ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশু
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ অভুক্ত শিশু কাঁদছে। ৮/১০ দিন ধরে চোখে ঘুম নেই। ক্লান্ত শরীর। শিশু থেকে বৃদ্ধ একই অবস্থা। চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। ক্ষুধায় পেট লেগে গেছে। অভুক্ত কোলের শিশু কাঁদছে। মা তার শিশুকে বুকের দুধ ধরিয়ে দিচ্ছেন। তবুও কাঁদছে শিশু। মায়ের বুকে দুধ পাচ্ছে না। কারণ না খেয়ে মায়ের শরীরও হাড্ডিসার হয়ে গেছে। বুচিডং থানার লেলেমা গ্রামের বাসিন্দা রশিদা বেগম (২৫)। কোলে ১ মাসের শিশু হাসিনা বেগম। এই শিশুকে কতই না সান্ত্বনা দিচ্ছেন তা ভাষায় প্রকাশ করাও মুশকিল। কিন্তু এক মাসের শিশু ক্ষুধার জ্বালায় মায়ের সেই সান্ত্বনা কি বুঝে? তার অনবরত কান্না, হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের শোরগোলে মিশে যায়। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে আসে একজন ব্যবসায়ী। ক্ষুধার্ত মানুষের হাতগুলো বাড়িয়ে ধরে খাবার দাতার দিকে।
যেমনি একটি খাবারের প্যাকেট মিলে যায় পরিবারের সবাই ভাগাভাগি করে পেটকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা চালায় কয়েকদিন ধরে অভুক্ত এই রোহিঙ্গা মানুষগুলো।
বর্মী সেনার নৃশংসতায় বৃদ্ধারাও: সহিংসতার শুরুর এক সপ্তাহের পর নিজের চোখের সামনে বৃদ্ধ স্বামীকে পিটিয়ে হত্যা করে ও বসতবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বর্মী সেনারা। বুক ভরা বিলাপেও সেনাদের নির্মম অত্যাচার থেকে স্বামীকে রক্ষা করতে পারেনি জুহুরা খাতুন (৫৫)। লাঠি দিয়ে প্রহার ও জুতা দিয়ে পিষ্টে থেঁতলা করেছে শরীর। চোখের সামনেই গত ৩রা সেপ্টেম্বর স্বামী আবদুল করিমকে হত্যা করে। শুধু তার স্বামী নয়, এভাবে আবুল কাছিম, মৌলভী আবদুল শুক্কুরকে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১১ই সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে এপারে আসা মংডুর রাছিডং এলাকার জুহুরা খাতুন বিলাপের সুরে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলেন। তিনি আরো জানান, ৫ দিন ধরে পাহাড়ি পথ হাঁটতে হয়েছে। পেটে দানা পানি পড়েনি। শুকনো চিড়া খেয়ে কোনো রকমে মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংদিয়া বরাবর এসেছি। এসময় বর্মী সেনারা সামনে পড়লে সবাই উপরের দিকে হাত তুলে জীবন রক্ষা পেয়েছি। তার দুই সন্তান, পুত্রবধূ ও নাতিদের নিয়ে গত রোববার সন্ধ্যায় সীমান্ত অতিক্রম করে দিয়ে এপারে ঢুকেছেন। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে সহায় সম্বল বলতে যা ছিল ৪ আরা স্বর্ণ তা ঘাটের মাঝিদের দিয়ে দেন। এখন অভুক্ত শরীরে হাঁটাও দায়। নাতি-নাতনীরাও না খেয়ে কাঁদছে।
এসময় কথা হয় মংডু রাজারবিলের মো. ছৈয়দের পুত্র নবী হোছনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গুলির শব্দে চমকে উঠি। পাঁচটি ঘরের পর বিয়াইন (পুত্রবধূর পিতা) ছৈয়দ আলমের ঘর। ধীরে ধীরে ওই দিকে অগ্রসর হতে থাকি। যতই কাছে যাই ততই কান্নার শব্দ। কয়েক মিনিট হাঁটার পর বিয়াইনের বাড়িতে পৌঁছি। ততক্ষণে সেনাদের গুলি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বিয়াইন ছৈয়দ আলমের (৪৮)। একই এলাকার নুর হাসিম (৩৩), মুবিন (২৮), খাইরুছ (৪০)কেও গুলি করে হত্যা করে। সেনারা চলে গেলে মৃতদেহগুলো দাফন করা হয়। পরের দিন ওদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে এলাকার অন্যদের সঙ্গে পরিবারের সদস্য নিয়ে এপারে চলে আসি।
মংডুর হাজীপাড়ার হাবিব উল্লাহ (৪২) জানান, ৬১ ঘর নিয়ে হাজীপাড়া গ্রাম। ২৫শে আগস্ট থেকে বর্মী বাহিনীর অত্যচার, নির্যাতন, হত্যার ফলে গ্রামের পর গ্রামে বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। চারদিকে আতংক। গুলির শব্দ। লাশের পচা গন্ধে হাঁপিয়ে উঠি। হঠাৎ আমাদের গ্রামে বর্মী মগের হামলা। মা-বোনদের নিয়ে টানাটানি। প্রতিবাদ করেও রেহাই নেই। চোখের সামনে মো. তোহা (২৯) ও মৌলভী মো. তৈয়বকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। অবশেষে কোরবানি ঈদের পরের দিন পুরো গ্রামের সবাই একযোগে পাহাড়ি পথ ধরে ৭ দিন হাঁটার পর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্ত হতে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে এপারে ঢুকি। ঘাট পার হতে জন প্রতি ১৫ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ৯ একর জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। আসার সময় ১২টি গরু ছেড়ে দিয়েছি।
রাখাইন জ্বলছে: মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (রাখাইন স্টেট) মুসলিম বসতিতে প্রতিদিন নতুন করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমার সেনারা প্রতি দিনই মুসলমানদের বসতিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এসময় গরু- মহিষ নিয়ে যাচ্ছে বর্মীরা। মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। সেনাদের হেলিকপ্টার আকাশে চক্কর দিচ্ছে।
টেকনাফ সীমান্ত থেকে পরিষ্কারভাবে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলতে দেখা গেছে। যা সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষ জ্বলন্ত গ্রামগুলো দেখতে সীমান্তে ভিড় জমিয়েছে। মংডুর বাঘঘোনা এলাকার রশিদ আহমদ জানান, বর্মী সেনারা নতুন করে বাঘঘোনা, ছেরাপাড়া, মোল্লাপাড়া, খুইন্নার পাড়া, গজ্জনদিয়া, বডডেইল পাড়া, খেয়ারীপাড়া, নাইনসংপাড়া গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।