ভয়ানক ভাইরাসজনিত রোগ কেন আফ্রিকাতে হয়?
এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন: আফ্রিকা মহাদেশে ভয়ানক ভাইরাস এবং সংক্রামক রোগের প্রকোপের ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। ইবোলা, মারবার্গ, জিকা, ডেঙ্গু, এবং চিকুনগুনিয়া-সহ বহু ভাইরাস আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমণের ভয়াবহতা তৈরি করেছে। কিন্তু কেন এসব ভাইরাস মূলত আফ্রিকাতেই বেশি দেখা যায়?
প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র এবং বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শ
আফ্রিকা তার বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র এবং ব্যাপক বন্যপ্রাণীর জন্য সুপরিচিত। আফ্রিকার বিভিন্ন জঙ্গল এবং সাভান্নায় প্রচুর বন্যপ্রাণী রয়েছে, যাদের মধ্যে কিছু ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। বিশেষত, বাদুর, গরিলা এবং বাঁদরদের মাধ্যমে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এই প্রাণীদের সংস্পর্শে এলে মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে খাদ্য হিসেবে বন্যপ্রাণী ভক্ষণ বা ‘বুশমিট’ খাদ্যের প্রচলন রয়েছে। বুশমিট প্রক্রিয়ার সময়, বিশেষ করে অপর্যাপ্ত সুরক্ষার ক্ষেত্রে, মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ধরনের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাস এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বায়োডাইভার্সিটি বা জীববৈচিত্র্য
আফ্রিকায় জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত বেশি, এবং ভাইরাসজনিত রোগের উৎপত্তির ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখে। জীববৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন প্রাণী ও পাখিদের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়ে যায়। নতুন এবং অজানা ভাইরাসগুলি প্রায়ই অন্য প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং এর ফলে উদ্ভব হয় নতুন রোগের। এই ‘স্পিলওভার’ ঘটনা প্রাণী এবং মানুষের মিথস্ক্রিয়ার ফল। আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা
আফ্রিকার অনেক দেশেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া, পর্যাপ্ত মেডিকেল সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়। এমনকি যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা আছে, সেগুলিতে অধিকাংশ সময়ই জনসংখ্যার তুলনায় সেবার পরিমাণ অত্যন্ত কম।
সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যগত পরিষেবা না থাকার কারণে, আক্রান্তরা দূরবর্তী এলাকাগুলোতে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে, ফলে রোগের বিস্তার আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
জলবায়ু এবং আবহাওয়ার প্রভাব
আফ্রিকার গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু এবং উষ্ণ তাপমাত্রা অনেক ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমন, ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়া বহনকারী মশা উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় বংশবৃদ্ধি করে। গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা ভাইরাসের জন্য একটি উৎকৃষ্ট পরিবেশ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে যেসব ভাইরাস মশা বা অন্যান্য কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে আবহাওয়ার ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ভাইরাস সংক্রমণের জন্য আরও উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণ
আফ্রিকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নগরায়ণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলস্বরূপ, মানুষ বেশি ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এই ঘন জনসংখ্যা ভাইরাসজনিত রোগের জন্য একটি উৎকৃষ্ট সংক্রমণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এ ধরনের অবস্থার মধ্যে ভাইরাসের বিস্তারের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস করছে, ফলে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই যোগাযোগ ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।
ঐতিহ্যগত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কুসংস্কার
আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে প্রথাগত এবং লোকজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং কুসংস্কারের কারণে অনেক সময় সংক্রামক রোগ সঠিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ইবোলা সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক স্থানীয় লোকজন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এছাড়া, ঐতিহ্যগত শুশ্রূষা এবং লোকজ ওষুধে বিশ্বাস রাখা এবং আধুনিক চিকিৎসার প্রতি অবিশ্বাস রোগের বিস্তারে সহায়ক হতে পারে।
বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যকার এই ফাঁক ভাইরাসের বিস্তার এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্যাপ্ত গবেষণা ও নজরদারি ব্যবস্থার অভাব
ভয়ানক ভাইরাস এবং সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে পর্যাপ্ত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। ফলে, রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আগে সেটি শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। এর ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ সহজেই একটি ভয়ানক মহামারীর রূপ নিতে পারে।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা
আফ্রিকার অনেক দেশই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। ফলে, ভাইরাসজনিত রোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা এবং সংস্থান বরাদ্দ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা ভাইরাস প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে এবং এই অঞ্চলের মানুষকে অধিকতর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
বৈশ্বিক সংস্থাগুলির সহায়তা এবং সঠিকভাবে বরাদ্দ করা তহবিলের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও, অনেক সময় এই তহবিলের অভাব ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ভয়ানক ভাইরাসজনিত রোগ কেন মূলত আফ্রিকাতে দেখা যায়, তা বোঝার জন্য প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আফ্রিকার প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ, স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা, জলবায়ুর প্রভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণ একসঙ্গে কাজ করে এই অঞ্চলে ভাইরাসজনিত রোগের বিস্তার বাড়িয়ে দেয়।
আফ্রিকায় ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং জনসচেতনতার ওপর জোর দেওয়া জরুরি।
লেখকঃ এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন ,ইউএমসি-০৭ , সেশন: ২০২০-২১, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ