তিনটি দাবি পূরণ না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না এনসিপি
জুলাই সনদে সই করা না করার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের দিনে আজ দলটি সংবাদ সম্মেলন করে এর আইনিভিত্তি দেওয়াসহ তিন দফা দাবি তুলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আইনিভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা ‘মূল্যহীন হবে’।
সংস্কার প্রক্রিয়া ও জুলাই সনদসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অবস্থান জানাতে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপি।
সংবাদ সম্মেলনে তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য যে তিনটি দাবি জানিয়েছে, এসব দাবির মধ্যে রয়েছে––
এক, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগেই প্রকাশ করতে হবে।জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া “জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়” অনুসারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। জুলাই সনদের বৈধতার উৎস হতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
দুই, জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কারের বিষয়ে গণভোট হবে। এতে নোট অব ডিসেন্টের আলাদা কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে তা আগেই চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখাতে হবে।
তিন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদের পক্ষে রায় দেয়, তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এর কোনো কার্যকরিতা থাকবে না; গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে এবং সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’।
এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না করে জুলাই সনদ সই করা হলে তা জনগণের সঙ্গে ‘ছলচাতুরি’ করা হবে বলে মনে করে এনসিপি।
এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জুলাই সনদের আইনিভিত্তি ছাড়া অর্ডারে স্বাক্ষর করা মূল্যহীন হবে। সেই বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা অনুষ্ঠানে অংশীদার হবো না।”
এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি থাকবে– এটা দাবি করার পরও তা হয়নি উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, “ঘোষণাপত্রের টেক্সট নিয়ে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। সেই টেক্সটটা আমাদের দেখানো হয়নি। আগে যে অংশ দেখানো হয়েছে, ঘোষণাপত্র পাঠের সময় সেটা পরিবর্তন হয়েছিল। সেটা অনেক কম্প্রমাইজড একটা ডকুমেন্ট হয়েছে, বলা হয়েছে সংসদে সেটা ঠিক হবে।”
আরেকটা এরকম ঘটনার সাক্ষী হতে চান না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তবে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বলে এখনো আশা করছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শুক্রবার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠিত হওয়ার আগে থেকেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বলে দাবি করেন নাহিদ ইসলাম।
“গণঅভ্যুত্থানে আমাদের দাবি ছিল যে ফ্যাসিবাদের বিলোপ এবং একটি নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ রেজিম চেঞ্জের জন্যই বা সরকার পরিবর্তনের জন্যই হয়নি। বরং একটি ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে জনগণ রাজপথে নেমেছিল। সেই সূত্র ধরেই কিন্তু আমরা নতুন বাংলাদেশের কথা ও সংস্কারের কথা বলেছি।সংস্কারের দাবিটা এসেছে সেই জায়গা থেকে,” বলেন মি. নাহিদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি সব সময় সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা যখন আসলো, আমরা বলেছিলাম এটা একটা আইনি ভিত্তি দিতে হবে। শুধু কয়েকটি রাজনৈতিক দল বসে আলোচনা করে কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে আসি সেটাই যথেষ্ট না যে রাজনৈতিক দলগুলো পরে ক্ষমতায় গেলে বিষয়গুলোকে বাস্তবায়ন করবে। আমরা অতীতেও দেখেছি এই ঘটনাগুলো ঘটেনি।”
আগামীকাল যে অনুষ্ঠানটা হতে যাচ্ছে সেখানে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের ঘটনা ঘটবে; ফলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বা যে অর্ডার জারির করা বলা হচ্ছে, সেটা জারি হওয়ার আগে স্বাক্ষর “কেবল সেরেমনিয়াল, সেটা আনুষ্ঠানিকতা”––বলে মনে করেন এনসিপি নেতা নাহিদ।
এ রকম “আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই” বলে মনে করছে দলটি।
তিনি বলেন, “জুলাই সনদ এরই মধ্যে হয়ে গেছে, সব দল একমত হয়েছে যে আমরা কী কী চাই। কিছু কিছু দলের কিছু কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে। তবে পুরো প্রক্রিয়ার মূল হচ্ছে অর্ডার, যে আদেশের ভিত্তিতে গণভোট হবে এবং প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যাবে।”
“স্বাক্ষরের আগেই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় দলগুলোর ঐক্যমত হতে হবে। এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টা বিবেচনা করবো। আদেশের টেক্সটের খসড়া আমরা আগে দেখতে চাই। প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিতে সরকার গঠন করেছেন, সেই জায়গা থেকে, সেটা প্রেসিডেন্ট নয় বরং সরকার প্রধান হিসেবে তিনি সেটি জারি করবেন,” দাবি করেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আট মাসের সংলাপের পর রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার তথ্য জানায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার রাতে তা পাঠানো হয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে।
আগামী শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর এই সনদে স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে শেষ মুহূর্তে সনদ স্বাক্ষরে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি পাঠিয়েছে, তাতে দেখা গেছে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অনেক বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। জুলাই জাতীয় সনদে সেগুলো যুক্ত করা হয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সহ।
তবে, এই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই বিষয়ে আলাদা করে কোনো সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়নি জুলাই সনদে।
যদিও জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়েই বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
বুধবার রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জুলাই সনদ নিয়ে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যাতে অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও। তিনি এসময় আশা প্রকাশ করেন, শুক্রবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল উৎসবমুখর পরিবেশে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করবে।
“জুলাই সনদ স্বাক্ষরে সবাই বড় রকমের উৎসাহ নিয়ে অংশ নেবে। যে কলম দিয়ে স্বাক্ষর করবেন সেটা জাদুঘরে রক্ষিত থাকবে আপনাদের ছবিসহ। এটা জাতির জন্য মস্ত বড় সম্পদ হয়ে রইলো। যে দলিল তৈরি করেছেন তা হারিয়ে যাবে না। এগুলো প্রত্যেকের কাছে যেন যায়,” বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন তিনি।
এদিকে, এনসিপি তাদের অবস্থান জানানোর পরও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা করছেন, দলটি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে।
“এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান আমরা বুঝি। সংস্কার কার্যক্রম এতদূর এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এনসিপির অবদান রয়েছে। তারা তাদের সেই সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত রাখবে বলে আমি আশা করি,” বলেন আলী রীয়াজ।