একজন মশাহিদ আলীর কথা
আমি সব সময়ই বলি পৃথিবীর ‘অষ্টম অত্যাশ্চর্য’ (!) দেখতে হলে মশাহিদকে দেখুন ! মশাহিদ শুধু একটি নাম নয়, একটি জীবন্ত ইতিহাস। তীব্র স্রোতের বিপরীতে লড়ে টিকে থাকা, সংগ্রাম করে যাওয়া আর অভীষ্ঠ লক্ষ্যের পানে ছুটে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টারত নাবিকের নাম মশাহিদ !
পুরো নাম মশাহিদ আলী।লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বাংলা সংলাপ’-এর মালিক এবং সম্পাদক ।দীর্ঘ ১০বছর যাবত তিনি পত্রিকাটির প্রকাশনা রেখেছেন অব্যাহত। বলা যায় তিনি একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একটি ‘জীবন্ত লাশ’ । ‘জীবন্ত লাশ’ বলার কারণ হচ্ছে পত্রিকা প্রকাশনা মানে সম্পূর্ণ অলাভজনক এবং অনুৎপাদনশীল একটি খাত, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মতো স্থানে। পত্রিকার আর্থিক যোগান দেয় মূলত বিজ্ঞাপন। বাঙালী কমিউনিটির মধ্যে এখনো সেই পরিমান বৃহদাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি কিংবা যতটুকু আছে সেখান থেকেও পর্যাপ্ত সাপোর্ট পাওয়া যায় না।আর্থিক দৈন্যতার কারণে লন্ডনে অসংখ্য বাংলা পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে; আর যে ক’টি টিকে আছে তন্মধ্যে দু’একটি ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থাও অনেকটা শোচনীয়।
নিকট অতীতে দেখা গেছে বহু রথী মহারথীদের নিয়ে অনেকেই মিডিয়া জগতে এসে বিফল হয়েছেন।অনেক মাল্টি মিলিয়নিয়ারও টিকে থাকতে পারেননি; সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যায় মশাহিদ আলী। একদম শুন্য হাতে চরম দু:সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে পত্রিকা প্রকাশনার মতো একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছিলেন এবং এখনো টিকে আছেন ।তার এই ‘অস্বাভাবিক’ তৎপরতা দেখে অনেকে নেতিবাচক কথা বলেছেন, উপহাস-পরিহাস করেছেন ! অনেকে বলেছেন, ‘কত সম্পদশালী ব্যক্তি যেখানে টি কতে পারেননি, সেখানে মাত্র ক’মাস আগে (পত্রিকা শুরুর লগ্নের কথা) দেশ থেকে স্টুডেন্ট হয়ে আসা একজন আনকোরা এবং নি:স্ব সংবাদকর্মী কিভাবে পত্রিকা চালাবেন, তা নিছক পাগলামি ছাড়া কিছু নয় !’ মশাহিদ এসব ‘পাছে লোকে কিছু বলা’ সম্প্রদায়ের অভিব্যক্তি আর বিরূপ মনোভাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বীরদর্পে ছুটে চলেছেন। ‘বাংলা সংলাপ’-এর একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। বিজ্ঞাপনটিতে একটি ধাবমান ঘোড়া ছুটে চলার দৃশ্য রয়েছে। এই ধাবমান ঘোড়ার মতো যেন মশাহিদ ছুটে চলেছেন সব বাধা ডিঙিয়ে !
২০১০ সালে মশাহিদ যখন ‘বাংলা সংলাপ’-এর যাত্রা শুরু করেন তখন তার সহযোগি যারা ছিলেন, তারা একে একে চলে গেছেন। দীর্ঘদিন যে দু’ একজন টিকে ছিলেন, তারা সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন; একটা সময় নানাবিধ কারণে তারাও সরে যান,কিন্তু মশাহিদ হাল ছাড়েননি।একাই চালাতে থাকেন ‘বাংলা সংলাপ’। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’- রবীন্দ্র সঙ্গীতের এ কলিকে আলিঙ্গন করে যেন চলতে লাগলেন তিনি।
বিগত দিনগুলোতে ব্যাপক আর্থিক সংকটে হাবুডুবু খেতে থাকলেও মশাহিদ দমেননি কখনো।খেয়ে- না খেয়ে ধারকর্জ করেও পত্রিকাটির কাজ চালিয়ে গেছেন। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নানা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পার করিয়ে দিয়েছেন এক যুগ অর্থাৎ পুরো ১০ বছর। আজ ‘বাংলা সংলাপ’ পদার্পন করেছে গৌরবের এগারো বছরে।
মশাহিদের সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিলো সপ্তাহে যেদিন পত্রিকা প্রকাশ হবে তার আগের দিন। অর্থাৎ পত্রিকা ছাপানোর খরচপাতি যোগাড় করা। এমনও দেখা গেছে তার হাতে একটি পাউন্ডও থাকতো না, তখন পরিচিত অনেকের ধারস্থ হতেন। ঋণের জন্য আকুতি মিনতিতে কেউ সাড়া দিতেন, কেউ দিতেন না।অবশ্য তিনি দৌড়ঝাঁপ করে খরচ যোগাড় করতে সক্ষম হতেন। প্রায়ই এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে।
পত্রিকাটির জন্য মশাহিদ অমানুষিক কষ্ট করেছেন।অবশেষে জয়ী হয়েছেন।বর্তমানে তিনি মেইনস্ট্রীমের অনেক বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকেন।ছোট অফিস থেকে বড় অফিস হয়েছে ‘বাংলা সংলাপ’-এর। সবই মশাহিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অনেক আত্মীয় পরিজনের দোয়ার ফসল বলা যায়।এখন আর পত্রিকার জন্য ধারকর্জ করতে হয় না।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় এমনও দিন গেছে তার পকেট থাকতো একদম শুন্য। অনেকদিন না খেয়ে থেকেছেন কিংবা সামান্য চিপস বা টমেটো স্যুপ খেয়ে দিনাতিপাত করেছেন।আর্থিক সংকটের মহা দুর্দিনেও তিনি পত্রিকা প্রকাশনার পাশাপাশি মানবিক কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন, যা শুনলে বিস্মিত হতে হয় ! কয়েক বছর যাবত কিডনী রোগে আক্রান্ত পিতা-মাতাহীন তার আপন এক ভাগ্নির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে চলেছেন। দেশে অবস্থানকারী এতিম ভাগ্নির অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা তিনি সম্পূর্ণ এককভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও নিজ এলাকা বালাগঞ্জের বিভিন্ন অসহায় দারিদ্র পরিবারের মধ্যে নিয়মিত খাদ্য সামগ্রী, বস্র ও নগদ আর্থিক সাহায্য
প্রদান করে আসছেন । সম্প্রতি তিনি নিজ এলাকায় একটি মহিলা মাদ্রাসায় ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন, তাছাড়া হবিগঞ্জের একটি হাফিজি মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছেন । অর্থাৎ পত্রিকার পাশাপাশি মশাহিদ সমাজ সেবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায় ,যদিও তিনি এসব কাজের প্রচারবিমুখ।
নম্র ভদ্র স্বভাবের মশাহিদের অন্যতম গুণ হচ্ছে মানুষকে সম্মান দেয়া। অতিথি পরায়ণ হিসেবেও তার যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি আপাদমস্তক একজন প্রকৃত সংবাদপত্রসেবী। ঘুমানোর আগ পর্য়ন্ত তিনি পত্রিকার কাজে সম্পৃক্ত থাকেন, এমনকি পত্রিকার গ্যাট-আপ,ম্যাক-আপ, সম্পাদনা সবই করেন নিজ হাতে। অর্থাৎ তার ধ্যান-জ্ঞান সবই কেবল ‘বাংলা সংলাপ’কে ঘিরে।কোন শ্রম যে বৃথা যায় না,মশাহিদের বদলে যাওয়া জীবনই তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত !
অসংখ্য মানুষের দোয়ায় এবং আল্লাহর অশেষ কৃপায় মশাহিদ আজ অনেকটা স্বাবলম্বি হয়ে গেছেন।ইতোমধ্যে তিনি ব্রিটিশ সিটিজেনশীপও লাভ করেছেন।ইস্ট লন্ডনের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা তথা হোয়াইটচ্যাপেল ট্রেন স্টেশনের অদূরে, ইস্ট লন্ডন মসজিদের সন্নিকটে এবং নিউরোড-এর মুখে ‘বাংলা সংলাপ’-এর বিশালাকৃতির ঝলমলে সাইনবোর্ডই জানান দিচ্ছে মশাহিদ আলীর বদলে যাওয়া জীবনের কথা, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা। দৃঢ়তার সাথে মশাহিদ বলেছেন, ‘তিনি বহুদূর এগিয়ে যেতে চান।’ আমারও বিশ্বাস, তিনি তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে সমর্থ হবেন একদিন, সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়।অনুজপ্রতিম মশাহিদের আকাংখা পূর্ণতা পাক এবং ‘বাংলা সংলাপ’ এগিয়ে যাক দ্রুতগতিতে – সে কামনা রইলো।