‘উপরের নির্দেশ’ টার্মটি আইনের শাসনের পরিপন্থী
“উপরের নির্দেশ” টার্মটি বাংলাদেশে খুবই পরিচিত ও প্রচলিত। নাগরিকদের তাদের আইনি, যৌক্তিক, মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার পেতে, বলবৎ করতে বা উপভোগ করতে সরকারি অফিসে যেতে হয়। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা নাগরিকদের এই প্রাপ্য অধিকারটুকু কোনো কারণ না দিয়ে বা না দেখিয়ে তাদের বঞ্চিত করেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলা হয় “উপরের নির্দেশ”। এই “উপরের নির্দেশ” অজুহাতটা ব্যবহার করা হতে পারে যে কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে, তবে বাংলাদেশের আর্ত-সামাজিক বাস্তবতায় এটি প্রধানত: সরকার বিরোধী বলয়ের ব্যক্তি, দল, গ্রোপ, জোট ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রায়শই ব্যবহার করতে দেখা যায়। এটা নি:সন্দেহে আইনের ব্যত্যয়, সংবিধানের লঙ্ঘন।
প্রায় সময় গণমাধ্যমে দেখা যায় যে, দেশের নাগরিক, বিশেষ করে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেশের বাহিরে যেতে এয়ারপোর্টে বাধা দেয়া হয় বা অযথা আটকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে এরপর যেতে দেয়া হয়। এমনটি করার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় “উপরের নির্দেশ”। এটা সম্পূর্ন বেআইনি ও অসাংবিধানিক। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে পরিস্কার করে বলা আছে “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
পাঠকরা লক্ষ্য করবেন, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ শুধু দেশের ভিতর অবাধ চলাফেরার অধিকারই দেয়নি বরং দেশত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশের সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছে।
অনুরূপভাবে অনেক সময় সমাবেশে, মিটিং ও মিছিলের ক্ষেত্রেও বাধা দেয়া হয়, এমনকি বাধা দেয়া হয় মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচিতেও। কারণ জিজ্ঞেস করলে জবাব আসে “উপরের নির্দেশ”।
চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, চালানো হয় মামলা-হামলা করে স্তব্ধ করার প্রয়াস। কারণ জানতে চাইলে একইভাবে উত্তর আসে “উপরের নির্দেশ”। অথচ সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের সমাবেশে, মিটিং ও মিছিল করার অধিকার দিয়েছে। ঠিক একইভাবে ৩৯ অনুচ্ছেদ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এ দুটি অনুচ্ছেদে দেয়া অধিকারে যদি নিতান্ত বাধানিষেধ দিতেই হয় তবে এই দুটি অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা দিতে হবে জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে ও আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত উপায়ে। “উপরের নির্দেশ” বলে চালিয়ে যাওয়ার কোনো স্কোপ সংবিধানে রাখা হয়নি।
আটক ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও অনেক সময় একই জিনিস দেখা যায়। কোনো কারণ না দেখিয়ে বলা হয় “উপরের নির্দেশ”। গভীর রাতে উপযুক্ত কারণ না দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়, আটক করা হয় জেলগেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হওয়ার সময়। অথচ সংবিধান একজন নাগরিককে গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে বেশ কিছু সেইফগার্ড তথা রক্ষাকবজ দিয়েছে। সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীগগিরই গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।”
অনেক সময় আটক বা গ্রেপ্তার করে তা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্বীকারই করা হয় না। অথচ সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আটক ও গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হাজির করার কথা।
আইনের শাসনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে: আইনের চোখে সবাই সমান, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, সবার সাথে আইনানুগ ব্যবহার করা হবে, সবকিছু আইন ও বিধি মোতাবেক চলবে। বস্তুত, in accordance with law (আইনানুযায়ী বা আইনানুসারে) সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৪ অনুচ্ছেদসহ বহু জায়গায় বলা হয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে reasonable restrictions imposed by law (আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধানিষেধ) সংবিধানের ৩৮, ৪০ এবং ৪২ অনুচ্ছেদসহ বহুস্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই কোনো নাগরিকের অধিকার নাকচ বা তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো যথাযথ আইন সঙ্গত কারণ না দিয়ে বা না বলে যখন “উপরের নির্দেশ” বলে চালিয়ে দেয়া হয় তখন বস্তুত: আইনের শাসনের সাথে উপহাস করা হয় যা প্রকারান্তরে আইন ও সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল।
পাবলিক অথরিটি তথা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সিদ্ধান্তে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ ও ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় তিনি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে চ্যালেঞ্জ করে এর প্রতিকার চাইতে পারেন। সিদ্ধান্তের কোনো কারণ না দিয়ে বা না দেখিয়ে শুধু “উপরের নির্দেশ” বলে সরকারি কর্মকর্তারা বা প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়ে দিলে তখন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকার চাইবেন কিসের ভিত্তিতে এবং কিভাবে? তখন অবস্থা দাঁড়াবে এমন যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ নয় বরং সিদ্ধান্তের কারণ না দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে অর্থাৎ আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার বলবৎ করার পথে অতিরিক্ত একটি লেয়ার বা টিয়ার (ধাপ) বসিয়ে দেয়া হলো।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে তাদের সংবিধান, আইন বা উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সরকারি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণ দেয়াকে নিশ্চিত বা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে “Everyone whose rights have been adversely affected by administrative action has the right to be given written reasons”. (অর্থাৎ “প্রশাসনিক পদক্ষেপের দ্বারা যাদের অধিকার বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়েছে তাদের লিখিত কারণ জানানোর অধিকার রয়েছে”)। অস্ট্রেলিয়ায় The Administrative Decisions (Judicial Review) Act 1977 সরকারি কোনো সংস্থা তার সিদ্ধান্তের কারণ না দিলে এটাকে জুডিশিয়াল রিভিউর অন্যতম একটি গ্রাউন্ড হিসেবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছে। ফান্সের ১৯৭৯ সালের ১১ জুলাইতে পাস হওয়া Statue এর Article 1 এ বলা হয়েছে “Natural and legal persons have a right to be informed without delay of the reasons of unfavourable individual administrative decisions relating to them” (অর্থাৎ “প্রাকৃতিক এবং আইনি ব্যক্তিদের তাদের সাথে সম্পর্কিত প্রতিকূল ব্যক্তিগত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে বিলম্ব না করে অবহিত করার অধিকার রয়েছে”)। ১৯৭১ সালের Breen V AEU কেইসে গত শতাব্দির সাড়া জাগানো বৃটিশ বিচারপতি লর্ড ডেনিং সরকারি প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের কারণ দেয়াকে “one of the fundamentals of good administration” (অর্থাৎ “সুশাসনের অন্যতম মৌলিক বিষয়”) বলে অভিহিত করেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা, কর্তব্যপরায়ণতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিতকরণেও তাদের সিদ্ধান্তের যথাযথ কারণ দেয়া অত্যাবশ্যকীয়। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় কালের বিবর্তনে নাগরিকের অধিকার বলবৎ ও সুবিচার নিশ্চিত করণে বেশ কিছু অনুসরণীয় ডক্ট্রিন, নিয়ম ও নীতি ডিভেলাপ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: due process (যথাযথ প্রক্রিয়া), procedural ultra vires (পদ্ধতিগত ভুল), unfettered discretion (নিরঙ্কুশ বিচক্ষণতা), fairness (ন্যায়পরায়ণতা), conflict of interest (স্বার্থের দ্বন্ধ), irrelevant consideration (অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা) ও unreasonableness (অযৌক্তিকতা)। নাগরিকের আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণ হিসেব “উপরের নির্দেশ” টার্মটি এই সব কনসেপ্টে, নিয়ম, নীতি ও ডক্ট্রিনের সাথে সাংঘর্ষিক।
Public safety (জননিরাপত্তা), national security (জাতীয় নিরাপত্তা) ও public health (জনস্বাস্থ) এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় ছাড়া বৃটেনে মোটামুটি সব পাবলিক অথরিটিগুলো তাদের সিদ্ধান্তের যথাযথ কারণ দিয়ে থাকে। যদিও Common Law’তে general duty to give reason নাই, কিন্তু Statutes এবং উচ্চ আদালত পাবলিক অথরিটিগুলোকে তাদের সিদ্ধান্তের যথাসম্ভব কারণ দেয়ার বাধ্যবাধকতার আওতায় নিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্তের যথাযথ কারণ দেয়া সরকারি কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিত করে, রোধ করে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দূর্নীতির সম্ভাব্য পথগুলো। তাছাড়া সিদ্ধান্তের যথাযথ কারণ দেয়ার পদ্ধতির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সততা যাচাই-বাছাই এবং তাদের সুপারভিশন, তদারকি ও মনিটর করাও সহজ হয়।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, লেখক, বিশ্লেষক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার