অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামীলীগ বীরদর্পে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে বিনা অনেকটা চ্যালেঞ্জে, বিনা বাধায়, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো নীরবে নিভৃতে। মানুষের ভাটধিকার, বাকস্বাধীনতা, এবং মৌলিক মানবাধিকার ভুলন্ঠিত হয়ে ছিলো চরম আকারে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সমূহকে ধ্বংস করা হয়েছিলো নিজেদের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে। ফলে মানুষের মধ্যে আওয়ামীলীগ বিরোধী ক্ষোভ বাড়তে থাকে।বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় এবং গত ৫ই আগস্ট ২০২৪, স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়, শেখ হাসিনা পালাতে ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এর মধ্যদিয়ে বহুল প্রত্যাশিত একটি ইন্টেরিম বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। স্বভাবত কারণেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের আশা-আকাঙ্খা অনেক বেশি। আর এই সরকারকেও সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামতে করতে হবে সময় নিয়ে, এবং মূল্য দিতে হবে জনগণদের প্রত্যাশার।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে হলে সবার আগে দরকার বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। নামেমাত্র বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও, বিগত সরকার ভিন্নমত ও পথকে দমন ও নিপীড়ণের জন্য বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে একদম নিজের মতো করে। রাজনৈতিক পরিচয়ে দেয়া হয়েছে বিচারক নিয়োগ, যার কারণে ন্যায় বিচার হয়েছে চরমভাবে ভুলন্ঠিত। অন্যদিকে বিচার বিভাগ ছিলো দুর্নীতিগ্রস্থ একটি বিভাগ।যেখানে টাকার বিনিময়ে রায় মিলতো আর ফরমায়েশি রায়তো ছিলো অহরহ।তাই, বিগত দিনের দুর্নীতি, অবিচার, বিচারহীনতা, বিচারের নামে প্রহসন, বিরোধীপক্ষকে হয়রানী, নামে-বেনামে মামলা, গায়েবী মামলা, বিচারকদের রাজনীতি, মামলার জট সহ যেসমস্ত সমস্যা রয়েছে তা দূরীকরণে সবার আগে দরকার সেপারেশন অফ পাওয়ার, বিচারকদের বিচারিক কাজ মনিটর করার জন্য ওয়াচডগ, ও মনিটরিং সেল তৈরী করা, বর্তমান আইন কমিশনকে ঢেলে সাজানো, বিচারকদেরকেও বিচারিক কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি; বিচারকবৃদ্ধি, বিচার কার্যালয় বৃদ্ধি, রিমোট হিয়ারিং সিস্টেমের ব্যাবস্থা, আদালতে আধুনিক অবকাঠামো গড়েতোলা, বিচারকদের আধুনিক ট্রেনিং প্রদানের ব্যাবস্থা করা এবং আদালত পাড়ায় দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, বিচার ব্যাবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা।দল মত নির্বিশেষে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। এর বেত্যয় ঘটলে রাজনৈতিক যে সরকারই আবার ক্ষমতায় আসবে তারাও ঠিক তাদের পূর্ববর্তীদেরমত বিচার বিভাগের গলা চেপে ধরবে, আর সাধারণ জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেই চলবে।
শিক্ষা খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বলতম খাত গুলোর মধ্যে অন্যতম।বাজেট বরাদ্দের তলানিতে রয়েছে এই খাতের অবস্থান। সাথে সাথে কয়েকদিন পর পর শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কাটাছেড়া চলতেই আছে। শিক্ষার নিম্নমান, অযোগ্য-অদক্ষ দলীয় পরিচয়ে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং ব্যাবসা, অযোগ্যদের দিয়ে শিক্ষালয় পরিচালনা, ছাত্র-শিক্ষক রাজীনীতি, কারিগরী শিক্ষার অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যার কারণে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী। দেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও নৈতিকতা সম্বলিত আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক এবং উন্নত দেশের সাথে মানানসই শিক্ষার ব্যাবস্থার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে কমপক্ষে বাজেটের ৫% বরাদ্দ দেয়া, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা, মেধাবীদের মূল্যায়ন করা, যোগ্য ব্যাক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান, মেধা পাচার বন্ধ করা, ব্যাবসায়িক শিক্ষার প্রসার করা, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রায় প্রতিটি শ্রেণীতে আবশ্যক করা, উন্নত সিলেবাস প্রণয়ন করা, সিলেবাস থেকে হাবিজাবি ও ব্যাক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক গুনগান বন্ধ করে সত্যিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন দলের পরামর্শে শিক্ষা, সিলেবাস, দলীয় বিষয় অন্তর্ভুক্তি আইনের মাধ্যেমে বন্ধ করা। পাশাপাশি, গবেষণা খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের ট্রেনিং, আধুনিক অবকাঠামো বৃদ্ধি, প্রয়োজনে অনলাইন ক্লাস চালু করা, প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার মান্নোন্নয়ন করা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ফ্রি স্কুল মিল চালু করা, বিনামূল্যে কলেজ পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করা, টিচিং স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা, কিন্ডার গার্টেন, কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, আবার মাদ্রাসার মধ্যে কওমি, আলিয়া, ইবতেদায়ী ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন করা, যত্রতত্র মাদ্রাসা ও কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ব্যাবসা বন্ধ করা। টিচার-প্যারেন্টস লিয়াজো করা, শিক্ষক, শিক্ষালয়, শিক্ষা বোর্ড সকলকেই জবাদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা।
স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখে আসছি প্রতিটি সরকার সিকিউরিটি ফোর্সকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে। নিজেদের প্রয়োজনে প্রশাসন ও সিকিউরিটি ফোর্সকে নিজেদের দলীয় কাজে ব্যবহার করা যেন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।পুলিশ প্রশাসন সরকারের দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয় অযোগ্যদের। তাই, পুলিশ প্রশাসন বিগত দিনে একটি দলকে সার্ভ করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে এমপি, মন্ত্রীদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিলো। পাশাপাশি পুলিশ চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ঘুষ, হয়রানি, বিরোধী পক্ষকে দমন, নিপীড়ন, গায়েবি মামলা প্রদান, থানায় আটক, গুম, খুন, হত্যা, অত্যাচার, ও বিরোধী মতকে শায়েস্তা করার জন্য পুলিশ, বিজিবি, RAB এমনকি সেনাবাহিনীকে যত্রতত্র ইচ্ছামতো ব্যবহার করা হতো। ফলশ্রুতিতে, পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ বেড়েই চলছিলো। ৫ই আগস্টের পোত্ পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি পুলিশবাহিনীর উপর জনমনের ক্ষোভ। দেশের আইনের শাসনের জন্য, অন্যায়-অত্যাচার বন্ধের জন্য স্বাধীন সিকিউরিটি ফোর্স তৈরী এখন সময়ের প্রয়োজন ।পুলিশকে অথাৎ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত করা, পুলিশ রাজনীতি বা কোনো দলের প্রতি বিশেষ রাগ, অনুরাগ ও বিরাগ থেকে দূরে রাখা, আধুনিক পুলিশিং ব্যাবস্থা কায়োম করা, তাদের বেতন বৃদ্ধি করা, আধুনিক অশ্রসশ্র দেয়া, অস্র ব্যাবহারকে জবাদিহিতার আওতায় আনা, আধুনিক ট্রেনিং প্রদান করা, সমস্ত রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করা, পুলিশকে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদান এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। পাশাপাশি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তদারকি করার জন্য একটি পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করা। আইন প্রণয়ন করে, পুলিশকে দলীয়বাহিনীতে রূপান্তর হওয়া বন্ধকরা।
চিকিৎসা মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা এবং অধিকার হওয়া সত্ত্বেও ঘনবসতি পূর্ণ দেশে আধুনিক এবং মানসম্মত চিকিৎসা ব্যাবস্থা আজ অব্দি গড়ে উঠেনি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাও বিদ্যমান, বাংলাদেশে একদিকে যেমন অপ্রতুল চিকিৎসক সংখ্যা, তেমনি অভাব রয়েছে হাসপাতালের, নার্স, চিকিৎসা সামগ্রী, ও চিকিৎসা অবকাঠামোর। পাশাপাশি দলীয় নিয়োগ, চিকিৎসক রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি, চিকিৎসকদের শহরমুখী প্রবণতা, প্রাইভেট চেম্বার করা, ভেজাল ঔষধ তৈরী, ভুয়া ডাক্তার-সার্টিফিকেট, অযোগ্য ডাক্তার দিয়ে প্রেসক্রিপশন ও অপারেশন করা, মহিলা ডাক্তারের অপ্রতুলতা, নিম্নমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখীতা ইত্যাদি বাংলাদেশের চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা। আবার দেখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি হেলথ সেন্টার থাকলেও জবাবদিহিতার অভাবে, চিকিৎসকরা সেখানে যায় না অথবা অ্যাডমিন স্টাফ দিয়ে হেলথ সেন্টার পরিচালনা করেন। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারি ও বেসরকারী হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, প্রতিটি জেলা শহরে আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা, সরকারি ভাবে সম্ভব না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে বড় ও সর্বাধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা, হেলথকার্ড চালু করা, যতটা সম্ভব বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা, প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করা, সমস্ত হাসপাতাল ও প্যাথলজিকাল ল্যাবগুলোর সমন্বয় সাধন করা, যাতে একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা বার বার না করতে হয়। আবার সকল সরকারি ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষার একটি সহনীয় মূল্যই নির্ধারণ করা যাতে পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে পচয় ও অপব্যায়রোধ করা সম্ভব। প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করা না গেলেও প্রাইভেট চিকিৎসার একটি ফি কাঠামো তৈরী করা, রোগীকে অহেতুক হয়রানী না করা, বিনা প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংস্কৃতি বন্ধ করা, চিকিৎসা ব্যায় কমানো, চিকিৎসকদেরকে জবাদিহিতার আওতায় আনা, চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা, রোগীদের ডাটাবেজ তৈরিকরা ও সমন্বয়ের স্বার্থে রেকর্ড শেয়ার করা। এজন্য একটি টেকসই নিয়তমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে যানজট সমস্যা একটি অন্যতম প্রধানতম সমস্যা। যানজটের জন্য প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন শ্রম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে।যানজটের কারণে একদিকে যেমন শ্রম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে যানজটের প্রভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, কাজের গতিশীলতা কমছে, অর্থের অপচয় হচ্ছে, ইত্যাদি। যানজট থেকে মুক্তির জন্য সবার আগে সকলকে ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা, সম্প্রতি কালে আমাদের ছাত্র-তরুণরা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব খুবই সুন্দর পালন করছে।ট্রাফিক পুলিশ তুলে দিয়ে বরং ট্রাফিক লাইটের মাধ্যমে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা, সিসিটিভির মাধ্যমে ট্রাফিক আইনভঙ্গকারীদের সনাক্তকরণ ও শাস্তির আওতায় আনা, যত্রতত্র পাকিং বন্ধ করা, লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদেরকে শাস্তির আওতায় আনা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টকে কোনো বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে দেয়া, তবে এক্ষেত্রে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে, অর্থাৎ তাদেরকে দিয়ে সপ্তাহে ৩ ঘন্টা কমিউনিটি ওয়ার্ক করতে উদ্ভুদ্ধ করা। ঢাকা শহরের রাস্তার উপর কনজেশন চার্জ আরোপ করা, লেইন মেইনটেইনে বাধ্যকরা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীকে জরিমানা প্রদানে বাধ্য করা, ফুটপাতের উপর হওয়া মার্কেট তুলে দেয়া, রাস্তার উপর হকার বন্ধ করা, রাস্তা প্রশস্ত করা, হকারকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ছুটির দিনে হকার বা স্ট্রিট মার্কেটের ব্যাবস্থা রাখা, ওভার ব্রিজ ব্যাবহারে বাধ্যকরা, অহেতুক হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা। ঢাকা শহর থেকে রিকশা বন্ধ করা তবে প্রতিটি নাগরিকের হাঁটা দুরুত্বে পাবলিক বাসের ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা। বড় ফুটপাথের ব্যবস্থা করা, যাতে সবার হাঁটার অভ্যাস তৈরী হয়। শহরের মধ্যখানে অবস্থিত ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট বাস স্টপেজকে শহরের বাইরে সরিয়ে দেওয়া এবং দূরপাল্লার যানবাহনকে শহরের মধ্যে ঢুকতে না দেয়া। আধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম চালু করা।
বাংলাদেশের জন্ম লগ্ন থেকেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া বা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা ছিলো একটি কমন বিষয়। একদলীয় শাসন ব্যাবস্থা চালু করার জন্য ৪টি পত্রিকা ছাড়া সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছিলো শেখ মুজিবের আমলে। এর ধারাবাহিকতায় সব সরকারই সংবাদ মাধ্যমকে সবসময়ে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে অভ্যস্ত। তবে গত পনের বছরে স্বৈরাচারী সরকার বিগতদিনের সমস্ত ইতিহাসকে ভঙ্গকরে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিরোধী সংবাদ মাধ্যম দমনের সকল অতীত ইতিহাসকে ভঙ্গ করেছে, বন্ধ করেছে বহু পত্র পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল। অন্যদিকে, হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক ছাড়া, সমস্ত সাংবাদিকদেরকে নিজেদের কর্মিবাহিনীতে রূপান্তর করেছে। সাংবাদিকরাও নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কোড অফ কন্ডাক্ট ভঙ্গ করে স্বৈরাচারী তোষণে ছিলো ব্যস্ত। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সাংবাদিকরা সরকারের গুণগানে ব্যস্ত ছিলো। সাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরণের অপরাধে যেমন চাঁদাবাজি, বিরোধীমতকে দমনের জন্য হয়রানি, মিথ্যা রিপোর্ট প্রকাশ, দুর্নীতি, ঘুষ এবং ভিনদেশিদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ছিলো বেশ পারদর্শী। অথচ সাংবাদিকরা হলো সমাজের দর্পন।সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরাই তার প্রধানতম কাজ। সরকারকে সুপরামর্শ, গঠনমূলক সমালোচনা, সরকারের ভুলভ্রান্তি জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য সংবাদকর্মীদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে, স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশে বাধা না দেয়া, ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্টিং, অনলাইন, অফলাইন কোনো সংবাদ মাধ্যমই বন্ধ না করা। সাইবার সিকিউরিটি আইনের অপব্যাবহার রোধ করা, সরকারি লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা, সাংবাদিকদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ভুল তথ্য-উপাত্ত প্রকাশে আইনের আওতায় আনা, সাংবাদিকদের রাজনীতি বন্ধ করা, এবং আধুনিক ও বাস্তব সম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা। এক কথায় সত্যিকারের স্বাধীন ও আধুনিক গণমাধ্যম গড়ে তোলার জন্য যা করা দরকার, সরকারকে তাই করতে হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম খাত হলো রেমিট্যান্সে। প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে।প্রবাসীরা হলো রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এই প্রবাসীরা যখন দেশে যায় তখন তারা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয় বিমানবন্দরে। তারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাওয়াতো দূরের কথা অধিকন্তু তারা হয়রানি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। তাই, প্রবাসীর সুন্দর স্বাভাবিক চলাচল এবং তাদের ভবিষ্যতকে সুসংগঠিত করতে বর্তমান সরকারকে প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী পেনশন স্কীম ও বেনেভোলেন্ট ফান্ড চালু করার পাশাপাশি প্রবাসী ডেস্ককে আরো কার্যকরী করা, এয়ারপোর্টে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, লাগেজ চুরি ও কাটা বন্ধ করা, প্রবাসীদের জন্য বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স এ সুলভমূল্যে টিকিট পাওয়ার ব্যাবস্থা করা, প্রবাসীদের জন্য নতুন নতুন দেশে কর্ম সংস্থানের ব্যাবস্থা করা, আধুনিক ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করা, জনগণকে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা, কম্পিউটার স্কিল ও ব্যাসিক আইটি ও প্রযুক্তি ট্রেনিং প্রদান করা, অল্প খরচে বিদেশে শ্রম রপ্তানির ব্যাবস্থা করা। জনসংখ্যা রপ্তানিতে সব ধরণের দুর্নীতি বন্ধ ও অতিরিক্ত মুনাফাখোরদের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে এমন একটি সেক্টর নেই যার সংস্কার দরকার নেই। বরং বাংলাদেশ নামক দেশটি একটি খাদের কিনারায় অবস্থান করছে। দেশের অর্থনীতি আজ শুন্যের কোঠায়। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলদারির সাথে সাথে গুম, খুন, হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সয়লাব হয়েছে গত পনের বছরে, এতে মানুষ হাল ছেড়েই দিয়েছিলো। সুন্দর ও সম্ভাবনায় রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছিলো শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্যদিয়ে নতুন সম্ভাবনাময় একটি সরকার তার যাত্রা শুরু করেছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া এই রাষ্ট্রের সংস্কার ও মেরামত করতে হবে সময় নিয়ে। তরুণরা বিগত একমাস ধরে যেভাবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেদেরকে উজাড় করে দিচ্ছে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে দেশের ইতিহাসে। তরুণ ও বয়স্কদের সংমিস্ত্রনে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তারা জনগণের আস্থার প্রতীক। তাদের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাও বেশী। তাই, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোর সংস্কার সবার আগে আমলে নিবে, এটি দেশবাসীর প্রত্যাশা।
লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
19/০৮/২০২৪, লন্ডন।