করোনাভাইরাস মহামারীর পর আসছে ভয়াবহ বিশ্বমন্দা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ এবছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আপনি কী করছিলেন? মনে পড়ছে ? নতুন এক বছর তখন মাত্র শুরু হয়েছে। আপনার হয়তো এই নতুন বছরের জন্য ছিল অনেক পরিকল্পনা। অনেক স্বপ্ন। অনেক প্রতিজ্ঞা।
ধরা যাক জানুয়ারির সেই প্রথম সপ্তাহে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এক ফিউচারোলজিস্ট বা ভবিষ্যতদ্রষ্টার সঙ্গে আপনার দেখা হলো। তিনি আপনাকে জানালেন, ঠিক তিন মাস পর পৃথিবীর কয়েকশো কোটি মানুষ যার যার ঘরে বন্দী হয়ে থাকবে। বড় বড় নগরীগুলোকে মনে হবে প্রাণহীন মৃত্যুপুরী।
দিনের বেলাতেও রাস্তা-ঘাট থাকবে জনশূন্য। বন্ধ হয়ে যাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ থাকবে দোকানপাট-বার-রেস্টুরেন্ট-শপিং মল। বন্ধ হবে সব খেলাধূলা-এমন কি বাতিল হয়ে যাবে অলিম্পিক গেমস। জেলখানা থেকে বন্দীদের ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলা হবে।
প্রতিটি দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। বন্ধ হয়ে যাবে বিমান চলাচল। শেয়ার বাজারে বিরাট ধস নামবে। সুপারমার্কেটে লোকে টয়লেট রোল আর খাবারের প্যাকেটের জন্য মারামারি করবে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বেকার হয়ে যাবে কোটি কোটি মানুষ। এক অদৃশ্য শত্রুর আতংকে প্রতিটি মানুষ অন্য মানুষকে এড়িয়ে চলবে, অন্তত দশ হাত তফাতে থাকবে।
জানুয়ারিতে এই ভবিষ্যতবাণীকে আপনি পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতেন। এই ফিউচারোলিজস্টকে মনে হতো বদ্ধ উন্মাদ। তার কথা বিশ্বাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া হতো দুস্কর।
এবার ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে ফিরে আসা যাক এপ্রিলের ২১ তারিখে।
এই বাক্যটি যখন আপনি পড়ছেন, সেই মূহুর্তে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক, অর্থাৎ প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ তাদের ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এত বেশি সংখ্যাক মানুষ একই সময়ে, একটানা, এত দীর্ঘকাল তাদের ঘরে বন্দী থাকার নজির আর নেই। এক অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে তছনছ হয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যবস্থা।
এই অবস্থা থেকে কখন মুক্তি মিলবে তার কোন সুস্পষ্ট ধারণা কেউ দিতে পারছেন না। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে যেসব বিশেষজ্ঞ এবং ফিউচারোলজিস্ট এরই মধ্যে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন, তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত: পৃথিবী আর আগের মতো নেই। গত কয়েক মাসে যা ঘটেছে, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
এই মহামারির পর পাল্টে যাবে আমাদের কাজ-প্রাত্যহিক জীবন-ভ্রমন-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ সবকিছু।
বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে যেসব ধারণা দিচ্ছেন:
রাজনীতি: গণ-নজরদারির রাষ্ট্র
করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে গত কিছুদিন ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ইয়োভাল নোয়া হারারির বক্তব্য। তিনি মূলত একজন ইতিহাসবিদ। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘সেপিয়েন্স’।
সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এবং ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন যে , এই মহামারির পর এমন এক গণনজরদারি রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে, যেখানে সরকার প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি মূহুর্তের চলা-ফেরা শুধু নয়, তার আবেগ-অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দের খবরও জেনে যাবে।
খুব সংক্ষেপে তার ভাবনাটা এরকম: এই মহামারির সময় যেসব স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেগুলো পরে পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই পথ ধরে উত্থান ঘটতে পারে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার, যেখানে চলবে গণনজরদারি। অন্যদিকে বিশ্বায়নের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী একলা চলো নীতি অনুসরণ করবে অনেক রাষ্ট্র।
এটা শুরু হবে মহামারি মোকাবেলার নামে মানুষের চামড়ার নীচে কোন মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দিয়ে বা ট্র্যাকিং এর জন্য হাতে বেড়ি পরিয়ে। সরকার হয়তো বলবে, যারা নিয়ম ভাঙ্গবে তাদের শাস্তির জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে এটি পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে কাজে লাগবে।
৫০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২৪ কোটি মানুষের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির কোন সুযোগ কেজিবির ছিল না। কেজিবিকে নির্ভর করতে হতো তাদের এজেন্টদের ওপর। কিন্তু এখন এমন প্রযুক্তি এসে গেছে যা দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি মূহুর্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
মহামারি ঠেকানোর নামে কিছু কিছু দেশ এরই মধ্যে এরকম কাজ শুরু করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। সেখানে সব মানুষের স্মার্টফোন মনিটর করা হচ্ছে। চেহারা চিনতে পারে এরকম লাখ লাখ ক্যামেরা দিয়েও নজর রাখা হচ্ছে মানুষের ওপর।
লোকজনকে তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করতে বাধ্য করা হচ্ছে, ফলে কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত শনাক্ত করতে পারছে কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, তার সংস্পর্শে এসেছিল এমন লোকদেরও দ্রুত খুঁজে বের করা হচ্ছে।
কিন্তু পরের ধাপে এই নজরদারি চলে যেতে পারে আরও নিবিড় পর্যায়ে।
ধরা যাক কোন দেশের সরকার দাবি করলো, তাদের প্রতিটি নাগরিককে একটি বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরতে হবে। এই ব্রেসলেট প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা মানুষের হার্টবিট আর শরীরের তাপমাত্রা মনিটর করবে।
যে ডাটা এভাবে সংগৃহীত হবে সেটা চলে যাবে সরকারের বিপুল তথ্যভান্ডারে। বিশ্লেষণ করা হবে বিশেষ অ্যালগরিদম দিয়ে। কোন মানুষ নিজে জানার আগে সরকার এই অ্যালগিরদম দিয়ে জেনে যাবে কে সুস্থ আর কে অসুস্থ। শুধু তাই নয়, এই লোকটি কার কার সঙ্গে দেখা করেছে, কোথায় গিয়েছে সেসব তথ্যও। ফলে কোন সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর সাথে সাথে সেটা দমন করা যাবে।
শুনতে দারুণ লাগছে, তাই না! তাহলে সমস্যা কোথায়?
কে কোন ওয়েবসাইটে যাচ্ছে, কোন নিউজ লিংকে ক্লিক করছে, কোন ভিডিও দেখছে, সেটা দেখে তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত রুচি এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু কোন কিছু পড়ার সময় বা কোন ভিডিও দেখার সময় আমার শরীরের তাপমাত্রা, ব্লাড প্রেশার আর হার্টবিট কিভাবে ওঠানামা করছে, কী দেখে আমি হাসছি আর কী দেখে আমি কাঁদছি, বা রেগে যাচ্ছি, সেটাও যদি জানা যায়?
এটা মনে রাখা দরকার যে আমাদের জ্বর বা কাশির মতো রাগ, আনন্দ, একঘেঁয়েমি, প্রেম, ভালোবাসা- এগুলোও কিন্তু বায়োলজিক্যাল বিষয়।
যে প্রযুক্তি আমাদের কাশি শনাক্ত করতে পারে, সেটি দিয়ে আমাদের হাসিও শনাক্ত করা সম্ভব। যদি সরকার আর বড় বড় কর্পোরেশন এই বায়োমেট্রিক ডাটা গণহারে সংগ্রহ করতে শুরু করে, তাহলে আমরা নিজেদের যতটা জানি বা চিনি, এরা তার চেয়েও ভালোভাবে জানবে আমাদের।
তারা আমাদের অনুভূতি সম্পর্কে আগাম ধারণাই শুধু পাবে না, সেটাকে নিজেদের কাজে লাগার মতো করে ব্যবহার করতে পারবে। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা যা করেছিল (ডাটা হ্যাকিং), সেটাকে এর তুলনায় প্রস্তুর যুগের ব্যাপার বলে মনে হবে।
ধরুণ ২০৩০ সালে উত্তর কোরিয়া সব মানুষকে দিনরাত ২৪ ঘন্টা একটি বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরে থাকতে হচ্ছে। এখন দেশটির “গ্রেট লিডারের” বক্তৃতা শুনে যদি রাগে-ক্ষোভে কারও রক্ত গরম হয়ে যায়, সেটা কিন্তু “গ্রেট লিডারের” লোকজন জেনে যাবেন।
অর্থনীতি : ভয়াবহ বিশ্বমন্দা
করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে।
গত দুই মাসে বিশ্ব অর্থনীতিতে যা ঘটেছে সেটা এক নজরে দেখে নেয়া যাক। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চাইতেও ভয়াবহ। কেউ কেউ বলছে ১৯৩০ এর দশকে যে বিশ্ব মহামন্দার সূচনা হয়েছিল, এবারের অর্থনৈতিক সংকট সেটাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
এর আগের দুটি সংকটে শেয়ার বাজারে দর পড়ে গিয়েছিল ৫০শতাংশ, ক্রেডিট মার্কেট প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকহারে দেউলিয়া হতে শুরু করেছিল। বেকারত্ব দশ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল তিন বছর সময় ধরে।
আর করোনাভাইরাসের বিশ্ব মহামারি শুরু হওয়ার পর এবারের অর্থনৈতিক ধসটা ঘটেছে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার বিশ শতাংশ পড়তে সময় লেগেছে মাত্র ১৫দিন। এত দ্রুত আর কখনো মার্কিন শেয়ার বাজার এতটা পড়েনি। বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভ মানচিন। এর মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন কাজ হারাবেন।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির কী দশা হবে, তার ভয়ংকর সব পূর্বাভাস এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি।
আইএমএফ এর মতে, এবছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে তিন শতাংশ। যদি মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের প্রফেসর নুরিয়েল রুবিনি যে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, তা রীতিমত রক্ত হিম করা। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সাইটে প্রফেসর রুবিনি একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
তাঁর মতে, ১৯৩০ এর বিশ্ব মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও গোটা পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ এখন যেভাবে স্থবির হয়ে আছে। তার মতে, তিরিশের দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশনের’ চাইতেও ভয়ংকর এক অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে।
বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব সারে’র গবেষক সাইমন মেয়ার বলছেন, আগের অর্থনৈতিক সংকটগুলোর সঙ্গে এবারের সংকটের একটা বড় তফাৎ আছে। যখন অর্থনীতিতে এরকম সংকট তৈরি হয়, তখন সরকার নিজেই বেশি করে অর্থ খরচ করতে শুরু করে, যাতে মানুষের পকেটে টাকা যায় এবং লোকে বেশি করে জিনিসপত্র কেনা শুরু করে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়, মন্দা কাটতে শুরু করে। জন মেনার্ড কীনসের এই অর্থনৈতিক তত্ত্বের সফল প্রয়োগ অতীতে অনেক মন্দার সময় করা হয়েছে।
কিন্তু এবারের সংকটের কারণটাই হচ্ছে সরকার নিজেই সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়েছে লকডাউনের মাধ্যমে। অর্থাৎ সরকারের নীতির লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনীতিকে আপাতত নির্জীব রাখা। এর থেকে বেরুনোর উপায় তাহলে কী?
সাইমন মেয়ার বলছেন, এই সংকট মোকাবেলায় অনেক দেশের সরকার যে অর্থনৈতিক নীতি নিচ্ছেন, তাকে ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ বলা যেতে পারে।
বৃটেনে লকডাউনের সময় লোকজনকে যেন কাজ থেকে ছাঁটাই করা না হয়, সেজন্যে তাদের বেতনের আশি শতাংশ পর্যন্ত সরকার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বৃটেনের কনজারভেটিভ পার্টির সরকার এরকম একটা অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে সেটা দুই মাস আগেও ছিল অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। ইউরোপের আরও অনেক দেশের সরকার একই ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে।
লকডাউন যখন উঠে যাবে, পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হবে, তখনও অর্থনীতিতে সরকারের এই বিরাট ভূমিকা অনেকদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে।
কোন কোন অর্থনীতিবিদের মত হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ সামনের বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে।
বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক ?
কোভিড-নাইনটিন মহামারীকে বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক বলে বর্ণনা করছেন কেউ কেউ।
ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়া হারারির মতে, করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে আরেকটি বড় প্রবণতা হবে, কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান। প্রত্যেকটি রাষ্ট্র নিজেকে সুরক্ষিত করতে চাইবে অন্যের মুখের ওপর দরোজা বন্ধ করে দিয়ে।
এরই মধ্যে এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। ইতালি তো সরাসরি অভিযোগ করেছে, তার দুর্যোগের দিনে অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো পাশে দাঁড়ায়নি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং একলা চলো নীতি এই সংকটের সময় আরও স্পষ্ট হয়েছে। জার্মানির একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিনি করোনাভাইরাসের একটি টেস্ট কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিনে নেয়ার যে চেষ্টা করেছেন, সেটি ইউরোপের সঙ্গে তার সম্পর্কে আরও টানাপোড়েন তৈরি করেছে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক স্টিফেন এম ওয়াল্ট ‘ফরেন পলিসি’তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলছেন, এই মহামারি এরকম জাতীয়তাবাদকে আরও উস্কে দেবে।
“সংক্ষেপে বলতে গেলে কোভিড-নাইনটিন পরবর্তী বিশ্ব হবে আগের চেয়ে কম খোলামেলা, কম সমৃদ্ধ এবং কম স্বাধীন।”
চ্যাথাম হাউসের নির্বাহী পরিচালক রবিন নিবলেটের মত আর স্পষ্ট।
ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত লেখায় তিনি বলেছেন,“বিশ্বায়ন বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তার পরিসমাপ্তি এখানেই। করোনাভাইরাস হচ্ছে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে ধরণের বিশ্বায়ন দেখা গেছে, যাতে উভয়পক্ষই সুবিধা পেয়েছে, বিশ্ব আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে তেমন সম্ভাবনা কম।”
তবে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের কিশোর মাহবুবানি মনে করেন, বিশ্বায়ন থামবে না, এর কেন্দ্র বদলে যাবে।
“কোভিড-নাইনটিন মহামারি বিশ্বের অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটাবে না। বরং যে পরিবর্তনের সূচনা ইতোমধ্যে হয়েছে, সেটিকে ত্বরান্বিত করবে। যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের জায়গায় চীন-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দিকে ঝুঁকবে অর্থনীতি।”
কাজ-বিনোদন-ভ্রমণ
সত্তর বা আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা মনে আছে? পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে সোভিয়েত নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের খবরে বলা হতো, সেখানে সামান্য সাবান বা চিরুণী কেনার জন্যও নাকি লোকজনকে দোকানে লাইনে দাঁড়াতে হয়।
লকডাউনে প্রায় জনশূন্য লন্ডন বা ইউরোপের অন্য যে কোন শহরে যে কোন গ্রোসারি, ফার্মেসি বা খাবারের দোকানের সামনে এরকম লাইন এখন নিত্য দিনের দৃশ্য। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার এই রীতি যেন কয়েক সপ্তাহেই রপ্ত করে নিয়েছে মানুষ। কিন্তু লকডাউন যখন উঠে যাবে, তখন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন থাকুক বা উঠে যাক, আমরা যেভাবে চলি, শপিং করি, খেতে যাই, বেড়াতে যাই, কাজ করি, পড়াশোনা করি- এই সমস্ত কিছুই আমূল বদলে দিতে যাচ্ছে করোনাভাইরাস।
কিছু পরিবর্তন এরই মধ্যে ঘটে গেছে। বিশ্বের বহু মানুষ এখন ঘরে বসেই কাজ করছেন। প্রযুক্তি খুব সহজ করে দিয়েছে ব্যাপারটি। অনেক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাঠদান করছে অনলাইনে।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ একটি খাত হচ্ছে বিমান চলাচল এবং পর্যটন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং করোনাভাইরাসের টিকা আবিস্কার বিলম্বিত হলে, এই দুটি খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। তার মানে কাজ বা বিনোদনের জন্য যে ধরণের বাধাবিঘ্নহীন ভ্রমণে এখন মানুষ অভ্যস্ত তা অনেক পাল্টে যাবে। বিমান ভ্রমণ অনেক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক পর্যটন ধসে পড়বে।
ডেভিড প্যাসিগ হচ্ছেন একজন ফিউচারোলজিস্ট। তিনি ইসরায়েলের বার ইলান ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব এডুকেশনের’ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাবের প্র্রধান। তার লেখা একটি বই ‘দ্য ফিউচার কোড এন্ড ২০৪৮’ বেশ আলোচিত।
ডেভিড প্যাসিগ মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারি কতদিন চলে, সেটার ওপর নির্ভর করবে এসব পরিবর্তন কত দীর্ঘস্থায়ী হয়। জেরুসালেম পোস্ট পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক্ষেত্রে তিন ধরণের অবস্থা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
প্রথম পরিস্থিতে, যেটার সম্ভাবনাই বেশি বলে তার ধারণা, এক বা দুই বছরের মধ্যে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে মহামারিতে বিশ্ব জুড়ে মারা যাবে প্রায় দশ লাখ মানুষ। এক্ষেত্রে মানুষ দ্রুতই এই মহামারির বিভীষিকা ভুলে যাবে এবং দ্রুত তাদের পুরোনো অভ্যাস বা রীতিতে ফিরে যাবে।
কিন্তু দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প, যেখানে মহামারি স্থায়ী হবে প্রায় পাঁচ বছর এবং মারা যাবে প্রায় দশ কোটি মানুষ, সেটির ধাক্কা সামলাতে লাগবে আরও পাঁচ বছর। এরকম পরিস্থিতিকে ডেভিড প্যাসিগ বর্ণনা করছেন ‘সম্ভাব্য পরিস্থিতি’ বলে, তার অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে। তা সত্ত্বেও একটা সময়ের পর মানুষ তার স্বাভাবিক আচরণে ফিরে যাবে, যেমনটি ঘটেছিল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির পর।
ডেভিড প্যাসিগের তৃতীয় দৃশ্যকল্পটি সবচেয়ে ভয়ংকর। তার মতে এটি হচ্ছে ‘ওয়াইল্ড কার্ড সিনারিও’, অর্থাৎ এর সম্ভাবনা খুবই কম। এক্ষেত্রে মহামারি দশ বছরের বেশি স্থায়ী হবে এবং দশ কোটি হতে তিরিশ কোটি মানুষ এতে মারা যাবে।
তাঁর মতে, এরকম ক্ষেত্রে মানুষের আচরণে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে।
“মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ কমে যাবে এবং অন্যের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে ভয় সেঁটে গিয়েছে, তা কাটাতে দশ হতে বিশ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। আর মানুষের এই আচরণের কারণে নতুন ধরণের সেবা, শিল্প, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে উঠবে।”
তাঁর মতে এর ফলে কম্পিউটার বিজ্ঞান আর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের যে প্রাধান্য এখন সর্বত্র, তাকে পেছনে ফেলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে জীববিজ্ঞান।
রিপোর্ট; বিবিসি বাংলা