অস্টিওপরোসিস: হাড় ক্ষয় কেন হয়, সেরে ওঠার উপায় কী?
ডেস্ক রিপোর্টঃ একদিন সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা বেঁকে হাড় ভেঙ্গে গেল, কিংবা হাতে খুব ঠুনকো আঘাতেই দেখা গেল ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে। পরে পরীক্ষায় জানতে পারলেন, আপনি দীর্ঘদিন ধরে অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত।
অস্টিওপরোসিস হচ্ছে একটি হাড়ের এমন এক ধরণের ক্ষয় রোগ যা আপনার হাড়কে ভীষণ দুর্বল করে ফেলে, যার কারণে সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে যায় বা ফেটে যায়।
বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মতে, দেশটির মোট জনসংখ্যার অন্তত তিন শতাংশ অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত এবং পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বয়সের সাথে সাথে হাড় দুর্বল হবেই। একে থামিয়ে রাখার কোনো ওষুধ বা উপায় আবিষ্কার হয়নি। তবে চেষ্টা করলে হাড়ের এই বুড়িয়ে যাওয়ার গতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
অস্টিওপরোসিস কী এবং কেন হয়
অস্টিও অর্থ হাড় এবং পরোসিস অর্থ পোরস বা ছিদ্র। সে হিসেবে অস্টিওপরোসিস বলতে বোঝায় যখন হাড়ে বেশি পরিমাণে ছিদ্র থাকে।
হাড়ে বেশি ছিদ্র থাকা মানে বোন ডেনসিটি বা হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া। এতে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সহজেই হাড় ভেঙ্গে যাওয়া বা ফ্র্যাকচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হাড় দুর্বল হওয়ার এই স্বাস্থ্যগত অবস্থাই অস্টিওপরোসিস।
হাড়ের দু’টি অংশ থাকে। ওপরের শক্ত আবরণটিকে বলা হয় কমপ্যাক্ট বোন। ভেতরে স্পঞ্জের মতো ছিদ্র ছিদ্র করা স্তরটিকে বলা হয় স্পঞ্জি বোন বা ট্রেবাকুলার বোন।
অস্টিওপরোসিস হলে হাড়ের ওপরের আবরণ বা কম্প্যাক্ট বোন অনেক পাতলা হয়ে যায় এবং স্পঞ্জি অংশটির ছিদ্র বেড়ে যায় বা ঘনত্ব কমে যায়, যা হাড়কে দুর্বল করে ফেলে।
হাড় সাধারণত একদিকে ক্ষয় হতে থাকে আরেকটি গঠন হতে থাকে। যদি ক্ষয় হওয়ার গতি, নতুন হাড় গঠন হওয়ার গতির চাইতে কমে যায়, তখনই অস্টিওপরোসিস হয়।
কম্প্যাক্ট বোনের গঠন প্রতি ১০ বছর অন্তর আর স্পঞ্জি বোন প্রতি তিন বা চার বছর পর পর বদলায়।
মূলত বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় দুর্বল হতে থাকে যা বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে কিছু মানুষের এই হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্যমতে, মানুষের হাড় সবচেয়ে বেশি মজবুত অবস্থায় থাকে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে। এরপর থেকে হাড় দুর্বল হতে শুরু করে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে
বয়সের হিসেবে পুরুষদের তুলনায় নারীরা আগে অস্টিওপরোসিসে ভোগেন এবং নারীদের এতে আক্রান্তের ঝুঁকিও বেশি।
বিশেষ করে নারীদের মেনোপজের পরে তাদের শরীরে অ্যাস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়, ফলে তখন তাদের হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে।
সাধারণত ৪৫ বছরের আশেপাশে বেশিরভাগ নারীর মেনোপজ শুরু হয়। এছাড়া যেসব নারীরা ডিম্বাশয় অপসারণ করেছেন তাদেরও হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি রয়েছে।
আবার অনেকের জিনগত বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার ওপরেও এই হাড়ের সবলতা নির্ভর করে।
যেমন; আফ্রিকার মানুষদের হাড়ের গঠন প্রকৃতিগতভাবেই মজবুত, সেক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে শ্বেতাঙ্গ ও এশীয় অঞ্চলের মানুষ।
এছাড়া যাদের খাবারে কোনো বাছবিচার নেই, স্থূলতায় ভুগছেন, কিংবা অপুষ্টিতে আক্রান্ত, শুয়ে বসেন থাকেন, কায়িক শ্রম করেন না কিংবা দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদেরও অস্টিওপরোসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
আবার পরিবারে অন্য সদস্যের এই রোগ থেকে থাকলে তার পরবর্তী প্রজন্মেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কারও যদি ধূমপান, অতিরিক্ত মদপান ও মাদক সেবনের মতো অভ্যাস থাকে, সেটিও অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি বাড়ানোর কারণ।
আবার ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে, হাইপার থাইরয়েডিজম বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থাকলে, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের কারণে যেকোনো বয়সীদের অস্টিওপরোসিস হতে পারে।
অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়ার মতো খাওয়ার ব্যাধি থাকলে এর ঝুঁকি বাড়ে। এসব রোগের কারণে রোগীর খাবারের রুচি একদমই থাকে না।
ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও এই রোগ হওয়ার বড় কারণ- বিশেষ করে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ-ডোজের স্টেরয়েড ট্যাবলেট গ্রহণ করলে, অ্যান্টি-অ্যাস্ট্রোজেন ট্যাবলেট খেলে যেটা নারীরা স্তন ক্যান্সারের পরে গ্রহণ করেন।
সাধারণত কবজির হাড়, উরুর হাড় ও মেরুদণ্ডের হাড় সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকে। আবার বাহু, কোমর এমনকি পাঁজরের হাড়ও নরম হয়ে যায়। এমনও দেখা গিয়েছে যে জোরে হাঁচি দেয়ার কারণেও রোগীর পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছে, মেরুদণ্ডের কশেরুকায় ফাটল ধরেছে।
এই রোগটি থেকে শতভাগ সুস্থ হওয়ার ওষুধ নেই। তবে একে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে হাড়ের ক্ষয়ের গতি কমানো সম্ভব।
অস্টিওপরোসিসের আগের পর্যায়কে বা রোগের প্রাথমিক অবস্থাকে অস্টিওপেনিয়া বলা হয়। এই পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে অস্টিওপরোসিসের গতি কমানো সম্ভব।
লক্ষণ
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে আপনার অস্টিওপরোসিস আছে কিনা সেটা আগে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাড় ভাঙলে বা ফ্র্যাকচার হলেই কেবল বিষয়টি সামনে আসে।
প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না কিন্তু পরিস্থিতি যখন জটিল রূপ নেয় তখন রোগীর-
- ঘাড়ে, কোমরে, মেরুদণ্ডে প্রতিনিয়ত ব্যথা হয়
- পেশী ব্যথা করে বা পেশী দুর্বল লাগে
- বয়স্কদের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমে যায় বা কুঁজো হয়ে যায়, কারণ হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণে মেরুদণ্ড শরীরের ভার নিতে পারে না, এজন্য মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে শরীর ঝুঁকে আসে, অনেক সময় হাড় ভেঙে যায়
- পাঁজরের হাড় নীচের দিকে ঝুলে পড়ে
হাড় না ভাঙ্গা পর্যন্ত অস্টিওপরোসিস সাধারণত কষ্টকর হয় না, তবে মেরুদণ্ডের হাড় একবার ভাঙলে সেটা দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হয়।
প্রতিরোধ
অস্টিওপরোসিস প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই রোগের ঝুঁকি যেহেতু বয়সের সাথে বাড়ে তাই আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। আমরা বয়স্কদের শুয়ে বসে থাকতে বলি। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে শারীরিক পরিশ্রম করা বেশ জরুরি।
যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করেন বা শরীরচর্চা করেন তাদেরও হাড়ের গঠন মজবুত হয়, হাড় ক্ষয়ের গতি কমে যায় এবং হাড় গঠনের গতি বেড়ে যায়।
রক্তের ক্যালসিয়াম, ফসফেট সেইসাথে অ্যাস্ট্রোজেন, টেস্টোটেরন ও গ্রোথ হরমোন হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।
তাই ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, প্রোটিন, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টি অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খেলে সেইসাথে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট খেলে, অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিদিন অন্তত ১০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতেই হবে।
সেইসাথে ধূমপান ও মদপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে।
পরীক্ষা
অস্টিওপরোসিস পরীক্ষা করা হয় ডুয়েল এনার্জি এক্স রে অ্যাবজরপ-শিওমেট্রি বা সংক্ষেপে ডেক্সা স্ক্যানের মাধ্যমে।
এখানে রোগীকে শুইয়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ স্ক্যান করা হয় যা সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত পদ্ধতি। এটা করতে ১০ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগে, এক্ষেত্রে শরীরের যে অংশটি স্ক্যান করা হচ্ছে তার উপর সময় নির্ভর করে।
একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক তরুণের হাড়ের সাথে তুলনা করে রোগীর হাড়ের ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। এই গণনা করা হয় টি স্কোর দিয়ে।
পরীক্ষায় রোগীর টি স্কোর যদি মাইনাস দুই দশমিক পাঁচ বা তার কম আসে, তাহলে বুঝতে হবে তার অস্টিওপরোসিস আছে।
এছাড়া পরীক্ষায় রোগীর হাড়ের পরিস্থিতি কয়েকটি গ্রেডে ভাগ করা হয়। রোগীর হাড়ের অবস্থা কোন গ্রেডে আছে, রোগীর বয়স, লিঙ্গ, ভবিষ্যতে হাড় ভাঙার ঝুঁকি কতোটা আছে, আগে হাড় ভেঙেছিল কিনা সেটার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।
আপনার যদি অস্টিওপেনিয়া অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি ধরা পড়ে তাহলে আপনার হাড় সুস্থ রাখতে এবং অস্টিওপরোসিস হওয়ার ঝুঁকি কমাতে আপনি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।
যদি অস্টিওপরোসিস ধরা পড়েই যায় তাহলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি চলাফেরায় সাবধান হতে হবে এবং নিয়মিত চোখের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করাতে হবে।
চিকিৎসা
হাড় মজবুত করার ওষুধ দিয়ে অস্টিওপরোসিসের চিকিৎসা করা যায়।
প্রতিনিয়ত আমাদের যে হাড় গঠন হচ্ছে সেটা কেমন মজবুত হবে, সেটা নির্ভর করবে শরীরের সেরাম ক্যালসিয়াম লেভেলের ওপর।
মানবদেহের প্যারাথাইরয়েড হরমোন ও ক্যালসাটোনিন হরমোন আর ভিটামিন ডি এই সেরাম ক্যালসিয়াম লেভেলকে প্রভাবিত করে।
চিকিৎসকরা সাধারণত রোগীর পরিস্থিতি বুঝে, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট, ন্যাসাল স্প্রে, সাপ্তাহিক বা মাসিক ট্যাবলেট, বছরে একবার হরমোনাল ইনজেকশন, হরমোনাল ওষুধ, ইত্যাদি প্রেস্ক্রাইব করে থাকেন।
মেনোপজের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন এমন নারীদের ওষুধ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যাস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়ানো হয় যা হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে।
তবে এসব ওষুধের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। সে বিষয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেয়া দরকার।