অস্ট্রেলিয়াকে নিয়েই ডুবলো বাংলাদেশ, ‘স্বপ্নের’ সেমিফাইনালে আফগানিস্তান
টি-টোয়েন্টি বি কিংসটাউনের বৃষ্টি বিঘ্নিত এক সন্ধ্যার ম্যাচে ইতিহাস গড়লো আফগানিস্তান, বাংলাদেশের বিপক্ষে বৃষ্টি আইনে ৮ রানের জয় পেয়েছে রশিদ খানের দল।
এই জয়ে একাধারে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনালের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়েছে আফগানিস্তান।
শুরুতে ব্যাট করে আফগানিস্তান ১১৫ রান তোলে, বাংলাদেশকে ১০৫ রানে অলআউট করতে নাভিন উল হক ও রশিদ খান চারটি করে উইকেট নিয়েছেন।
সেমিফাইনালে জায়গা পেতে এই ম্যাচ আফগানিস্তানের জিততেই হতো আর বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১২.১ ওভারে লক্ষ্য তাড়া করা।
এই ম্যাচের ওপর ঝুলে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ভাগ্যও, বাংলাদেশ এই ম্যাচ জিতলেই অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে উঠে যেত।
কিন্তু আফগানিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়ে নিজেরাই সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে।
আফগানিস্তান সেমিফাইনাল খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ভারত সেমিফাইনাল খেলবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
এর আগে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে এই টুর্নামেন্টে নিজেদের অবস্থান এবং লক্ষ্যের ব্যাপারে জানান দিয়েছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট দল।
এমন এক জয়ে ইতিহাস গড়ার পর আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রাশিদ খান বলেন, “এটা আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় একটা ব্যাপার, আমাদের কাছে মনে হয় আমাদের দেশে ক্রিকেটই একমাত্র আনন্দ নিয়ে আসে। আমরা দেশের মানুষকে আনন্দিত করতে পারি এটাই অনেক বড় ব্যাপার”।
ব্রায়ান লারার কথা মনে করিয়ে দিলেন রাশিদ খান
মাত্র ২০০৬ সালের দিকে ক্রিকেট খেলা শুরু করা আফগানিস্তান একটা বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলবে এটা একটা বড় ব্যাপার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, নেই তেমন ঘরোয়া ক্রিকেটের সুযোগ সুবিধা, এমনকি ঘরের মাটিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলারও সুযোগ নেই, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের এই জয়টাকে অনেক বড় পাওয়া মনে করছেন রাশিদ খান।
রাশিদ বলেন, “খুব বেশি মানুষ আমাদের পক্ষে কথা বলেননি, যদি মনে করি কেবল ব্রায়ান লারা বলেছিলেন আমরা সেমিফাইনালে যেতে পারি”।
আফগানিস্তান যখন মাঠ ছাড়ছিল রাশিদ খানের চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত, বয়স কম হলেও রশিদ খানের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা অনেক বছরের। মোহাম্মদ নবীর ক্যারিয়ার আরও বড়।
নতুন ও পুরাতনদের মিলিয়ে আফগানিস্তান দলের প্রতিটি সদস্যের জন্য এই সেমিফাইনাল অনেক বড় অর্জন।
আফগানিস্তানের বোলিং কোচ ডোয়াইন ব্রাভো ম্যাচ শেষে যে দৌড় দিলেন মাঠে, উদযাপনের জন্য, যেকোনো খেলোয়াড়কে হার মানায়।
ম্যাচের একটা পর্যায়ে ডোয়াইন ব্রাভো মাঠে তাকাতেই পারছিলেন না, টেলিভিশন ক্যামেরায় তার উদ্বিগ্ন, দ্বিধাগ্রস্থ চেহারা বারবার দেখাচ্ছিল।
রাশিদ খান এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, প্লেয়ারদের নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছিলেন।
অধিনায়ক রাশিদ খান বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোনো মূল্যে ম্যাচটা জিততে চেয়েছেন, ব্যাটিং ইনিংসে একটা দুই রান নিতে না পারায় এক সতীর্থের দিকে ব্যাট ছুড়ে মারেন রাশিদ খান।
বড় ম্যাচ, বড় মঞ্চ, বড় সুযোগ তাই আবেগের মাত্রাটাও ছিল তুঙ্গে।
আফগানিস্তানের প্রধান কোচ জনাথন ট্রট চেষ্টা করছিলেন আফগানিস্তান যাতে মাঠে যত ইচ্ছা বেশি সময় কাটায়, ম্যাচের একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হলেই আফগানিস্তানের বেশি সুবিধা, সেই সুবিধা নিতে গুলবাদিন নাইব মাঠে শুয়েই পড়লেন মনে হলও।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল এক্স প্ল্যাটফর্মে খানিকটা টিপ্পনী কেটে লিখেছেন, “গুলবাদিন নাইব মনে হয় প্রথম ক্রিকেটার যিনি পায়ে শট খেয়ে এতো দ্রুত সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরলেন”।
চোটের ভঙ্গিতে পড়ে যাওয়ার ২৫ মিনিটের মাথায় উইকেটও পেয়েছেন গুলবাদিন নাইব, যিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক ছিলেন।
মজার বিষয় হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আফগানিস্তানের জয়ের ম্যাচটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদের মাত্র দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, প্রথম ম্যাচে ২০২২ বিশ্বকাপে মাত্র চার রানের জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষক জয় ভট্টাচার্যের মতে, “আফগানিস্তানের শুধু প্রয়োজন বড় দলের বিপক্ষে আরও বেশি ক্রিকেট খেলা। এই দলটা যত খেলবে ততই উৎকর্ষের দিকে যাবে।”
এই বছর কয়েক আগেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সহযোগী দেশগুলোর সাথে শক্তিমত্তার তুলনা করা হতো আফগানিস্তানের।
এখন আফগানিস্তান বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলবে, তাও আবার অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দিয়ে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার প্যাট কামিন্সকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেমিফাইনাল কোন কোন দল খেলবে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “অস্ট্রেলিয়া খেলবে, বাকি ৩টা দল আপনারা পছন্দ করেন”।
বাংলাদেশ কোথায় হারাল সেমিফাইনালের সুযোগ?
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সেমিফাইনাল খেলবে এটা হয়তো সুপার এইটের মাঝপথে কেউ বললে অনেকে হেসেই উড়িয়ে দিতো কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আফগানিস্তান ও ভারতের জয় এই পথ খুলে দিয়েছিল। আফগানিস্তানকে ৬২ রানে অথবা ৪৭ বল হাতে রেখে হারালেই বাংলাদেশ রান রেটে এগিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যেত।
কিন্তু মাঠে যে ক্রিকেট খেললো বাংলাদেশ তাতে অনেক বাংলাদেশ ক্রিকেট সমর্থকরাই বলছেন, “আফগানিস্তান যোগ্য দল হিসেবে উঠেছে।”
বাংলাদেশ ক্রিকেটের একনিষ্ট অনুসারী নিউ ইয়র্ক প্রবাসী শেখ মিনহাজ বলেন, “বাংলাদেশকে দিয়ে আইসিসি ২০-২৫ বছর ধরে চেষ্টা করেছে, একটা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু ক্রিকেটারদের সামর্থ্য নেই, আফগানিস্তানের যেটা আছে এবং তাদের এটা প্রাপ্য”।
মাত্র ১১৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেললেও তানজিদ তামিম আরও একবার হতাশ করেন, ৩ বলে ০ রান করে আউট হন এই ওপেনার।
এটা এই বিশ্বকাপে তানজিদ তামিমের তৃতীয় শূন্য রানের ইনিংস।
এই উইকেট যাওয়ার পর নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব আল হাসান পরপর দুই বলে নাভীন উল হককে উইকেট দিয়ে আসেন।
সাকিব এক নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৬৪ রানের ইনিংস বাদে পুরো টুর্নামেন্টেই ব্যাট হাতে খারাপ করেছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে করলেন ‘গোল্ডেন ডাক’, প্রথম বলেই আউট।
ক্রিকেট সমর্থকরা এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
কেউ কেউ বলছেন, “এমন ম্যাচে সিনিয়রদের উচিৎ ছিল দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট করা সেখানে সাকিব প্রথম বলেই আউট হয়ে ফেরত এলেন।”
বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের একটা অংশ চান সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যাতে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষেই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন ব্যাট করতে নামেন তখনো বাংলাদেশের সেমিফাইনালের আশা ছিল, তিনি নাম্বার পরে নয় বল খেলে চারটি দেন ডট বল, ৯ বলে করেন ৬ রান।
বিবিসি স্পোর্টের সরাসরি ধারাভাষ্যে উঠে আসে, “এটা অদ্ভুত যে বাংলাদেশ সেমিফাইনালের আশা ছেড়ে দিয়েছে, এক রানের জন্য হালকা টোকা দিয়ে ব্যাট করছে কেন তারা?”
রিয়াদ ও রিশাদ হোসেন রাশিদ খানের পরপর দুই বলে আউট হয়ে যান, এখানেই বাংলাদেশের সেমিফাইনালের আশা কার্যত শেষ হয়ে যায়।
মাঝে বৃষ্টির কারণে বারবার খেলা বন্ধ ছিল, তখন ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯ ওভারে ১১৪। সেমিফাইনাল তো দূরের কথা, এই লক্ষ্যও ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এরপর লিটন দাশ একা প্রান্ত ধরে টিকে ছিলেন, ৪৯ বলে ৫৪ রান করে নট আউট ছিলেন লিটন দাশ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১০৫ রানে অল আউট হয়ে যায়, ১ ওভার ১ বল বাকি থাকতেই।
তবে বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর প্রেস কনফারেন্সের কথা শুনে বোঝা যায় বাংলাদেশ সেমিফাইনালের সুযোগ থাকা অবস্থাতেও চেষ্টাই করেনি।
তিনি বলেন, “প্ল্যান ছিল প্রথম ৬ ওভার চেষ্টা করবো, এরপর প্ল্যান করি ৩ উইকেট হারানোর পর নরমাল খেলে ম্যাচটা কীভাবে জেতা যায়।”
কার্যত সেই ৩ উইকেটের দুজন ফিরেছেন শূন্য রানে- তানজিদ তামিম ও সাকিব আল হাসান।
নাজমুল হোসেন শান্ত বলেন, “আমাদের আসলে লক্ষ্য ছিল ম্যাচটা জেতা”।
টুর্নামেন্টের হিসেবে ম্যাচ জিতলে বাংলাদেশের কোনও লাভই হতো না কার্যত।
পাকিস্তানের রিফিউজি ক্যাম্পে জন্ম আফগানিস্তান ক্রিকেটের
আফগানিস্তানের ক্রিকেট আপাতত দৃশ্যমান হলেও আফগান ক্রিকেটারদের অনেকেই নিজ দেশে ক্রিকেটটা শেখেননি।
বিবিসি সংবাদদাতা জাফর হান্দের লেখা অনুযায়ী, “২০১৫ সালে যখন আফগানিস্তান ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার টিকিট পেল তখন মূলত আফগানিস্তানের মূল ভূখন্ডে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পায়। এর আগে আফগানিস্তানে ক্রিকেটকে বিদেশি খেলা হিসেবে দেখা হতো এবং বলা হতো এটা খেলে কী ফায়দা?”
আশির দশকে আফগান ও সোভিয়েতের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় তৈরি হয় ক্যাম্প।
এমনই একটি ক্যাম্পে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলেন জাফর হান্দ, “জালোযাই ক্যাম্পে পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল, সময়টা ১৯৯২ সাল, পাকিস্তান ক্রিকেট বলতে পাগল, ক্যাম্পেও তার প্রভাব ছিল, সেই ক্যাম্পেই আফগানিস্তানেরও ক্রিকেট দল হতে পারে, এমন একটা স্বপ্নের জন্ম হয় যেটা বাস্তবায়িত হয় ১৯৯৫ সালে, যখন আফগানিস্তান ক্রিকেট ফেডারেশন গঠিত হয়।”
নাজমুল আবেদীন ফাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানের ক্রিকেট দলটা তৈরি হয়েছে তা ক্রিকেটারদের আরও শক্তিশালী করেছে মানসিকভাবে। বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের পরিচিত করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে একটা তাড়না ছিল আফগানিস্তান দলটাকেও একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, যেটা অনেকটাই তারা করেও দেখিয়েছে।”