এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে ফিরতে পারেন আরব আমিরাতে সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশিরা
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন বাংলাদেশির সবাইকে এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ করা আইনজীবী ওলোরা আফরিন।
কারাগার থেকে তাদের মুক্তি দিতে দেশটির আদালত ইতোমধ্যেই আদেশ জারি করেছে বলেও তিনি জানান।
“আমরা আগেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম। আজকে কোর্টে একই আদেশে তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,” মঙ্গলবার বিকেলে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিজ আফরিন।
“কাজেই আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই উনাদেরকে বের করে দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে আমরা আশা করছি। হয়তো দু-একদিন কম-বেশি হতে পারে,” বলেন তিনি।
এর আগে, মঙ্গলবার সকালে কারাগারে বন্দী ওই ৫৭ জন বাংলাদেশির সবার সাজা মওকুফ করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহামেদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
বিষয়টি দুপুরে সাংবাদিকদের জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
“সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে আজ দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ক্ষমা করেছেন,” সাংবাদিকদের বলেন মি. ইউনূস।
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করায় গত ২৮শে অগাস্ট প্রধান উপদেষ্টাকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মি. নাহিয়ান। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের মুক্তি দিতে তখন অনুরোধ জানিয়েছিলেন মি. ইউনূস।
এক সপ্তাহের মাথায় সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা আসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এছাড়া অন্য দেশে গিয়ে বাংলাদেশিরা যেন আইন ভঙ্গ না করে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, ক্ষমা পেলেও ওই বাংলাদেশিদের কেউই আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকতে পারবেন না বলে দুবাইভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সে কারণেই যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে ইউএই সরকার।
১৫ জনের তথ্য নেই
সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাগারে বন্দী ৫৭ জন বাংলাদেশির সবার সব তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন আইনজীবী ওলোরা আফরিন।
“আবুধাবি, দুবাই, শারজাহসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমরা এখন পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্তদের ৪২ জনের তালিকা পেয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ আফরিন।
তথ্যগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ও আরব আমিরাতের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া বাকি ১৫ জনের নাম, ঠিকানা, কর্মস্থল ও পরিবার-পরিজন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে।
“তবে এখন যেহেতু মুক্তি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেজন্য সবাইকে একসঙ্গে বের করা যাবে, সমস্যা হবে না,” বলেন মিজ আফরিন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ই জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হন।
এ ঘটনার প্রতিবাদ ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৯শে জুলাই বিক্ষোভ মিছিল বের করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাজ করতে যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
পরে তাদের মধ্যে ৫৭ জনকে আটক করে দেশটির পুলিশ।
দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার অভিযোগে পরবর্তীতে তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের আদালত।
তখন তাদের মুক্তির ব্যাপারে আবুধাবিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানা যায়নি।
কিন্তু পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ওই প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
আবুধাবির ফেডারেল কোর্ট অব আপিলের মাধ্যমে তাদেরকে মুক্ত করতে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসকে বিনা খরচে আইনি সহায়তা প্রদানের নির্দেশা দেওয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ই অগাস্ট আইনজীবী ওলোরা আফরিন নিয়োগ দেয় দূতাবাস।
এ ঘটনার তিন সপ্তাহের মাথায় দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের দণ্ড মওকুফের খবর আসলো।
ফেরত পাঠানোর আদেশ জারি
ক্ষমাপ্রাপ্ত ৫৭ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে ইতোমধ্যেই আদেশ জারি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার।
দুবাইভিত্তিক সংবাদমাধ্যম খালিজ টাইমস তাদের খবরে বলছে, প্রেসিডেন্ট মি. নাহিয়ানের পক্ষ থেকে দণ্ড মওকুফের ঘোষণা আসার পর ওই বাংলাদেশি নাগরিকদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে আদেশ জারি করেছেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল চ্যান্সেলর ড. হামাদ আল শামসি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসকারী সবাইকে দেশটির আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন মি. শামসি।
নিজেদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও যেন রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ না হয় এবং জনগণের ক্ষতি না হয়, সেবিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইউএই’র অ্যাটর্নি জেনারেল।
এদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইনের প্রতি বাংলাদেশের নাগরিকদের পূর্ণ সম্মান রয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট মি. নাহিয়ানকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মি. ইউনূস।
তারপরও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যেকোনো দেশে নাগরিকদের পাঠানো আগে তাদেরকে সেদেশের স্থানীয় আইন সম্পর্কে জানানো হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি।
যে কারণে জেল হয়েছিল
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইন অনুযায়ী, দেশটিতে বিক্ষোভ করা অবৈধ।
মূলত সে কারণে গত ১৯শে জুলাই বাংলাদেশি প্রবাসীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে ৫৭ জনকে আটক করে দেশটির পুলিশ।
ইউএই’র রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম এমিরেটস নিউজ এজেন্সি (ওয়াম) তখন জানিয়েছিল, আটক বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, তারা “বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন রাস্তায় বড় আকারের মিছিল সংগঠিত করেছিল”।
এর ফলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। সেইসঙ্গে, আইন প্রয়োগের কাজে বাধা এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি হুমকীর মুখে ফেলার অভিযোগও তোলা হয়।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছিলেন যে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সতর্ক করেছিল এবং সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্তরা পুলিশের আহ্বানে সাড়া দেননি।
অন্যদিকে, আদালত অভিযুক্তদের পক্ষে যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল, তিনি শুনানিতে বলেছিলেন যে, বিক্ষোভ মিছিল করলেও আটককৃত ব্যক্তিদের কোনো ‘অপরাধমূলক’ উদ্দেশ্য ছিলো না।
এছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত তথ্য-প্রমাণ নেই বলেও বলেছিলেন তিনি।
উভয়পক্ষে বক্তব্য শোনার পর আটক হওয়া ৫৭ জন বাংলাদেশিকে আইন ভঙ্গের দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত।
তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ৫৩ জনকে দশ বছর করে এবং একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ ঘোষণা করেন বিচারক।