আমেরিকায় যাত্রীবাহী বিমানের সাথে হেলিকপ্টারের সংঘর্ষ, এ পর্যন্ত ৩০ মৃতদেহ উদ্ধার

Spread the love

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী জেট বিমানের সাথে একটি সামরিক হেলিকপ্টারের সংঘর্ষ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।

স্থানীয় সময় রাত নয়টার দিকে রিগান ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে ৩৩-এর কাছাকাছি ঘটনাটি ঘটে।

যাত্রীবাহী বিমানটিতে মোট ৬০ জন যাত্রী এবং চারজন ক্রু সদস্য ছিলেন। আর হেলিকপ্টারে তিনজন মার্কিন সৈন্য ছিলেন।

হতাহতের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না করা গেলেও আমেরিকায় বিবিসির পার্টনার সিবিএস নিউজ জানাচ্ছে এ পর্যন্ত ৩০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা।

ওয়াশিংটন ডিসির জরুরি পরিষেবা বিভাগ জানিয়েছে, বিমানটি পোটোম্যাক নদীতে বিধ্বস্ত হয়েছে।

ইতিমধ্যে উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়েছে এবং নৌকাগুলো নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনুসন্ধানে কাজ করছে।

এফএএ সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় আমেরিকান ঈগল ফ্লাইট ৫৩৪২, যা উইচিটা, কানসাস থেকে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিল।

এটি পিএসএ এয়ারলাইন্স দ্বারা পরিচালিত একটি সিআরজে-৭০০ মডেলের বিমান ছিল।

জরুরি বিভাগের একজন চিফ জন ডনেলি বলছেন প্লেনের বিভিন্ন অংশ নৌকাগুলো খুঁজে পেলেও কেউ আদৌ বেঁচে আছেন কিনা সেটা তারা জানেন না।

রিগ্যান ওয়াশিংটন জাতীয় বিমানবন্দর
রিগ্যান ওয়াশিংটন জাতীয় বিমানবন্দরে ও বাইরের সমস্ত ফ্লাইট কমপক্ষে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে

মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আর হেলিকপ্টারটি প্লেনের কাছেই পানিতে অক্ষত অবস্থায় উল্টে ছিল।

সিবিএস জানাচ্ছে, দুর্ঘটনায় জড়িত সামরিক হেলিকপ্টারটি ছিল একটি ইউএস আর্মির ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার, যেটি মূলত প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল।

হেলিকপ্টারটিতে কোনো উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।

রাতের বেলা ওয়াশিংটন ডিসি এবং এর আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামতে পারে বলে ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস পূর্বাভাস দিয়েছে, যা উদ্ধার কাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

তাপমাত্রা মাইনাস এক থেকে মাইনাস দুই পর্যন্ত পূর্বাভাস দিয়েছে এবং গত সপ্তাহখানেক ধরে নদীর বিভিন্ন অংশে বরফ জমতে দেখা গেছে।

ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্টের অভিষেকের অনুষ্ঠানই কিছুদিন আগে বাইরের বদলে ক্যাপিটলের ভেতরে করা হয়েছিল ঠাণ্ডার কারণে। সেখানে রাতের বেলা আলো না থাক অবস্থায় এতটা ঠাণ্ডার মাঝে উদ্ধারকাজ আরও কঠিন হলে পারে বলে জানানো হচ্ছে।

উদ্ধারকাজ রাতভর চলবে বলে জানানো হচ্ছে। অন্তত ৩০০ উদ্ধারকর্মী নদীজুড়ে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছেন।

রিগ্যান ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সেখানে সমস্ত ফ্লাইটের উড্ডয়ন ও অবতরণ আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিমানগুলোকে ২৮ মাইল দূরের ডালাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন তারা আকাশে উজ্জ্বল আলো দেখেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী অরি শুলম্যান বলেছেন, তিনি আকাশে ‘বিশাল আতশবাজির’ মতো এক ধরনের ‘স্ফুলিঙ্গ’ দেখতে পেয়েছেন।

সেসময় তিনি বিমানবন্দরের পাশেই জর্জ ওয়াশিংটন পার্কওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। শুলম্যান বলেন, তিনি প্রায়ই সেখানে বিমান অবতরণ করতে দেখেন, তাই প্রথমে কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়নি।

“সবকিছু স্বাভাবিক ছিল, বিমানটি ঠিকঠাক এগিয়ে আসছিল,” তিনি বলেন।

রেগান বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনা ঘটে
রেগান বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনা ঘটে

তবে, এরপর হঠাৎ করে তিনি দেখেন, বিমানটি ডানদিকে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে কাত হয়ে গেছে।

“আমি বিমানের নিচের অংশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, যা এত অন্ধকারে দেখা যাওয়ার কথা নয়,” তিনি বলেন।

তিনি বিমানটির নিচে উজ্জ্বল হলুদ আলো এবং সামনের দিক থেকে পেছন পর্যন্ত স্ফুলিঙ্গ দেখতে পান – যা অনেকটা আতশবাজির মতো।

কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দ না পাওয়ায়, আর আগুনের গোলা বা দুর্ঘটনার অন্য কোনো লক্ষণ না দেখায় তিনি রাস্তার দিকে মনোযোগ দেন।

“আমি ভেবেছিলাম, আমি কি ভুল দেখলাম? এত বড় দুর্ঘটনার পর কেন কিছুই দেখতে পেলাম না?,” তিনি বলেন।

তবে কিছুক্ষণ পর যখন তিনি সামনে এগিয়ে যান, তখন দেখতে পান, চারদিকে জরুরি উদ্ধারকর্মীদের ভিড় জমে গেছে।

আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীও তারার আলোকচ্ছটার মতো সাদা আলো দেখেছেন আকাশে।

একজন যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ হামাদ রাজা নামে দুর্ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, তিনি রিগ্যান ওয়াশিংটন জাতীয় বিমানবন্দরে তার স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যিনি আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানে ছিলেন।

“সে আমাকে টেক্সট করেছিল যে সে ২০ মিনিটের মধ্যে অবতরণ করবে,” সিবিএস নিউজের স্থানীয় সহযোগীকে জানান তিনি।

তিনি আশা করছেন নদী থেকে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের আইনপ্রণেতারা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রার্থনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

রবার্ট ইসম,আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী
রবার্ট ইসম,আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী

দায়ী হেলিকপ্টার?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে একটি “ভয়ংকর দুর্ঘটনা” বলে বর্ণনা করেছেন এবং জরুরি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ‘অসাধারণ কাজের’ জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ট্রুথে এ দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, “বিমানটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সঠিক পথে বিমানবন্দরের দিকে আসছিল। হেলিকপ্টারটি দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি বিমানের দিকে আসছিল। রাত ছিল পরিষ্কার, আর বিমানের স্পষ্টভাবে আলো জ্বলছিল।”

“কেন হেলিকপ্টারটি উপরে বা নিচে গেল না, বা মোড় নিল না? কেন কন্ট্রোল টাওয়ার হেলিকপ্টারকে নির্দেশ না দিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করল, তারা কি বিমানটিকে দেখতে পাচ্ছে?” পোস্টে লিখেছেন মি. ট্রাম্প।

তার মতে এই ভয়ংকর পরিস্থিতি সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ জেফারি থমাস দুর্ঘটনার ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করে বলছেন “হেলিকপ্টারটি উপরে উঠছিল, এবং শেষ মিনিটে এটি ২০০ ফিট থেকে সাড়ে ৩০০ ফিটে উঠে যায়।”

“এছাড়াও এটি ছয়বার গতিপথ পরিবর্তন করে। আমি ধারণা করি সামনে আমরা হেলিকপ্টারটিকেই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখবো,” বলছিলেন মিঃ থমাস।

বলা হচ্ছে এমন এলাকায় হেলিকপ্টার সাধারণত ২০০ ফিটের নিচে থাকার কথা, যার ব্যত্যয় ঘটেছিল এক্ষেত্রে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন নিশ্চিত করেছে যে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে সহায়তা দেবে।

নতুন পরিবহণ সচিব শন ডাফি বলেছেন, তিনি এফএএ-এর সদর দপ্তরে থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন।

ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (এনটিএসবি) যৌথভাবে দুর্ঘটনার তদন্ত করবে বলে জানানো হয়েছে।

এদিকে, আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী রবার্ট ইসম বলেছেন, দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীদের উদ্ধারে সম্ভাব্য সব কিছু করা হচ্ছে।

এই বিমানবন্দরটি আমেরিকার অত্যন্ত ব্যস্ত একটি বিমানবন্দর যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার বিমান চলাচল করে।

এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো প্রযুক্তিগত অনেক কিছুই আধুনিক বিমান ব্যবস্থায় থাকে। তারপরেও আবহাওয়ার কোনও বাড়তি জটিলতা ছাড়াই এমন দুর্ঘটনা অনেককে বিস্মিত করেছে।


Spread the love

Leave a Reply