গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ‘ওয়ান ম্যান শো’তে যত বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন
ডেস্ক রিপোর্টঃ অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এমন একটা ইনিংস খেলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় এনে দিলেন, যে ইনিংস দেখে অনেকেই ভাবছেন এটাই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংস কি না।
এটাকে ‘ওয়ান ম্যান শো’ বলে বর্ণনা করেছেন কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের জন্য টার্গেট ২৯৩ রান এর মধ্যে ২০১ রান একাই তুলেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
ম্যাক্সওয়েলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি ছিল এটি আর এই বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
রেকর্ডের পাতা তো বটেই, ক্রিকেট যারা ভালোবাসেন এবং খেলাটি যারা দেখেছেন, বহুদিন এই ইনিংসটি তাদের মনে থাকবে।
ম্যাচের একটা পর্যায়ে ম্যাক্সওয়েল পেশিতে টান অনুভব করেন।
ওয়াসিম আকরাম বলেন, “যারা ব্যাটিং করেছেন তারা বলতে পারবেন ক্র্যাম্প নিয়ে ব্যাট করা কতোটা কঠিন কারণ আপনি পা নাড়াতে পারবেন না”।
ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তী সাচিন টেন্ডুলকার সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “ম্যাক্স প্রেশার থেকেই ম্যাক্স পারফরম্যান্স”।
ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসটিকে সাচিন ওয়ানডে ক্রিকেটে তার দেখা সেরা ইনিংস বলে আখ্যা দিয়েছেন।
যত রেকর্ড এই ইনিংসে
ম্যাক্সওয়েলের এই ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংসের কারণে রেকর্ডের খাতায় অনেক হিসাব নতুন করে লিখতে হচ্ছে।
চলতি বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা করলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
এটাই অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ ক্রিকেট দলের হয়ে সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোর।
এর আগে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে কোনও ব্যাটার ডাবল সেঞ্চুরি করেননি। সর্বোচ্চ ছিল পাকিস্তানের ফখর জামানের ১৯৩, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
ম্যাক্সওয়েল প্রথম অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ ক্রিকেটার যিনি ওয়ানডে ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।
এর আগে ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান নারী ক্রিকেটার বেলিন্ডা ক্লার্ক ২২৯ রান তুলেছিলেন।
বেলিন্ডা ক্লার্ক অজি ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তী, তার সম্মানার্থে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি ভাস্কর্যও রয়েছে।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে ম্যাক্সওয়েলের মতো বেলিন্ডা ক্লার্কও ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন মুম্বাইয়ের মাটিতে।
ম্যাচের শেষে ম্যাক্সওয়েলের অধিনায়ক প্যাট কামিন্সও পুরো ঘটনাটিকে ‘ওয়ান ম্যান শো’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আফগানিস্তানের রান তাড়া করতে ২৯৩ রান তুলেছে অস্ট্রেলিয়া, এর মধ্যে ম্যাক্সওয়েলের রান ২০১ যা মোট রানের ৬৮.৬০%।
যদিও এটা অল্পের জন্য রেকর্ড হয়নি, ক্যারিবিয়ান গ্রেট স্যার ভিভিয়িান রিচার্ডস ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দলীয় ২৭২ রানের মধ্যে ১৮৯ রান তুলেছিলেন, যা ছিল ৬৯.৪৮%।
তবে ভিভ রির্চাডসের রান ছিল প্রথম ইনিংসে, সেদিক থেকে ম্যাক্সওয়েলেরটা রান তাড়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড।
এর আগে ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে রান তাড়া করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের ২২৫ রানের মধ্যে ১৪১ রান তুলেছিলেন স্কট স্টাইরিস।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চারটি শতকের মধ্যে তিনটিই বিশ্বকাপে। পাঁচ নম্বরে বা তারও নিচে ব্যাট করে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডও ম্যাক্সওয়েলের।
তবে গতরাতে তার লড়াকু ইনিংসের পেছনে বেশ অবদান রেখেছেন অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স।
৯১ রানে ৭ উইকেট চলে যাওয়ার পর ব্যাট করতে নেমে প্যাট কামিন্স ম্যাক্সওয়েলকে দারুণ সঙ্গ দেন।
তিনি ৬৮ বল খেলে মাত্র ১২ রান তোলেন। কিন্তু ম্যাচের স্কোরকার্ড সেই ইনিংসের মাহাত্ম্য বোঝাতে পারবে না।
কারণ উইকেটে টিকে থাকাই ছিল কামিন্সের কাজ এবং সেটা তিনি খুব ভালোভাবেই করেছেন।
কামিন্স একটা ভিন্ন ধরনের রেকর্ড গড়েছেন এই ম্যাচে, কমপক্ষে ১০ রানের ইনিংসের মধ্যে তিনি সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেটের রেকর্ডের তালিকায় রয়েছেন।
ম্যাক্সওয়েল-কামিন্স জুটি প্রায় ১৭ বছর আগে করা ১৩৮ রানের জুটির রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন।
অষ্টম উইকেট জুটিতে ২০২ রানের জুটি গড়েছেন ম্যাক্সওয়েল ও কামিন্স। এর আগে ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যান্ড্রু হল ও জাস্টিন কেম্প ১৩৮ রানের জুটি গড়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় দিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলমান বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করেছে।
আর এটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বর্ণাঢ্য বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এর আগে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৮৯ রান তাড়া করে জয় পেয়েছিল আর এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে লক্ষ্য ছিল ২৯২ রান।
প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করলেন ম্যাক্সওয়েল
যদিও ওয়ানডে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া এর আগে ৩৫৯ রানও তাড়া করে জয় পেয়েছে।
এই ইনিংস কতোটা বিশেষ তা একটা ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ম্যাচের ১৯ ওভার শেষে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সম্ভাব্য ফলাফলে আফগানিস্তানের জয়ের সম্ভাবনা দেখাচ্ছিল ৯৯.৫৪%।
সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচটা জিতিয়ে আনলেন ম্যাক্সওয়েল।
ক্র্যাম্প বা মাংসপেশীতে টান লাগার কারণে ম্যাচের একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল গ্লেন ম্যাক্সওয়েল খেলা চালিয়ে যেতে পারবেন না। তার বদলে ব্যাট করতে নামার জন্য অ্যাডাম জাম্পা দুইবার বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত চলে এসেছিলেন।
ম্যাক্সওয়েল তার ১৪৭তম রান নেয়ার জন্য দৌড়ে এক রান নিতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখানে শুয়ে রীতিমতো কাতড়াচ্ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের ফিজিও একটা পর্যায়ে তাকে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার জন্যও বলেন।
কিন্তু ম্যাক্সওয়েল খেলা চালিয়ে যান।
ম্যাক্সওয়েল ঠিক কীভাবে খেলায় রান তুলতে থাকেন সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক মিসবাহ উল হক বলেন, “ফুটওয়ার্ক ভুলে যান, এটা পুরোপুরি কবজির খেলা যেটা ম্যাক্সওয়েল আমাদের দেখালেন”।
পা নাড়ানোর শক্তিই পাচ্ছিলেন না গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
এই ইনিংসে ম্যাক্সওয়েল দুইবার জীবন পান। একবার রাশিদ খানের সাথে ক্যাচ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আফগান অধিনায়ক শহীদি ক্যাচ ছাড়েন, আরেকবার মুজিব উর রহমান তুলনামূলক সহজ একটা ক্যাচ ধরতে পারেননি।
ম্যাক্সওয়েল গত সপ্তাহেই গলফ খেলতে হিয়ে অদ্ভুত উপায়ে চোট পেয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি এমন একটা ইনিংস খেললেন যেটা ক্রিকেট বিশ্ব বহুদিন মনে রাখবে।