নম্বর সড়কসংলগ্ন নির্মাণাধীন ভবন নূরানী টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুত্ফর রহমান। ইলিয়াস গুমের পর লুত্ফরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। লুত্ফর জানিয়েছেন, ওই রাতে একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির ধাক্কা লাগার শব্দ তিনি শুনেছেন। এরপর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের আওয়াজ পান। তবে ঘটনাটি নির্মাণাধীন ভবনের টিনের বেড়ার ওপাশে হওয়ায় পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। লুত্ফরের কথা জানতে চাইলে নূরানী টাওয়ারের আরেক নিরাপত্তাকর্মী মাসুদ রানা বলেন, চার দিন ধরে লুত্ফরের খোঁজ নেই। এ ঘটনার পর সে অনেক ভয় পেয়ে যায়। সম্ভবত গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। তবে আমাদের কাউকে কিছু বলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লুত্ফরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
10931028_618334884939872_6174491331798879108_nবনানীর ২ নম্বর সড়কের যে এলাকা থেকে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন, ওই সড়কের একপাশে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অন্যপাশে নির্মাণাধীন ভবন নূর টাওয়ার। নূর টাওয়ারের সামনেই একটি পার্ক। ওই স্থান থেকে ইলিয়াস আলীর বাসা ৩০০ গজ দূরেই। গুম হওয়ার স্থান ছাড়া বনানীর দুই নম্বর সড়কের দু’পাশেই রয়েছে বাড়ি। ইলিয়াসকে ‘তুলে’ নিতে বনানীর দুই নম্বর সড়কের সবচেয়ে নির্জন এলাকাটি বেছে নেয়া হয়।
একটি সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে ‘তুলে’ নেয়ার সময় পুলিশের একজন এসআই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ছিনতাইকারী ভেবে প্রথমে ওই কর্মকর্তা একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন। কৌশলগত কারণে পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে ঘটনাটি তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে অবগত করেন। তবে ইলিয়াসকে ‘তুলে’ নেয়ার সময় পুলিশের কোনো সদস্যের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, ইলিয়াসকে উদ্ধারে র্যাব সর্বোচ্চ তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি চৌধুরী লুত্ফুল কবীর বলেন, তদন্ত করার একটি পর্যায়ে আমরা সোহেলের খোঁজ পাই। এরপর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বনানী থানার ওসি (তদন্ত) মাইনুল ইসলাম বলেন, ইলিয়াসের সন্ধানে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় যা উঠে এসেছে : প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় একটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো, ধস্তাধস্তি করেই গাড়িতে ইলিয়াসকে তুলে নেয়া হয়েছিল। ঘটনার পরপরই একজন প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছিলেন, একটি প্রাইভেটকার ইলিয়াসের গাড়িকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। সোহেল রানা জানান, ঘটনাস্থলে গাড়ি ছিল তিনটি। প্রত্যক্ষদর্শীদের সবার বক্তব্যে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো—ঘটনাস্থলে ইলিয়াসের সঙ্গে অপহরণকারীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল।


Spread the love

Leave a Reply