দিল্লিতে দাঙ্গাঃ মসজিদে আগুন, মুসলিম বেছে বেছে তাদের ওপর হামলা হচ্ছে

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সহিংসতার তৃতীয় রাতেও বেশীরভাগ ঘটনায় মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার খবর পাওয়া গেছে।

ভারতের রাজধানীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরুর পর থেকেই নানা স্পর্শকাতর ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ছে টুইটার সহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে।

কিছু টিভিতেও সেসব ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে।

দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হচ্ছে অনেক ফুটেজই ভুয়া। মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে টিভি চ্যানেলগুলোকে স্পর্শকাতর ফুটেজের ব্যবহার নিয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

তবে মসজিদে আগুন দিয়ে সেটির মিনারে গেরুয়া রংয়ের পতাকা উড়িয়ে দেওয়ার যে ভিডিও ফুটেজটিকে দিল্লি পুলিশ ‘ভুয়া’ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে যাচাই করে তার সত্যতা নিশ্চিত করেছে অল্ট নিউজ নামে অনলাইন-ভিত্তিক একটি নিউজ সাইট।

সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর, ছবি এবং ফুটেজের যথার্থতা যাচাই করা অল্ট নিউজের অন্যতম প্রধান একটি কাজ।

মসজিদে হামলার যে ফুটেজেটি মঙ্গলবার তার টুইটার পেজে শেয়ার করেন সাংবাদিক রানা আইয়ুব, তাতে দেখা যায় – ‘জয় শ্রীরাম’ এবং ‘হিন্দুস্তান হিন্দুদের’ স্লোগান দিয়ে একদল লোক একটি মসজিদে ভাঙচুর করে কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতীক একটি গেরুয়া পতাকা মসজিদটির মিনারে উড়িয়ে দিচ্ছে।

শেয়ার করার পরপরই চরম সমালোচনা এবং ট্রলের মুখে পড়ে যান সাংবাদিক রানা আইয়ুব।

অনেকে লিখতে থাকেন – ফুটেজটি ভুয়া এবং মুসলিম এই সাংবাদিক সাম্প্রদায়িক এবং তিনি দাঙ্গা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। অনেকে টুইট করেন যে ভিডিওটি দু বছর আগে বিহারের সমস্তিপুর এলাকার একটি ঘটনার ফুটেজ।

রমেশ সোলংকি নামে একজন টুইটারে লেখেন তিনি রানা আইয়ুবের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন।

কিন্তু অল্ট নিউজের অনুসন্ধানে এখন দেখা যাচ্ছে মঙ্গলবার দিল্লির অশোক নগর এলাকায় মসজিদে হামলা, আগুন দেওয়া এবং গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর ঘটনা ঘটেছে।

অল্ট নিউজ ‘দি ওয়্যার’ নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের দুজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছেন যারা ঐ হামলার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তাদের একজন ঐ হামলার ভিডিও তুলেছেন।

ফুটেজের ইলেকট্রনিক ডেটা থেকে দেখা গেছে, এটি তোলা হয়েছে ২৫শে ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টা ৫৭ মিনিটে।

ওয়্যারের তোলা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে মসজিদের আগুন নেভানোর জন্য দমকল বাহিনী হোস ব্যবহার করছে। মসজিদ ভবনটি থেকে ধোঁয়া উঠছে এবং মসজিদের সেই মিনারটি দেখা যাচ্ছে যেটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজেও দেখা গেছে।

সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ কেউ অবশ্য বলছিলেন ঘটনা ঘটেছে অশোক বিহার নাম এলাকায়।

অল্ট নিউজ বলছে – অশোক বিহারে নয় অশোক নগর এলাকার ‘বড় মসজিদে’ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

নিশ্চিত হওয়ার পরপরই সাংবাদিক রানা আইয়ুব আবারও মসজিদে হামলার ।ফুটেজটি শেয়ার করেছেন।

শোক নগর এলাকার 'বড় মসজিদে' আগুন দিয়ে 'হিন্দু পাতাকা' উড়িয়ে দেওয়া হয়।
শোক নগর এলাকার ‘বড় মসজিদে’ আগুন দিয়ে ‘হিন্দু পাতাকা’ উড়িয়ে দেওয়া হয়।

‘আর আজাদি চাইবি’

সোশ্যাল মিডিয়াতে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কিত আরেকটি ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে।

ফুটেজে দেখা যাচ্ছে – পাঁচজন আহত তরুণ-যুবক মাটিতে পড়ে আছেন এবং কয়েকজন পুলিশ তাদের ঘিরে ধরে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। এরই মধ্যে তাদেরকে দিয়ে জোর করে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হচ্ছে।

পাশাপাশি, একজন পুলিশকে চিৎকার করে বলতে শোনা যাচ্ছে – ‘আর আজাদি চাইবি।”

কয়েকজন যুবককে বেধড়ক পিটিয়ে জোর করে জাতীয় সঙ্গিত গাইয়েছে পুলিশ
কয়েকজন যুবককে বেধড়ক পিটিয়ে জোর করে জাতীয় সঙ্গিত গাইয়েছে পুলিশ

শাহিনবাগ অফিসিয়াল নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টে এই ফুটেজটি পোস্ট করে লেখা হয় – ‘যখন রক্ষক ভক্ষক হয়, তখন আমরা কোথায় যাবো?’

এই ভিডিওটিরও সত্যতা যাচাই করেছে অল্ট নিউজ।

অল্ট নিউজ একই ঘটনার অন্য একটি ভিডিও ফুটেজ জোগাড় করতে সমর্থ হয়।

সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজটির সাথে তাদের জোগাড় করা ফুটেজটির মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছে তারা।

দুটো ফুটেজের স্ত্রিনশটে একই চিত্র দেখা গেছে, যেমন- ১. পড়ে থাকা একজন তরুণের মাথা আরেকজনের ওপর ২. অন্য দুজনের গায়ে কালো রংয়ের টি-শার্ট।

নির্যাতনের শিকার ঐ যুবকদের একজনের সাথে অল্ট নিউজ কথা বলতেও সমর্থ হয়েছে।

তিনি তার বক্তব্য ভিডিও করে সেটি অল্ট নিউজকে পাঠিয়েছেন যেটিতে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে – ” পুলিশ ৫-৬জনকে বেধড়ক পিটিয়েছে। একজনের হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। আরেকজনের পা ভেঙ্গে দিয়েছে। আমার হাত ও পা দুটোই ভেঙ্গেছে। আমার মাথায় আট থেকে দশটি সেলাই দিতে হয়েছে। পুলিশগুলো আমাদের বলছিলো – আর আজাদি চাইবি?”

অল্ট নিউজ বলছে ২৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার দিল্লির জাফরাবাদ এলাকার কাছে পুলিশি নির্যাতনের এই ভিডিও ফুটেজটি যথার্থ।

ঘটনা ঘটেছে কারাদামপুরি এলাকার কৃষ্ণ মার্গ বাস স্টপের কাছে বিকেল পৌনে ছয়টার দিকে।

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সহিংসতার তৃতীয় রাতেও বেশীরভাগ ঘটনায় মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার খবর পাওয়া গেছে।

রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

গত এক দশকের মধ্যে চলমান ঘটনাবলীকে ভারতে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

দেশটির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের পক্ষ ও বিপক্ষ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিলো রোববার, যা পরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয় বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন।

ছবি এবং ভিডিওতে সয়লাব হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এসব ছবিতে দেখা গেছে, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লাঠি-রড নিয়ে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সংঘর্ষকারীরা।

বিবিসি নিউজ অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু – এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন।

এছাড়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও অন্তত ১৯০ জন। বিবিসি সংবাদদাতারা বলছেন, আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধসহ সব ধরণের হামলার শিকার ব্যক্তিরাই আছেন।

দিল্লি থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ জানাচ্ছেন, মঙ্গলবারও পরস্পরের প্রতি পাথর নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক ভাংচুরের ঘটনা ঘটে দিল্লির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে।

তবে মঙ্গলবার রাতে পুলিশ জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশন ও মৌজপুর চক থেকে বিক্ষোভকারীদের জোরপূর্বক সরিয়ে দিয়েছে।

নাগরিকত্ব আইনের পক্ষ-বিপক্ষের মানুষেরা এখানে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো।

অন্তত দুটি মসজিদে হামলা হয়েছে
অন্তত দুটি মসজিদে হামলা হয়েছে

বুধবার সকাল নাগাদ পুরো এলাকায় পুলিশ ও প্যারামিলিটারি সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে।

গভীর রাতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সহিংসতা হয়েছে এমন কিছু এলাকা ঘুরে দেখেছেন এবং শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন।

তিনি সিলমপুর, জাফরাবাদ, মৌজপুর এবং গোকুলপুরি চক এলাকা পরিদর্শন করেন।

দিল্লিতে ব্যাপক সহিংসতার প্রেক্ষিতে আজ বৈঠকে বসতে যাচ্ছে নিরাপত্তা বিষয়ক কেবিনেট কমিটি।

মিস্টার দোভাল এই কমিটির সামনে পরিস্থিতির বিস্তারিত তুলে ধরবেন।

শুভজ্যোতি ঘোষ আরও জানাচ্ছেন যে স্কুল বন্ধ আছে এবং বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

ওদিকে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার শিক্ষার্থীরা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বাড়ির সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছে মঙ্গলবার রাতেই।

তবে পুলিশ জলকামান দিয়ে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

তিন দিন ধরে চলছে সংঘর্ষ সহিংসতা
তিন দিন ধরে চলছে সংঘর্ষ সহিংসতা

আবার রাতেই এক নজিরবিহীন আদেশে হাইকোর্ট তিনদিন ধরে চলা সহিংসতায় আহতদের নিরাপদে হাসপাতালে নেয়া ও জরুরি চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসনকে।

বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তারদের পিটিশনের শুনানি হয়েছে রাতেই, বিচারপতি এস মুরলীধরের বাসায় দুজন বিচারপতির বেঞ্চে।

ওদিকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পুলিশ ও অন্য কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন।Image Copyright @rkarnad@RKARNAD

এ বৈঠকে মঙ্গলবারই স্পেশাল পুলিশ কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এসএন শ্রীবাস্তবও যোগ দিয়েছেন।

তবে সহিংসতার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এখন তীব্র সমালোচনাও হচ্ছে বলে জানান শুভজ্যোতি ঘোষ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বিবিসি সংবাদদাতারা বলছেন যে সংঘর্ষকারীদের কারও কারও হাতে বন্দুক দেখা গেছে।

সহিংসতা হয়েছে মূলত উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে।

এসব এলাকার সড়কগুলো এখন অনেকটা ধ্বংসস্তূপের মতো রূপ নিয়েছে, রাস্তায় পুড়ছে যানবাহন, উড়ছে ধোঁয়া – বলছিলেন বিবিসি হিন্দির সংবাদদাতা ফয়সাল মোহাম্মদ আলী।

হামলার মুখে অনেকেই বাড়িঘর ছাড়ছেন
হামলার মুখে অনেকেই বাড়িঘর ছাড়ছেন

তিনি আংশিক পুড়ে যাওয়া মসজিদ দেখেছেন, যেখানে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুরআনের পাতা।

আরেকটি মসজিদেও হামলা হয়েছে মঙ্গলবার বিকেলে। ব্যাপক প্রচার হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে একদল লোক মসজিদের মিনারে উঠছেন।

সংঘর্ষ হওয়া এলাকাগুলো দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমান্তের কাছে। এখানে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

সাংবাদিকসহ অনেকেই টুইট করেছেন এই বলে যে হামলাকারীরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। একজন ফটো সাংবাদিক বলেছেন, তাকে তার প্যান্ট খুলে ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল।

তবে দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র এমএস রাধোয়া মঙ্গলবারই বলেছেন যে পরিস্থিতি এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।

তিনি জানান, পর্যাপ্ত পুলিশ ও প্যারামিলিটারি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।


Spread the love

Leave a Reply