ইয়াহিয়া সিনওয়ার, কে এই হামাস নেতা?
ডেস্ক রিপোর্টঃ ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিখোঁজ হয়েছেন। ইসরায়েলের হাজার হাজার সৈন্য তার হদিস বের করতে ড্রোন, বৈদ্যুতিক আড়ি পাতার যন্ত্র এবং গোপন তথ্যদাতাদের নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এতো কিছুর পরও তার কোন খোঁজ না পাওয়া খুব অবাক হওয়ার মতোই।
সিনওয়ার, যাকে দেখলেই তুষার-শুভ্র চুল এবং কুচকুচে-কালো ভ্রু চোখে পড়বে- তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা এবং ইসরায়েলের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি।
গত ৭ই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে অভিযানের পেছনে অন্যদের সাথে তাকেও দায়ী করা হয়। যে ঘটনায় য় ১২০০ জন নিহত হয়েছিলেন এবং ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে অপহরণ করা হয়েছিল।
“ইয়াহিয়া সিনওয়ার হামাসের কমান্ডার ছিলেন এবং তার সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে” অক্টোবরের শুরুতে এমনই ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি।
আইডিএফ-এর চিফ অফ স্টাফ হারজি হালেভি বলেছেন, “এই জঘন্য হামলার সিদ্ধান্ত ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিয়েছিলেন। অতএব তিনি এবং তার অধীনে যারা আছে তাদের বিপদ আসন্ন।”
এর মধ্যে রয়েছেন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতা মোহাম্মদ দেইফ। যিনি এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট ধারণা করছেন যে ৭ই অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনার পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন দেইফ। কারণ এটি একটি সামরিক অভিযান ছিল।
কিন্তু সিনওয়ার “সম্ভবত সেই গ্রুপের অংশ ছিলেন যারা এই হামলার পরিকল্পনা করেছে এবং তা বাস্তবায়নে প্রভাব রেখেছে”।
ইসরায়েলের ধারণা সিনওয়ার, যিনি হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহর পরে কার্যকরভাবে সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্বে আছেন, তিনি মাটির নীচে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
গাজার মাটির নীচে সুড়ঙ্গের কোথাও তিনি তার দেহরক্ষীদের সাথে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
ফোনের সিগনাল ধরে তার অবস্থান শনাক্ত হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তিনি কারও সাথে যোগাযোগ করছেন না।
বেড়ে ওঠা এবং কারাবাস
৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত।
তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তার বাবা-মা এসেছিলেন আশকেলন থেকে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের তাদের পৈতৃক ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়।
ওই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা “আল-নাকবা” (বিপর্যয়) বলে অভিহিত করে।
ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুত হওয়া এই মানুষগুলো পরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
তিনি খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেন। তারপর গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
সেই সময়ে, খান ইউনিস ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের “ঘাঁটি”, বলেছেন ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি, যিনি চারবার কারাগারে সিনওয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
ইয়ারি বলেছেন, “শরণার্থী শিবিরে দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা যেসব তরুণ মসজিদে যেতেন, তাদের ওপর ইসলামপন্থী দলটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল”, যা পরবর্তীতে হামাস প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের প্রভাব রাখে।
সিনওয়ারকে ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো “ইসলামী কার্যকলাপের” জন্য গ্রেফতার করেছিল ইসরায়েল। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।
তারপর ১৯৮৫ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এই সময়েই তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থা অর্জন করেছিলেন।
তেল আবিবের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেছেন,আহমেদ ইয়াসিন এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ার দুজন “খুব, খুব ঘনিষ্ঠ” হয়ে পড়েন।
”সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সাথে এই সম্পর্কের কারণে সিনওয়ার পরবর্তীতে ওই আন্দোলনের মধ্যে গভীর প্রভাব তৈরি করেন”, বলেন মাইকেল।
১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছর পর, তিনি গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল-মাজদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৫।
আল-মাজদ তথাকথিত নৈতিকতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে।
মাইকেল বলেন যে, সিনওয়ার মূলত “যৌন ভিডিও” সংগ্রহ করা দোকানগুলোকে লক্ষ্য করে অভিযান চালাতেন- সেইসাথে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করার জন্য সন্দেহভাজন যে কাউকে ধরে হত্যা করার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে।
ইয়ারি বলেছেন, ”ইসরায়েলের সাথে আঁতাত করার জন্য সন্দেহভাজন অসংখ্য ব্যক্তিকে সিনওয়ার ‘নিষ্ঠুরভাবে হত্যা’ করেছিলেন। “তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি নিজ হাতে হত্যা করেছেন। এসব নিয়ে আমি বা অন্যদের সাথে কথা বলার সময় তিনি এ নিয়ে বেশ গর্ব করতেন।”
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, তিনি পরে একজন সন্দেহভাজন তথ্য-দাতাকে শাস্তি দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। শাস্তি হিসেবে তিনি ওই ব্যক্তিকে জীবিত কবর দেন। এই কবর দেয়ানো হয় ওই ব্যক্তির আপন ভাইকে দিয়ে এবং মাটি সরাতে, কোদালের পরিবর্তে তাকে একটি চামচ ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছিল।
“তিনি এমন একজন মানুষ যিনি তার চারপাশে অনুগামী, অনুরাগীদের জড়ো করতে পারেন – এমন অনেকে আছেন যারা তাকে শুধু ভয় পান এবং তার সাথে কোন ঝগড়া করতে চান না,” ইয়ারি বলেন।
১৯৮৮ সালে, সিনওয়ার দুই ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
একই বছর তাকে গ্রেফতার করা হয়, ১২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যার জন্য ইসরায়েল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং চার দফায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
কারাগারের সময়গুলো
সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ – ২২ বছরেরও বেশি সময় – অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন।
কারাগারে থাকার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবার কিছু সময় সম্পূর্ণ নির্জন কারাবাস ছিল, যা তাকে আরও উগ্রপন্থী করে তোলে বলে মনে করা হয়।
“তিনি চাপ প্রয়োগ করে নিষ্ঠুরভাবে তার কর্তৃত্ব আরোপ করতে পেরেছিলেন,” ইয়ারি বলেছেন।
তিনি বন্দীদের মধ্যে একজন নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। কারা কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি বন্দিদের পক্ষে আলোচনা করতেন এবং বন্দীদের শৃঙ্খলভাবে চলার ওপর চাপ দিতেন।
কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ারের চরিত্রকে মূল্যায়ন করেছিল ইসরায়েল সরকার।
তারা তার চরিত্রকে “নিষ্ঠুর, কর্তৃত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী এবং অস্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন, ধূর্ত এবং কৌশলী, অল্পতেই সন্তুষ্ট… কারাগারের ভিতরে অন্যান্য বন্দীদের মধ্যেও কথা গোপন রাখতে পারা… নিজের চারপাশে মানুষকে ভিড় করানোর ক্ষমতা” এমন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন।
সিনওয়ারের সাথে বার বার দেখা হওয়ার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে ইয়ারির মূল্যায়ন হল, সে সময় সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ ছিলেন।
তবে সিনওয়ারের বিষয়ে বলতে গিয়ে “সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ,’ শুধু এই মন্তব্য করাটা ভুল হবে” “কারণ তাহলে এই অদ্ভুত, জটিল ব্যক্তির অনেককিছু এড়িয়ে যাওয়া হবে”।
ইয়ারির মতে, তিনি হলেন “অত্যন্ত ধূর্ত, বুদ্ধিমান – একজন ব্যক্তি যিনি তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সুইচ নিজের ইচ্ছেমত চালু এবং বন্ধ করতে পারতেন”।
এ কথায় তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে কাউকে আকর্ষণ করার দুর্বার ক্ষমতা রয়েছে এবং তিনি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
সিনওয়ার তাকে বলতেন ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে হবে এবং জোর দিয়ে বলতেন যে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য কোনও জায়গা নেই।
এই কথাটি “তিনি রসিকতা করে বলতেন, ‘হয়তো আমরা তোমার ভেতর থেকে ব্যতিক্রম কিছু বের করব’।
বন্দী থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রুতে সাবলীল হয়ে উঠেছিলেন, ইসরায়েলি সংবাদপত্র পড়তেন। ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার সবসময় তার সাথে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করতেন, যদিও ইয়ারি আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
“তিনি তার হিব্রুকে উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন,” ইয়ারি বলেন। “আমি মনে করি তিনি এমন একজনের কাছ থেকে উপকৃত হতে চেয়েছিলেন যিনি কারাগারের ওয়ার্ডেনদের চেয়ে ভালো হিব্রু বলতেন।”
সিনওয়ারকে ২০১১ সালে একটি চুক্তির অংশ হিসাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। একজন ইসরায়েলি জিম্মি, আইডিএফ সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে এক হাজার ২৭ ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি আরব বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
শালিতকে অপহরণের পর পাঁচ বছর ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছিল – তার বিনিময়ে মুক্তি দেয়া অন্য বন্দিদের মধ্যে সিনওয়ার এবং তার ভাইও ছিলেন।
সিনওয়ারের ভাই ছিলেন হামাসের একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার। এরপর থেকে সিনওয়ার আরও ইসরায়েলি সেনাদের অপহরণের আহ্বান জানায়।
ততোদিনে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় তাদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টিকে উৎখাত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে হামাস।
ফাতাহ পার্টির অনেক সদস্যকে উঁচু ভবনের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।
কঠোর শৃঙ্খলা
যখন সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসেন, তখন তাকে অবিলম্বে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, মাইকেল বলেন।
এর মূল কারণ ছিল হামাসের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি বেশ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
যিনি ইসরায়েলের কারাগারে তার জীবনের এতটা বছর উৎসর্গ করেছেন।
এছাড়াও, “মানুষ তাকে কেবল ভয় পেতো – তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি নিজ হাতে মানুষকে হত্যা করেছেন”, মাইকেল বলেন। “তিনি একই সময়ে খুব নৃশংস, আক্রমণাত্মক এবং ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন।”
“তিনি ভালো বক্তা ছিলেন না” ইয়ারি বলেছেন। “যখন তিনি জনসাধারণের সাথে কথা বলতেন, তখন মনে হতো মাফিয়া গ্রুপের কেউ কথা বলছে।”
ইয়ারি আরও বলেন, জেল থেকে বের হওয়ার পরপরই, সিনওয়ার ইজেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড এবং চিফ অফ স্টাফ মারওয়ান ইসার সাথে একটি জোট গঠন করেন।
২০১৩ সালে, তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৭ সালে তিনি হামাসের প্রধানের ভূমিকায় আসেন।
সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদও হামাসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।
২০১৪ সালে হামাস তাকে মৃত ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন বলে দাবি করা হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, তিনি এখনও জীবিত থাকতে পারেন।
গাজার নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকা হামাসের সামরিক শাখায় তিনি সক্রিয় থাকতে পারেন। এমনকি ৭ই অক্টোবরের হামলায় তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
নির্মমতা এবং সহিংসতার জন্য সিনওয়ারকে খান ইউনিসের কসাই নামে ডাকা হতো।
ইয়ারি বলেন, “তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কঠোর শৃঙ্খলা আরোপ করতেন,” হামাসের সবাই তা জানে এমন মানে- যদি আপনি সিনওয়ারের অবাধ্য হন, আপনি আপনার জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।
তিনি আত্মসাৎ এবং সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত মাহমুদ ইশতিভি নামে এক হামাস কমান্ডারকে ২০১৫ সালের আটক, নির্যাতন এবং হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ সালে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এক ব্রিফিংয়ে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা যে বিক্ষোভ করেছে বিশেষ করে ইসরায়েল থেকে গাজা উপত্যকাকে আলাদা করা সীমান্ত বেষ্টনী ভেঙ্গে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছে তার প্রতি তিনি তার সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন।
ওই বছরের শেষের দিকে তিনি পশ্চিম তীরে প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) অনুগত ফিলিস্তিনিদের একটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন বলে দাবি করেন।
তবুও তিনি ইসরায়েলের সাথে সাময়িক যুদ্ধবিরতি, বন্দী বিনিময় এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্ব মিটমাট করার প্রতি আগ্রহ দেখানোর মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য নমনীয় ভূমিকায় ছিলেন।
এমনকি কিছু কিছু বিরোধী তাকে খুব মধ্যপন্থী বলে সমালোচনা করেছিল, মাইকেল বলেন।
ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠতা
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই মনে করেন বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে সিনওয়ারকে কারাগার থেকে বের করে দেওয়া একটি মারাত্মক ভুল ছিল।
ইসরায়েলিরা মনে করে যে তারা, হামাসকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং আরও কাজের অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে নিরাপত্তা বিধানে করবে, এমন ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয়েছিল।
তারা ভেবেছিল এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়াতে পারবে। কিন্তু এই গণনা যে সম্পূর্ণ ভুল ও বিপর্যয়কর ছিল সেটা পরে বোঝা যায়।
“তিনি নিজেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার নির্ধারিত ব্যক্তি বলে মনে করতেন – তিনি গাজার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিষেবার উন্নতির বিষয়ে এতোটা চিন্তিত ছিলেন না,” বলেন ইয়ারি৷
২০১৫ সালে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিনওয়ারকে “বিশেষভাবে মনোনীত বিশ্ব সন্ত্রাসী” হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করে।
২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি বিমান গাজা উপত্যকায় তার বাড়ি এবং অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালায়।
২০২২ সালের এপ্রিলে, এক টেলিভিশন ভাষণে, তিনি মানুষদের যে কোন উপায়ে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।
বিশ্লেষকরা তাকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সাথে তার সশস্ত্র শাখা, ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডকে যুক্ত করার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এই ব্রিগেড গত ৭ই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৪ই অক্টোবর, এক ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচট সিনওয়ারকে “দ্য ফেইস অব ইভিল” বা “পিশাচের মুখ” বলে অভিহিত করেন।
তিনি আরও বলেন: “ওই ব্যক্তি এবং তার পুরো দল আমাদের নজরদারিতে আছে। আমরা তাকে ধরবোই।”
সিনওয়ারও ইরানের বেশ ঘনিষ্ঠ। ইরান যেখানে শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত দেশ তাদের সাথে একটি সুন্নি আরব সংগঠনের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে ওঠা খুবই বিরল ঘটনা।
তবে উভয়ের লক্ষ্য একটাই, আর তা হল ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবসান এবং জেরুসালেমকে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে “মুক্ত” করা।
তারা হাতে হাত রেখে কাজ করতে এসেছেন। ইরান হামাসকে তহবিল, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।
তারা হামাসকে সামরিকভাবে সক্ষম করে গড়ে তুলতে এবং হাজার হাজার রকেটের অস্ত্রাগার বানাতে সহায়তা করছে। যা তারা ইসরায়েলি শহরগুলোর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে ব্যবহার করে।
সিনওয়ার ২০২১ সালে দেয়া এক বক্তৃতায় ইরানের সমর্থনের জন্য তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। “ইরান না থাকলে, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বর্তমান সক্ষমতার জায়গায় এসে পৌঁছাত না” এমনটা বলেছিলেন তিনি।
তবুও সিনওয়ারকে হত্যা করা ইসরায়েলের জন্য “পিআর বিজয়” এর চেয়ে বেশি কিছু। কেননা এটি আন্দোলনকে প্রভাবিত করবে, মি. লোভাট বলেন।
যদিও এ ধরনের সংগঠনগুলো সামুদ্রিক প্রাণী হাইড্রার মাথার মতো কাজ করে – একজন অপারেশনাল কমান্ডার বা ফিগারহেড নেতা অপসারিত হলে তার জায়গায় দ্রুত অন্য আরেকজনকে প্রতিস্থাপন করা হয়।
নতুন উত্তরসূরির মধ্যে মাঝে মাঝে একই অভিজ্ঞতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব থাকে।
মি. লোভাট বলেন, “স্পষ্টতই, তাকে হারানো বড় ধরনের ক্ষতি হবে, কিন্তু তাকে প্রতিস্থাপন করা হবে এবং সেটি করার জন্য কাঠামো রয়েছে। এটি বিন লাদেনকে হত্যা করার মতো নয়। হামাসের মধ্যে অন্যান্য সিনিয়র রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা রয়েছেন।”
এরপরও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায় – হামাসকে নির্মূল করার জন্য ইসরায়েল যখন তাদের সামরিক অভিযান শেষ করবে, তখন গাজার কী হবে এবং শেষ পর্যন্ত কে দায়িত্বে থাকবে?
তারা কি গাজাকে আবারও ইসরায়েলের উপর আক্রমণের ক্ষেত্র হওয়া থেকে আটকাতে পারবে? যার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব এতো ভয়াবহ পরিণতি ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পাচ্ছে?