খ্রিস্টান ও মুসলিম নেতাদের হত্যা করত ‘হাসাসিন’ নামে যে গোপন ঘাতকরা
‘যখন ওই বৃদ্ধ এক বড় নেতাকে হত্যা করতে চাইতেন, তখন তিনি সবচেয়ে সাহসী তরুণদের বেছে নিতেন। তিনি তাদের এই বলে হত্যা অভিযানে পাঠাতেন যে, যদি তারা মারতে পারে তাহলে তারা বেহেশতে জায়গা পাবে।’
ইতালীয় অভিযাত্রী মার্কো পোলো তার বই ‘বুক অব ওয়ান্ডার্সে’ এমন এক মুসলিম গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেছেন যারা মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ওপর, বিশেষ করে যারা ইসলামের নবী মুহাম্মদের অনুসারী, তাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাত।
এই দলটির নাম ছিল ‘হাসাসিনস’ বা ‘হাশশাশিন’। বলা হয়, ইংরেজি ‘অ্যাসাসিন’ শব্দটি এই দলের নাম থেকেই নেওয়া হয়েছে। যার অর্থ ‘খুনি’।
রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা বা গুপ্তহত্যা করাকে ‘অ্যাসাসিনেশন’ বলা হয়। আর যারা সে কাজটা করে তাদের বলে ‘অ্যাসাসিন’।
১১৯২ সালের ২৮শে এপ্রিলে টায়ার শহরে (বর্তমান লেবানন) হাসাসিনদের হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
সে দিন ইতালির সম্ভ্রান্ত কনরাড অফ মনফেরাট জেরুজালেমের রাজা হওয়ার বা রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তৃতীয় ক্রুসেডের অন্যতম প্রধান নেতাও ছিলেন। কিন্তু সে দিন কোনও উৎসব হয়নি।
ইতিহাস অনুসারে, জেরুজালেমের রাজ্যাভিষেকের দিন দু’জন বার্তাবাহক কনরাড অফ মনফেরাটের কাছে একটি চিঠি নিয়ে পৌঁছান।
যখন তিনি ওই চিঠিটি পড়ছিলেন তখনই ওই দুই বার্তাবাহক ছুরি বের করে এবং তাকে ছুরিকাঘাত করে।
হামলাকারীদের কে বা কারা পাঠিয়েছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সে সময় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে তারা হাসাসিনের সদস্য।
সময়ের সাথে সাথে ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং টেলিভিশন পরিচালকদের অনুপ্রাণিত করেছে এই হাসাসিন সম্প্রদায়।
সম্প্রতি বের হওয়া ‘অ্যাসাসিনস ক্রিড’ ভিডিও গেমটির নির্মাতারাও সেই গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির ফসল
হাসাসিনদের উৎপত্তি হয়েছিল ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। ইসলামের নবী মারা যাওয়ার পর কে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে খলিফা বা নেতা হবেন, কার হওয়া উচিত তা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়।
মাদ্রিদের অটোনমাস ইউনিভার্সিটির আরব ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইগনাসিও গুতেরেস ডি টারানের মতে, এটিই শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তির বড় কারণ ছিল।
নবম শতকের মধ্যে শিয়া সম্প্রদায়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু তখন তাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে নতুন এক বিরোধ দেখা দেয়। যা ইসমাইলি সম্প্রদায়ের ভিত্তি তৈরি করে।
ইমাম ইসমাইল ইবনে জাফরের সম্মানে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়।
এখন এই সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব নিয়েও মতবিরোধ দেখা দেয়। যার কারণে এই শেষ দলটিও বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে একটি অংশ নিজার নামে এক রাজপুত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠে। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার (বর্তমান মিশর) ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তার ছোট ভাইয়ের অনুসারীদের দ্বারা কায়রোতে হত্যার শিকার হন।
যাই হোক, নিহত নিজারির অনুসারীরা নতুন শাসকের প্রতি অনুগত হওয়া বা নতুন আদেশ মানার পরিবর্তে, পূর্বে পারস্যের দিকে চলে যায় এবং সেখানে তারা তাদের বিশ্বাসের প্রচার বা দাওয়াহ দিতে শুরু করেন।
যা সুন্নি বা শিয়ারা ভালভাবে নেয়নি। উভয় সম্প্রদায় বিষয়টির সমালোচনা করেছিল।
নিজারের অনুসারী বা নিজারিরা তাদের ইসলামের বিশ্বাসের সাথে গ্রীক দর্শন এবং রহস্যবাদের উপাদানগুলোকে যোগ করে।
গ্রীক দর্শন বলতে মূলত নৈতিক এবং মানবতার শিক্ষাকে বোঝানো হয় এবং রহস্যবাদ বলতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন, যাদুবিদ্যা, সম্মোহন, জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।
নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এবং নিজেদের বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজারিরা একটি দাওয়াহ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।
দাওয়াহ নেটওয়ার্কের একজন ১১ শতকে হাসান-ই সাবাহ নামে পারস্যের এক যুবককে বন্দী করেন।
যিনি পরে ধর্মান্তরিত হন এবং নিজারিদের বিশ্বাস গ্রহণ করেন। পরে হাসান-ই সাবাহ ‘হাসাসিন’ নামে ঘাতকদের একটি গোপন দল প্রতিষ্ঠা করেন।
সে সময় আরব উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিজারিরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
স্পেনের সেভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক এমিলিও গঞ্জালেস ফেরিন বিবিসিকে বলেছেন যে, “হাসাসিনরা নিজারিদের উগ্রপন্থী করে তোলে।”
“তারা ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক আচার প্রতিষ্ঠা করে। হাসাসিনরা নির্মূল হওয়া আগ পর্যন্ত কেবল একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবেই পরিচিত ছিল”, জানান এই বিশেষজ্ঞ।
পাহাড়ের বাসিন্দা
নিজারিরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। হাসান-ই-সাবাহ তখন আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইরানের পর্বত এলাকা বেছে নেন এবং পারস্যের পাহাড়ের দিকে যাত্রা করেন।
এরপর তারা এলবুর্জ পর্বতমালায় (তেহরান শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে) অবস্থিত আলামুতের দুর্গ দখল করে।
এই দুর্ভেদ্য দুর্গটি ছিল তাদের নেটওয়ার্কের কেন্দ্র, যেখান থেকে নিজারিরা বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
অধ্যাপক ইগনাসিওর মতে, ওই দুর্গ থেকেই নিজারি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হাসান ই সাবাহ ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। তিনি ওই পাহাড়ের বৃদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পান।
নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, হাসান ই সাবাহ একটি উচ্চপ্রশিক্ষিত মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন যারা বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র, ক্রুসেডার অঞ্চলগুলোয় এবং রাজবংশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালায়।
“যেহেতু তাদের ক্ষমতা দখল করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং তাদের ক্ষমতা দখল বা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও ছিল না, তাই তারা সার্জিকাল অপারেশনের মাধ্যমে হামলা চালাতে থাকে। অর্থাৎ তারা পালাতে পারবে কি পারবে না সেটা বিবেচনা না করেই যে কাউকে হত্যা করত এবং সেটা ছদ্মবেশ ধারণ করে”, বলেন অধ্যাপক এমিলিও গঞ্জালেস।
এই ইতিহাসবিদের মতে, “হাসান ই সাবাহ-র নেতৃত্বে আন্দোলন তেমন জনপ্রিয় বা ব্যাপক ছিল না, বরং এটি একটি ‘চরমপন্থী’ ধারণা ছিল যার ধর্মীয় প্রবণতা মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে।”
এই মিলিশিয়া বাহিনী সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব এবং মিথ রয়েছে। ইসলামের বিভিন্ন সূত্র, এই বাহিনীর কার্যকলাপ বা ‘ফেদাইন’ ব্যবস্থার ব্যাপক সমালোচনা করেছে।
এই বাহিনীর আসল নাম ছিল ফেদাইন। ফেদাইন অর্থ যারা অন্যের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে।
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে হাসান ই সাবাহ এবং তার পরবর্তী উত্তরসূরিরা ফেদাইনদের গাঁজা দিয়ে নেশা করাতেন। এরপর তাদেরকে বিভিন্ন হত্যার অভিযানে পাঠাতেন।
পরে ফেদাইনরাই হাসাসিন হিসেবে পরিচিতি পায়। আরবি ভাষায় হাসাসিন বলতে হাশিশ বা গাঁজা সেবন করা ব্যক্তিদের বোঝানো হতো।
“কথিত আছে যে হাসান ই সাবাহ তার যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় বেহেশত লাভের কথা বলতেন। তারপর তাদের গাজার পাতা দিয়ে নেশা করাতেন,” বলেন অধ্যাপক ইগনাসিও।
তারা সাধারণত গাঁজার পাতা পান করে বা চিবিয়ে খেতেন। তারপর হাসান ই সাবাহ তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিতেন।
তবে অধ্যাপক গঞ্জালেসের মতে, ইতিহাসের এই সংস্করণটি ভুল ও মিথ্যা। তিনি মনে করেন, এসব ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল ওই দলটির কৌশল সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না এবং ভুল ধারণা ছড়িয়ে দলটিকে অসম্মান করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
“যারা গাঁজা সেবন করেছেন তারা জানতেন যে এটি নেওয়ার পরে তারা শেষ যে কাজটি করতে চান তা হল হত্যা করা।”
ধারণা করা হয় যে, তারা বেপরোয়া হওয়ার কারণেই মাদকের নেশা করত কিংবা যেহেতু তারা আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে, এজন্য তারা নেশাগ্রস্ত হতো।
“যদি তাই হয় তাহলে সেটা গাঁজা ছাড়া অন্য কিছু হবে”, বলেন ইতিহাসবিদ এমিলিও গঞ্জালেস।
তিনি আরও বলেন যে হাসাসিন শব্দটির উৎপত্তি অন্য কোন ভাবে হতে পারে, শুধুমাত্র গাঁজা সেবনকারী থেকে এই নাম হতে পারে না।
বরং এই নামকরণের পেছনে ‘মৌলবাদী’ সংযোগ থাকতে পারে।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইসের মতে, ওই সময়ের ইসমাইলিদের ‘হাশাশিয়া’ (গাঁজা সেবনকারী) বলে অভিহিত করা হতো। কারণ অন্যরা তাদের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, গাঁজা খাওয়ার কারণে নয়।
নিখুঁত হত্যা কৌশল
গ্রামের শিশুদের ক্রয় বা অপহরণ করা ছিল এমন কিছু পদ্ধতি যার মাধ্যমে হাসান ই সাবাহ এবং তার উত্তরসূরিরা মিলিশিয়াদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
একবার কাউকে নিয়োগ দেওয়া হলে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের কেবল হাতে ধরে যুদ্ধই শেখানো হতো না বরং, যে শহরে তাদের পাঠানো হত তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং রীতিনীতিও শেখানো হতো।
ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক এমিলিও গঞ্জালেসের মতে, তিনি একজন নিনজা যোদ্ধার মতো ছিলেন যিনি ছদ্মবেশ ধারণ করতে এবং মানুষের সাথে মিশতে জানতেন।
আরব ও ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ইগনাসিও তাদের ‘ভালো এবং সভ্য মানুষ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। “তারা যে সব জায়গায় অভিযান চালাতে যাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দাদের রীতিনীতি এমনকি কথা বলার ধরনও জানত”, বলছেন তিনি।
কোনও না কোনওভাবে হামলার স্থানে লুকিয়ে ঢুকিয়ে পড়ার বিশেষ ক্ষমতা ছিল খুনিদের।
এই ঘাতকদের নিখুঁতভাবে অনুপ্রবেশের ক্ষমতা, তাদের নির্ভুলতা এবং ঠান্ডা আচরণ তাদের কুখ্যাত ও ভয়ংকর করে তুলেছিল।
ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস তার ‘দ্য অ্যাসাসিনস : আ র্যাডিক্যাল সেক্ট অব ইসলাম’, বইয়ে চতুর্দশ শতাব্দীর এক জার্মান ধর্মযাজকের গল্প উল্লেখ করেন।
সেখানে তিনি বলেছেন, “এই হত্যাকারীরা অবশ্যই অভিশপ্ত এবং তাদের থেকে পালিয়ে বাঁচতে হবে। তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে, তারা মানুষের রক্তের পিপাসু, তারা টাকার বিনিময়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে এবং তারা কোনও কিছুর পরোয়া করে না, এমনকি পরিত্রাণেরও না।”
“শয়তানের মতো, তারা আলোর দেবদূতে রূপ নেয়, বিভিন্ন জাতি ও মানুষের অঙ্গভঙ্গি, পোশাক, ভাষা, রীতিনীতি এবং কাজগুলি অনুকরণ করে। তারা হল ভেড়ার ছালে লুকিয়ে থাকা নেকড়ে, কেউ তাদের পরিচয় শনাক্ত করলেই তাকে সাথে সাথে মৃত্যু ভোগ করতে হয়”, তিনি বর্ণনা করেন।
অধ্যাপক এমিলিও গঞ্জালেস এই গোষ্ঠীর সদস্যদের ‘ইতিহাসের প্রথম সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেছেন কারণ তাদের অনেক হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে চালানো হয়।
যেন জনমনে তাদের নিয়ে ভয় থাকে।
তিনি বলেন, “যদি একজন গভর্নর তার দেহরক্ষী নিয়ে বাজারের মধ্য দিয়ে যান, তাহলে একজন খুনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে, একটি ছুরি বের গভর্নরের গলা কেটে দেবে। এরপর সেই হত্যাকারী জীবিত ফিরবে নাকি মৃত সেটি কোনও বিষয় নয়।”
অধ্যাপক ইগনাসিওর মতে, সেই আততায়ীকে মেরে ফেলাই কাম্য ছিল যাতে এসব অভিযানের কথা গোপন থাকে।
রক্তের বিনিময়ে বেহেশত
হাসান ই সাবাহ তার ভক্ত বা ফেদাইনদের মধ্যে আত্মত্যাগের চেতনা জাগ্রত করার জন্য বা স্বেচ্ছায় যেন তারা নিজেদের জীবন দেয় সেজন্য আলামুত দুর্গে ধর্ম শিক্ষা দিতেন।
মার্কো পোলো তার বইতে লিখেছেন যে ওই দুর্গটি এই উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল।
তিনি লিখেছেন যে হাসান ই সাবাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন দুটি পাহাড়ের মাঝখানে একটি উপত্যকায়। যেখানে খুব সুন্দর একটি বাগানও ছিল।
“এখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফল ছিল। বাগানের মাঝখানে একটি ফোয়ারা ছিল যার একটি পাইপের মধ্যে দিয়ে মদ, আরেকটি পাইপ থেকে দুধ, আরেকটি থেকে মধু এবং আরেকটি পাইপ থেকে মিঠা পানি প্রবাহিত হত”, লিখেছেন ভেনিসের অভিযাত্রী মার্কো পোলো।
হাসান ই সাবাহ সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে এসেছিলেন যারা সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত এবং তারা পরীদের মতো গান গাইতে পারতো।
এই গুরু তার ভক্তদের ধারণা দিয়েছিলেন যে এটি বেহেশত।
ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মতে “যারা খুনিতে পরিণত হয়েছে তারা ছাড়া আর কেউ এই বাগানে ঢুকতে পারেনি।”
মার্কো পোলোর মতে, হাসান ই সাবাহ প্রশিক্ষিত ঘাতকদের বাগানের ভেতরেই আবদ্ধ রেখেছিল যাতে তারা সেখানকার আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
যাই হোক, যখন কোনও অভিযান থাকত তখন হাসান ই সাবাহ তাদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত একজনকে মাদক সেবন করাতেন এবং তাকে ওই দুর্গের বাইরে নিয়ে যেতেন।
যখন ওই ব্যক্তি নেশার ঘোর থেকে জেগে উঠতেন। তখন হাসান ই সাবাহ তাকে বলতেন যে তিনি যদি বেহেশতে ফিরে যেতে চান তবে তাকে অবশ্যই অর্পিত কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
মার্কো পোলো পরিশেষে বলেন, “মনোনীত ওই ব্যক্তি তার কাজ সম্পন্ন করতেন কারণ কেউ স্বেচ্ছায় এই স্বর্গ ছেড়ে যেতে চায় না।”
দুই দশকের খুন-লুটপাট
নিজারি শাসনকাল ১৬৬ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তারপর তাদের শত্রু মোঙ্গলরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
অধ্যাপক ইগনাসিও উল্লেখ করেছেন যে, “মোঙ্গলরা বড় হুমকি তৈরি করেছিল। এমনকি ক্রুসেডারদের থেকেও অনেক বেশি, কারণ তারা আরও বেশি বর্বর ছিল এবং তারা পশ্চিমের চেয়ে কাছাকাছি জায়গা থেকে এসেছিল। তাই, নিজারিরা তাদের সাথে এক ধরনের চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।”
চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের বাহিনী তার দুর্ভেদ্য দুর্গ ধ্বংস করে দেয়। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, হালাকু খান বিশ্বাস করতেন ঘাতকরা তার এক চাচাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু তার আগেই এই নিজারি খুনিদের হাতে বহু মুসলিম ও খ্রিস্টান নেতা এবং অভিজাতরা প্রাণ হারিয়েছেন।
অধ্যাপক ইগনাসিওর মতে, সুলতান সালাহ আল-দিন আইয়ুবি সেই মুসলিম নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন যাকে হত্যার চেষ্টা করা হলেও তিনি সৌভাগ্যবশত প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি বিবেচিত হন। তিনি দ্বাদশ শতকে মুসলমানদের জন্য জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
অধ্যাপক ইগনাসিও বলেছেন যে, সালাহ আল-দিন ক্রুসেডারদের তাড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি অর্জন করতে গেলে তাকে কিছু মুসলিম রাষ্ট্র এবং রাজ্য নির্মূল করতে হবে, যারা প্রায়ই ক্রুসেডারদের সহযোগিতা করত।
সেই প্রচারাভিযানের সময় তিনি নিজারি দুর্গ (আধুনিক সিরিয়ায় অবস্থিত) মাসয়াফকে লক্ষ্যবস্তু করেন।
নিজারিরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ১১৮৫ সালে সালাহ আল-দিনকে হত্যা করার জন্য ঘাতকদের পাঠায়।
অধ্যাপক ইগনাসিওর মতে, ঘাতকরা সালাহ আল-দিনের সৈন্যের পোশাক পরে তার তাঁবুতে প্রবেশ করে এবং তাকে ওই তাঁবুর ভেতরে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়।
কারণ সালাহ আল-দিনের শরীরে তখন জালের মতো বর্ম পরা ছিল এবং তার টুপির নিচে এক ধরণের ধাতব হেলমেট ছিল।
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড, যিনি নবম ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিলেন, তিনিও ১২৭২ সালে ফেদাইনদের তলোয়ারের আঘাতে অল্পের জন্য মৃত্যু থেকে রক্ষা পান।
এ ধরনের গোপন অভিযান মুসলমান এবং খ্রিস্টান উভয়ের বিরুদ্ধেই চালানো হতো, অর্থাৎ তারা দুই ধর্মের হয়েই বিপুল অর্থের বিনিময়ে ঘাতকের কাজ করতো।
এভাবে ‘হিটম্যান’ বা হত্যাকারী হিসাবে তাদের খ্যাতি বহু শতাব্দী ধরে আজ অবধি অব্যাহত আছে।