আইএসের হাত থেকে বাঁচতে ‘নিকাব পরা’ নারী সেজেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃইরাকের মসুলের কাছে একটি শহর যখন ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠী দখল করে নিল এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যা করা শুরু করলো তখন সেখানকার কজন পুলিশ বেঁচে থাকার জন্য অদ্ভুত কিছু পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন।
জন বেক তার প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন, নিকাব পরার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন আবু আলাউয়ি।
প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নিকাবের সাহায্যে নিজেদের লুকাতে পেরেছিলেন মধ্যবয়স্ক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। আইএস জঙ্গিরা যখন একের পর এক পুলিশদের হত্যা করছিল সেই সময় এই নিকাবই কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে
নিরাপদে রেখেছিল- এক কথায় কিছু পুলিশের প্রাণ বাঁচিয়েছিল ‘নিকাব’।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাম্মাম-আল-আলিল শহরে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী প্রবেশ করে ।
যেহেতু সেসময় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ইরাকজুড়ে অভিযান চালাচ্ছিল আইএস, তাই তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা।
তারা শহর দখল করেই দ্রুত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হত্যা করে। তবে তারা শর্তও দিচ্ছিল যদি বাগদাদ সরকারকে ত্যাগ করে ইসলামিক স্টেটের নিয়মবিধি অনুযায়ী তাদের অধীনে থাকে তাহলে তাদের হত্যা করা হবে না।
এই অবস্থায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা আবু আলাউয়ি। প্রথমে তিনি তার বাড়িতেই ছিলেন, বাগানে গর্ত খুঁড়ে সেখানে আত্মগোপন করে ছিলেন।
কিন্তু বারবার আইএস সদস্যরা পুলিশ বা সেনা কর্মকর্তাদের খোঁজ করতে থাকলে আবু আলাউয়ি বেঁচে থাকার অন্য পন্থা বের করলেন।
মি: আলাউয়ি সিদ্ধান্ত নিলেন ‘নিকাব’ পরার, তার মনে হয়েছিল এটাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। তার এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়েছিল।
নিকাব পরিহিত একজন নারী সেজে ঘোরাঘুরি করতেন আবু আলাউয়ি, অনেকটা নিরাপদেই থাকতেন তিনি।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন ‘এটার মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ছিল, রোমাঞ্চও কাজ করতো। তবে জঙ্গিদের একদম কাছাকাছি যাবার বিষয়টা মোটেও আনন্দদায়ক ছিল না বলছিলেন তিনি।
তার ভয়ও লাগতো, কারণ পুলিশের যে বন্ধুরা নারী সেজে ঘুরছিলেন-তাদের অনেককে দেখে সন্দেহ হয়েছিল জঙ্গিদের। নারী সেজেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের বাঁচাতে পারেননি কজন, তাদের গ্রেফতার করেছিল আইএস।
“জঙ্গিরা আমার একদম সামনে দিয়ে যাচ্ছে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে এবং আমি তখন অনেক ভয়ও পেয়েছি। সবসময় মনে হয়েছে এই বুঝি আমাকে ধরে তল্লাশি করা হবে এবং ধরা পড়ে যাবো যে আমি নারী নই”-বলছিলেন আবু আলাউয়ি।
হাম্মাম আল আলিল ছিল একটি পরিষেবার শহর। বিশেষ করে বসন্তকালে এই শহরে আসতো পর্যটকেরা, অনেকে আসতো চিকিৎসাগত কারণে।
কিন্তু এখন সেখানে কোনও পর্যটকের উপস্থিতির কথা ভাবাই যায় না।
সাংবাদিক জন বেক আবু আলাউয়ির দেখা পান একটি বেসরকারি সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রমের সময়।
হাম্মাম আল আলিল ছিল একটি পরিষেবার শহর। বিশেষ করে বসন্তকালে এই শহরে আসতো পর্যটকেরা, অনেকে আসতো চিকিৎসাগত কারণে।
কিন্তু এখন সেখানে কোনও পর্যটকের উপস্থিতির কথা ভাবাই যায় না।
সাংবাদিক জন বেক আবু আলাউয়ির দেখা পান একটি বেসরকারি সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রমের সময়।
স্থানীয় একজন পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিক জন বেককে শহরের বাইরে একটি গণকবর দেখান। সেখানে বিদঘুটে গন্ধ পাওয়া যায় এবং সহজেই বুঝা যায় কী ঘটেছে ওই জায়গাটিতে।
“এই মাটির নীচে সবই মানুষের দেহ”-বলছিলেন একজন কর্মকর্তা। তার মতে এই এলাকায় অন্তত ৩৫০ জনকে কবর দেয়া হয়েছে।
আবু আলী নামে আরেকজন ব্যক্তিও তার পুরনো পুলিশের পরিচয়পত্র দেখায়। আবু আলীকেও হয়তো আইএস মেরে ফেলতো, কিন্তু তিনিও নিকাব পরে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
আবু আলীর ভাইও পুলিশ কর্মকর্তা ছিল, তাকে মেরে ফেরে জঙ্গিরা। ওই ভাইয়ের ঘরে স্ত্রী ও সাত সন্তান রয়েছে। আর হাম্মাম আল আলী ছেড়ে যাবার সময় আবু আলীর বাবাকেও আইএস ধরে নিয়ে যায়, মসুল প্রবেশে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
এই শহরের প্রায় সব পরিবারেই এমন ঘটনা ঘটেছে।
একজন সরকারপন্থী মিলিশিয়া যার বয়স মাত্র ২০ বছর তার পিতামাতাকে আইএস হত্যা করেছে এবং সাত ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
তবে শহরটি ঘুরে সাংবাদিক জন বেক দেখতে পেয়েছেন এটি তার নিজ রূপে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে। এখানকার মানুষ স্বাভাবিক হবার চেষ্টার করছে।
যেমন শহরের টাইগ্রিস নদীর তীরে যে জায়গায় ‘থার্মাল বাথ’ নেয়া হতো সেখানে গরম পানিতে শিশু-কিশোরসহ সেনাসদস্যদের গোসল করতে ও পানি নিয়ে খেলা করতে দেখেছেন জন বেক।
আবার কজনকে একটা বোতলে মাটিও ভরতে দেখা গেছে।
এসব কার্যক্রম হয়তো তাদের স্বাভাবিক হওয়ার প্রাথমিক চেষ্টা। তবে একসময় আইএস এর দখলে থাকা এ শহরটির মানুষের মনে যে ক্ষত তৈরি করে গেছে তা সারতে হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে।