কতিপয় চেনা মানুষের গল্প
আহমেদ শামীম
জীবন মানেই সংগ্রাম। সংগ্রামবিহীন জীবনে আনন্দ বেদনার মিশেল খুব কমই লক্ষ্যনীয়।এতে মাধুর্য্যমন্ডিত হয় না জীবনের সোপান।সংগ্রামমুখর জীবন এগিয়ে যায় নদীর মতো।নদীর এপার ভাঙ্গা,ওপার গড়ার মতো নানা বৈচিত্র্যে প্রবাহমান থাকে সংগ্রামীদের পথচলা । বিদেশ বিভুঁইয়ে যারা থাকেন তাদের সংগ্রাম করতে হয় নিরন্তর। কতিপয় চেনাজানা মানুষের জীবনের গল্প শোনাতে চাই, যারা বিরামহীন সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত। তাদের কথা ক’জনই জানি বা বুঝি। আসলে জানার ফুরসতই বা কই। প্রত্যেকেই তো আমরা বেছে নিয়েছি কঠিন সংগ্রামের কন্টকাকীর্ণ পথ।একেক জনের লড়াই একেক রকম। কেউ লড়ছে টিকে থাকতে,কেউ লড়ছে নিজে বাঁচতে,কেউবা লড়ছে ফ্যামেলি বাঁচাতে। বেশিরভাগ ভাগ আবার দেশে ফেলা আসা স্বজনদের জন্য লড়ছে। বিদেশ যেন লড়াইর কুরুক্ষেত্র । দেশ মাতৃকা স্বজন ফেলে দূর প্রবাসে প্রতিটি জীবন কঠিন সংগ্রামের মুেেখ দাঁড়িয়ে আছে। প্রানান্তকর লড়াইর মধ্যে যেন বেঁচে থাকা।অন্তহীন এ লড়াইর শেষ কোথায় -তা জানা নেই কারো।এবার শুরু করি গল্প বলা।
১.প্রথমেই আলোকপাত করি একজন নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীকে দিয়ে। অনুজ সাংবাদিক মোঃ মোশাহিদ আলী। যিনি ‘বাংলা সংলাপ’ পত্রিকার সম্পাদক। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা কারে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশ করে চলেছেন । প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ব্যবসায়িক পজিশন হিসেব করলে বিলেতে বাঙ্গালীদের অবস্থান খুববেশি বিস্তৃত নয়। যেহেতু মিডিয়া প্রকাশনার সাথে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক ওঁতোপ্রতোভাবে জড়িত। বিলেতে বর্তমানে ৬টি বাংলা টেলিভিশন এবং ১৫/১৬টি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব মিডিয়া চালু রাখতে গিয়ে প্রতিটি কর্তৃপক্ষই হিমশিম খাচ্ছেন চরমভাবে।তবে বেশিরভাগ মিডিয়ার সাপোর্টে রয়েছে নানান উৎস।কিন্তু যাদের সাপোর্টের জায়গা একেবারে সীমিত,তাদের তো মাঝ দরিয়ায় ডিঙি নিয়ে হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস,এদের দলে শীর্ষে থাকবেন মোশাহিদ আলী।যেহেতু তার একমাত্র পেশা-নেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। দিনের বেশিভাগ সময় থাকেন পত্রিকা অফিসে।কখনো সংবাদ অন্বেষন;কখনো অফিসভাড়া যোগাড় করা,আর সবচেয়ে কঠিন কাজ করেন পত্রিকা প্রকাশের দিন।একদিকে নিউজ বাছাই,লিড নিউজ ও শিরোনাম ঠিক করা;অন্যদিকে পত্রিকা ছাপানোর অর্থ যোগাড় করা। ঐদিন অর্থের জন্য তার দৌড়ঝাঁপ এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা যে কত মর্মবেদনার;তা না দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। মাঝেমধ্যে অর্থ যোগাতে ব্যর্থ হওয়ায় পত্রিকা প্রকাশনায় ব্যত্যয় ঘটে।তবু তিনি দমে থাকেন না। শত প্রতিকূলতা সত্বেও পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে। শুভাকাঙ্খী আর শুভানুধ্যায়ীদের নানা পরামর্শ-উপদেশ,আহবান সত্বেও অন্য পেশা গ্রহণে তার চরম অনীহা। অক্লান্ত চেষ্টা-পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন তার প্রাণপ্রিয় পত্রিকা ‘বাংলা সংলাপ’।পত্রিকাটির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রিয় মুখপত্র হয়ে উঠবে বাংলা সংলাপ -এ প্রত্যাশা বুকে ধারণ করে কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন মোশাহিদ আলী।একদিন তিনি সাফল্যের বন্দরে ঠিকই পৌঁছবেন-এমনটা তার সমালোচকরাও বিশ্বাস করেন।
২.রফিক মিয়া। একজন ফেরিওয়ালা। রাস্তায় রাস্তায় চানাচুর,আমড়া,ঝালমুড়ি বিক্রি করেন । তাকে লন্ডনের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দেখা যায় প্রায় প্রতিদিন। বৃষ্টিবাদল কিংবা প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও তিনি এসব পন্য বিক্রি করেন। তার পরিবার থাকেন বাংলাদেশে। তিনি ৯/১০ বছর যাবৎ বিলেতে আছেন এবং ছোট ট্রলি ঠেলে ঠেলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে প্রতি মাসে ৪০/৫০ হাজার টাকা দেশে পাঠাতে হয়।দেশে তার এক ছেলে মেডিক্যাল,এক ছেলে বুয়েট আর ছোট ছেলে নটেরডেম কলেজে লেখাপড়া করছে। ছেলেরা ভাল রেজাল্ট করছে। তিনি মহাখুশি।ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে,সুপ্রতিষ্ঠিত হবে,পরিবারের স্বচ্ছলতা আসবে-এ আকাংখায় রফিক মিয়ার এমন নিরন্তর সংগ্রাম। রফিক মিয়ার মতো আরো অনেককে এখন বিলেতের রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে।
৩.ট্রেভেল এজেন্টে চাকরী করেন রাশেদ আহমদ। সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। দেশে ভাল পজিশনে ছিলেন। ভাগ্যের ফেরে আর পাউন্ডের টানে বিলেত এসেছিলেন।সুখের সংসার ছিলো। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে একদিন তার স্ত্রী গিয়ে আটকা পড়েন শ্বশুরালয়ে। সেখান থেকে স্ত্রী বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠান তাকে। মাঝেমধ্যে সন্তানদের দেখার অনুমতি ছিল, ইদানিং তাও নেই। সংসার,স্ত্রী-ছেলেমেয়ে হারিয়ে তিনি সন্ন্াসীর মতো জীবনযাপন করেন।চিন্তা-টেনশনে চাকরী বাদ দিয়ে মাঝে মাঝে উ™£ান্তের মতো ঘুরে বেড়ান। অসংখ্য রাশেদ আহমদ আছেন বিলেতে; যাদের গোছানো সংসার তাসেরঘরের মতো খানখান হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়।
৪.ছানু মিয়া। রেস্টুরেন্টে সেফ-এর কাজ করেন। ১৩/১৪ বছর যাবৎ আছেন বিলেতে। পরিবারের বড় ছেলে। ইতিমধ্যে তার ছোট দুই ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। ছোট এক ভাই ও দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। অথচ নিজে বিয়ে করতে পারেননি। বয়স চল্লিশের কোটা অতিক্রম করেছে। লিগ্যালিটির জন্য অপেক্ষায় আছেন। সলিসিটর আর হোম অফিসের দিকে চেয়ে দিন কাটান। পারমিশন না থাকায় লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করেন।যদি ধরা পড়েন এতাদিনের সব কষ্ট ত্যাগ বৃথা যাবে। হাজার হাজার ভাগ্যবিড়ম্বিত ছানু বছরের পর বছর ধরে পড়ে রয়েছেন বিলেতের মাটিতে।
এমন অসংখ্য লড়াকু মানুষের জীবনের গল্প আপনার-আমার জানা। আমার এক বন্ধু আছেন,যিনি রেস্টুরেন্টের গাবনার (মালিক)। তিনি প্রায়ই বলেন- ‘রেস্টুরেন্টে যারা কাজ করেন, তাদের মায়েরা যদি দেখেন, তাদের ছেলেরা এমন অমানুষিক পরিশ্রম করছে, তাহলে তাদের মুখে ভাত ঢুকবে না।’
প্রবাসী সংগ্রামী মানুষের জীবনের সঙ্গী কেবল উপহাস আর ভাগ্য বিড়ম্বনা।। সুখ আহলাদ বলতে তাদের কিছু নেই।দেশ- সমাজ-সংসার নেই তাদের।তারা শুধু ঘাম ঝরান। কষ্টে কাটান দিনরাত্রী।। কামাই করেন অর্থ।এদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করেন স্বজনরা। নিজের শ্রম ঘামে উপার্জিত অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারেন না বেশিরভাগ প্রবাসী। তারা অন্যের জন্য জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়ে একদিন শুন্য রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যান। নিজের কাছে আবির্ভূত হন ‘পরাজিত সৈনিক’ হিসেবে। তাদের জীবনভর ত্যাগ স্বীকারকে ক’জনই বা বুঝে বা মূল্য দেয় !