ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ-র মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে
ইসরায়েল অধিকৃত গোলান হাইটসে (গোলান মালভূমি) একটি রকেট হামলায় নিহতদের জানাজা রবিবার সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি ওই হামলাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, এই সম্ভাবনাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
এর আগে শনিবার গোলান মালভূমির মাজদাল শামস এলাকার একটি ফুটবল মাঠে একটি রকেট আঘাত হানলে অন্তত ১২জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু।
এই হামলার জন্য ইসরায়েল হেজবুল্লাহ-কেই দায়ী করছে, কিন্তু লেবাননের ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি হামলায় তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে।
এর আগে রবিবার সকালে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সূত্রে জানানো হয়, তারা নির্দিষ্ট সাতটি হেজবুল্লাহ লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে, যার সবগুলোই ‘লেবানিজ ভূখণ্ডের অনেক ভেতরে অবস্থিত’।
গত অক্টোবরে যখন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন থেকেই ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ-র মধ্যেও নিয়মিত গোলাগুলির বিনিময় চলছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হেজবুল্লাহ-কে এই হামলার জন্য ‘চড়া মূল্য চোকাতে হবে’ – যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্পষ্ট করে দিয়েছেন তারা চান না এই সংঘাত আরও বৃদ্ধি পাক।
ওদিকে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত চব্বিশ ঘণ্টায় গাজাতে ইসরায়েলি অভিযানে অন্তত ৬৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও ২৪১ জন আহত হয়েছে।
গোলান মালভূমিতে রকেট হামলা
মাজদাল শামস এলাকার যে ফুটবল মাঠটিতে শনিবারের রকেট হামলায় অন্তত ১২জন নিহত হন, সেখানে এদিন গিয়েছিলেন বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা পল অ্যাডামস।
তিনি জানাচ্ছেন, ফুটবল মাঠটির মাঝখানে রকেটের আঘাত বিশাল একটি গর্ত তৈরি হয়েছে।
মাঠের চারদিকে যে বেড়া ছিল, সেগুলো বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে তখনও পড়ে ছিল ফুটবল খেলতে আসা বাচ্চাদের আগুনে ভস্মীভূত বাইকগুলো।
পল অ্যাডামস আরও জানান, হামলার ঠিক আগে সাইরেন বেজেছিল ঠিকই – কিন্তু এত দ্রুত রকেটটি এসে আঘাত হানে যে কেউ মাঠ ছেড়ে পালানোরই সময় পায়নি।
এদিকে রকেট হামলায় নিহত ১২ জনের মধ্যে ১১ জনের নাম এদিন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় দ্রুজ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এরা সবাই ছিল ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশু বা কিশোর, এবং দ্রুজ সম্প্রদায়ের সদস্য।
এছাড়া নাথেম ফখির সায়িব নামে নিকটবর্তী এইন কিনিয়া গ্রামের একজন বাসিন্দাও ওই হামলায় নিহত হন বলে জানা যাচ্ছে।
রবিবার এই নিহতদের জানাজা উপলক্ষে দ্রুজ সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন।
‘দ্য টাইমস অব ইসরায়েল’ পত্রিকা জানাচ্ছে, শেষকৃত্যে অংশ নিতে ইসরায়েলের যে মন্ত্রীরা গোলান মালভূমিতে গিয়েছিলেন তাদের উপস্থিত জনতার তীব্র ক্ষোভ ও রোষের মুখে পড়তে হয়।
ইসরায়েলি মন্ত্রী নির বারকাত ও ইডিট সিলমানকে লক্ষ্য করে একজন ব্যক্তি বলে ওঠেন, “আপনাদের কোনও লজ্জা আছে? একটা ছেলে ফুটবল খেলতে গিয়ে আর ফিরে এল না, ভাবা যায়?”
সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ এই বক্তব্যে সায় দিয়ে চিৎকার করে ওঠেন।
দ্রুজ সম্প্রদায়ের প্রথাগত ও সাবেকি পোশাক পরে পুরুষরা কাঁদতে কাঁদতে সাদা কাপড়ে মোড়া নিহতদের শবাধার বহন করে মাজদাল শামসের রাস্তা ধরে এগিয়ে যান।
বহু দ্রুজ নারীও কালো ‘আবায়া’ পরে এসে নিহতদের শবাধারে ফুল দিয়ে তাদের শেষ বিদায় জানান।
ইসরায়েল ও আমেরিকার অবস্থান
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে তার আমেরিকা সফর সেরে দেশে ফিরে এসেছেন।
তার কার্যালয় একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেই নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন এবং ‘সিকিওরিটি ক্যাবিনেটে’র (নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা) সঙ্গে বৈঠকে বসছেন।
আমেরিকায় থাকাকালীন মি নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিস এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন।
গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি হয়ে থাকা সাতজন মার্কিন নাগরিকের পরিবারগুলোর সঙ্গেও মি নেতানিয়াহু এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।
গোলান মালভূমিতে রকেট হামলার পর পরিই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হেজবুল্লাহ-কে লক্ষ্য করে হুঁশিয়ারি দেন, “এর জন্য তাদের খুব চড়া মূল্য চোকাতে হবে।”
এর কয়েক ঘন্টা পরেই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, তারা লেবাননের ভেতরে ‘জঙ্গী নিশানা’য় আঘাত হেনেছে।
রাতে চালানো ওই হামলায় ‘জঙ্গীদের অস্ত্রভান্ডার ও অবকাঠামো’গুলো তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল বলেও জানানো হয়।
এদিকে এই মুহুর্তে জাপান সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন টোকিও থেকে জানিয়েছেন, তারা পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন।
তিনি সেই সঙ্গেই বলেন, “ইসরায়েলের অবশ্যই তাদের নাগরিকদের রক্ষা করার অধিকার আছে এবং সেটা যাতে তারা করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকাও অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
কিন্তু আমেরিকা চায় সংঘাত যাতে আরও বৃদ্ধি না পায় – এটাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
“আমরা কখনও চাই না এই সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ুক। একেবারে প্রথম দিন থেকে, অর্থাৎ সেই ৭ অক্টোবর থেকেই এটা কিন্তু আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য”, বলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে গোলান মালভূমিতে শনিবারের রকেট হামলা যে হেজবুল্লাহ-রই কাজ, তার ‘সব প্রমাণ’ই আছে বলে দাবি করেন অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। যদিও এই অভিযোগ হেজবুল্লাহ-র পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
কতটা শক্তিশালী হেজবুল্লাহ?
ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ-র মধ্যেকার সংঘাত যদি শেষ পর্যন্ত পুরোদস্তুর যুদ্ধের দিকে গড়ায়, সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে দেখে নেওয়া যেতে পারে তাদের সামরিক শক্তি আসলে ঠিক কতটা!
কোনও দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয়েও বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত সামরিক শক্তিগুলোর অন্যতম হল হেজবুল্লাহ। বস্তুত এরকম বাহিনীগুলোর মধ্যে তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী, এবং তাদের টাকাপয়সা ও অস্ত্রশস্ত্র জোগায় ইরান।
হেজবুল্লাহ-র প্রধান শেখ হাসান নাসরুল্লাহ-র দাবি অনুযায়ী তাদের প্রায় এক লক্ষ যোদ্ধা আছেন। যদিও বিভিন্ন নিরপেক্ষ সূত্রে এই সংখ্যাটা ২০ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে বলেও বলা হয়।
হেজবুল্লাহ-র এই সদস্যরা সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও আছে। এদের অনেকেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও লড়াই করেছেন।
স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হিসেব অনুযায়ী, হেজবুল্লাহ-র কাছে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার রকেট ও মিসাইল আছে। তাদের এই অস্ত্রভান্ডারের বেশিটাই হল ছোট আকারের, আনগাইডেড ভূমি-থেকে-ভূমি আর্টিলারি রকেট।
তবে হেজবুল্লাহ-র সম্ভারে বিমান ও রণতরী-বিধ্বংসী মিসাইল আছে বলেও ধারণা করা হয়। তা ছাড়া বেশ কিছু ‘গাইডেড’ মিসাইলও আছে, যেগুলো ইসরায়েলের অনেক ভেতরে গিয়েও আঘাত হানতে সক্ষম।
গাজা ভূখন্ডে হামাসের হাতে যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আছে, তার তুলনায় হেজবুল্লাহ-র এই অস্ত্রভাণ্ডার অনেক বেশি আধুনিক ও বিধ্বংসী।
শিয়া মুসলিম এই সংগঠনটি লেবাননে রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তারা সে দেশের সেনাবাহিনীর চেয়েও অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী শিয়া শক্তি ইরানের মদতে ইসরায়েলের বিরোধিতার লক্ষ্য নিয়েই ১৯৮০র দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হেজবুল্লাহ।
বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে হেজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে খুব শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে এবং বিতর্কিত সীমান্ত এলাকাগুলোতে ইসরায়েলের উপস্থিতির বিরোধিতা করে আসছে।