চীনের ঋণের ভারে নুহ্য শ্রীলংকা: দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে দেশটি

Spread the love

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ২৫৩৩০ বর্গ মাইলের একটি দেশ শ্রীলংকা। মোট জনসংখ্যা ২২১৫৬০০০ এবং প্রতি বর্গ মাইলে বাস করে ৮৭৪.৬ জন। দেশটির ৯৫% লোকই শিক্ষিত। ১৯৮৭ সালে দেশটি নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছিল। তাদের মাথাপিছু আয় ৩৮৩০ ডলার। খুবই সুন্দর একটি দেশ। ভ্রমন পিপাসু মানুষের পছন্দের তালিকায় এই দেশটি প্রথম সারির। দুনিয়ার প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:)কে আল্লাহ এই অঞ্চলেই প্রেরণ করেছিলেন। যেখানে একটি পাহাড়ের চূড়া রয়েছে,যাকে বলা হয় আদম চূড়া (Adam’s Peak). এই চূড়ায় পায়ের ছাপ-আকৃতির চিহ্ন রয়েছে। খ্রিস্টান এবং মুসলমানরা দাবি করেন এটি আদমের পায়ের ছাপ, তিনি বেহেস্ত থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরে পৃথিবীতে প্রথম পা রেখেছিলেন এই চূড়ায়, এই স্থানটিতে; এজন্য এটিকে “আদমের চূড়া” বলা হয়।দেশটি বিশ্বের ৮০-৯০% দারুচিনি উৎপাদন করে; চা, বিশেষ করে Ceylon tea উৎপাদনে রয়েছে তাদের বেশ সুনাম, অনেক দামি দামি পাথর পাওয়া যায় এই দেশে যার জন্য একে বলা হয় “the Island of Gems”। ছোট ছোট ব্যবসা পরিচালনা, কৃষিকাজ, মাছ ধরা শ্রীলংকানদের অন্যতম প্রধান কাজ।

৩৮৩০ ডলার মাথাপিছু বাৎসরিক আয় হলেও পর্যটন নির্ভর দেশটি আজ ঋণের ভারে নুহ্য।নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, যেমন এক কেজি চালের দাম ৫০০ টাকার উপরে, গুড়ো দুধ ১৫০০ টাকা ইত্যাদি।ফলশ্রুতিতে মানুষের মধ্যে হতাশা, উত্তেজনা, উদ্বেগ, এবং সরকার বিরোধী মনোভাব দিনকে দিন বেড়েই চলছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট Gotabaya Rajapaksa জনগণকে শান্ত থাকার এবং ধৈর্য ধরণের আহবান জানিয়েছেন গত কয়েকদিন আগের একটি টেলিভিশন বক্তব্যে। ২০১০ সাল থেকে দেশটিতে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে যা ২০১৯ সালে এসে শতভাগে পৌঁছায় এবং ২০২১ সালে ঋণের পরিমান বেড়ে ১০১% হয়ে গেছে।দেশটির জিডিপি ৮৮% হোল বৈদেশিক ঋণ নির্ভর।আজ সবাই দেশটির সরকার প্রধানের ব্যর্থ অর্থনৈতিক পলিসিকে দায়ী করেছে।

মূলত শ্রীলংকার সমস্যা শুরু হয়েছে ২০০৯এ, তামিলদের পতনের পর থেকে। দেশটিকে নতুন করে গড়ে তুলতে বিদেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়া শুরু করতে হয়।২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট এই সুযোগটিকে কাজে লাগান। তিনি সেই বছর শ্রীলংকা সফর করে তাদেরকে ১.৪ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেন। হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর করার বিনিময়ে চীন ৯৯ বছরের জন্য বন্দর ও তদসংলগ্ন ১৫ হাজার একর জমি ইজারা নেয় এবং ৪০ বছর ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা নেয়। এর পাশাপাশি কলম্বোতে সাগরের ৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে চীন একটি নতুন পোর্ট সিটি তৈরী করে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেয়। এই দুই প্রকল্পের জন্য যে ঋণ শ্রীলংকাকে দেয়া হয়েছে তা কখনো শ্রীলংকা পরিশোধ করতে পারবে না, মূলত আফ্রিকার অনেক দেশের মতো শ্রীলংকাকে গ্রাস করার জন্যই এই ঋণ দেয় চীন সরকার। শ্রীলংকা সরকার চীন থেকে নিয়েছে এযাবৎ কাল পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন ডলার।এমনকি বাংলাদেশও শ্রীলংকাকে দিয়েছে ২৫ কোটি ডলার। অন্য কোনো দেশ এখন শ্রীলংকাকে আর ঋণ দিতে চায় না। তাই বাধ্য হয়েই চীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।ভারত তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।চীন অত্যান্ত সুপরিকল্পিত ভাবে শ্রীলংকাকে তাদের বগলদাবা করেছে, বিশেষ করে কলম্বো সমুদ্র বন্দরে পোর্ট সিটি তৈরীর মধ্যে দিয়ে সাগরের উপর তাদের কর্তৃত্ব আরোপ করেছে। বিশেষজ্ঞ ভাষ্য মতে, চিনের কাছ থেকে যে ঋণ তারা নিয়েছে, তা কখনো পরিশোধ করতে পারবে না, বাধ্য হয়েই তাদেরকে হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর ও পোর্ট সিটি ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান মুদ্রাস্ফ্রীতি ১৭.৫%।দেশটির রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ৪০ হাজার কোটি ডলার অথচ চলতি মার্চ মাসেই তাদেরকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৭০০ কোটি ডলার। জুলাই ২০২২ এর মধ্যে তাদেরকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ডিসেম্বর ২০২২ এর মধ্যে তাদেরকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে আরো ১ বিলিয়ন ডলার। যা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রীলংকা চারদিকে ঋণ চাচ্ছে, কেউ এখন তাদেরকে আর ঋণ দিতে চাচ্ছে না। এমনকি খোদ চীনও তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যদিও আইএমএফ দেশটিকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে।দেশটি অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হওয়ার দ্বার প্রান্তে, কারণ বৈদেশিক রিজার্ভ আছে ২.৩ বিলিয়ন।

শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থা বুঝানোর জন্য আরও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন- সম্প্রতি শ্রীলংকার মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিলো, তাদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কাগজ কেনার সামর্থ্য নেই, ফলে দেশের সমস্ত পরীক্ষা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সে দেশের সরকার। শুধু কি তাই, দেশটি আজ পত্রিকা প্রকাশ করতেও হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পত্রিকা তাদের পাতার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে কাগজ সঙ্কটের জন্য। দেশটিতে চলছে তীব্র জ্বালানি তেলের অভাব, সংকট এতো তীব্র যে, শ্রীলংকায় এখন সে দেশের মাত্র ২৫% গাড়ি রাস্তায় চলতে পারে।পেট্রোলপাম্পে বসে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা তেলের অপেক্ষায়, আর জনমানুষে কে যানবাহনে উঠার পরিবর্তে পায়ে হেটে চলতে বাধ্য হতে হচ্ছে।তেল ডিশট্রিবিউশন করতে তাদের রিজার্ভ আর্মিকে পর্যন্ত মাঠে নামাতে হয়েছে।শ্রীলংকার অবস্থা এতটাই খারাপ যে দেশটিতে বিকেল পাঁচটার পরে বিদ্যুৎ থাকে না, বিদ্যুতের অভাবে ঘর বাড়ি যেমন অন্ধকার ঠিক তেমনি কলকারখানা, দোকানপাট, শপিং সেন্টার এমন কি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে পড়েছে। কখনো কখনো রাত ১২ টার পরে সামান্য সময়ের জন্য বিদ্যুৎ আসে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে।

কেন হলো এক সময়কার আর্থিকভাবে সাবলম্বী দক্ষিন এশিয়ার একটি সফল দেশের এই করুন অবস্থা। তা বুঝার জন্য একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে – পৃথিবীর কোনো দেশই এখন আর বৈদেশিক ঋণমুক্ত নয়। তবে কথা হলো, কি পরিমান ঋণ নেয়া হচ্ছে? কোন খাতের জন্য নেয়া হচ্ছে? কিভাবে তা পরিশোধ করা হবে? বা পরিশোধ করার ক্ষমতা আছে কি না, তা ঋণ নেয়ার আগেই চিন্তা করতে হবে। গবেষণায় দেখা যায় বর্তমান বিশ্বের ৫টি ছোট ছোট দেশ এখনো পর্যন্ত তাদেরকে ঋণ মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে।এই তালিকায় রয়েছে Macau, British Virgin Islands, Brunei, Liechtenstein এবং Palau ।সমস্ত রতি-মহারতি এবং উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল, উচ্চ আয়, মধ্যম আয় এবং নিম্ন আয়ের সকল দেশই কম বেশী ঋণ নেয় বিদেশী দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন দেশ থেকে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে শুরু করে ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ কেউ বাকী নেই। কথা হোল ঋণ নিলেও তা পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা বা কোন বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনা রয়েছে কিনা সে ঋণ পরিশোধের, সেটিই বিবেচনার বিষয়। দেশটির যোগ্য নেতৃত্বই তা ঠিক করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শ্রীলংকার বর্তমান এই অবস্থার জন্য দায়ী সেই দেশের অধিকহারে বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা, পরনির্ভরতা, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, ক্ষমতা কুক্ষিগত করন, এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একটি দেশের, বিশেষ করে ভারতের উপর নির্ভর করা, পাশাপাশি অযোগ্য নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনা।

একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, বিদেশী দাতা সংস্থা বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো কখনো মিল, ফ্যাক্টরি যেখানে মানুষের কর্ম সংযোগ হবে সেক্ষেত্রে ঋণ দিতে চায় না; বরং রাস্তা ঘাট অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ দিবে, এবং সেই খাতে আবার তাদের কর্মী বাহিনীকে, তাদের কলা কৌশলী, প্রকৌশলী নিয়োগের, তাদের কর্মিকে কাজ দেওয়ার ও অধিক হারে সুদের শর্তে ঋণ দিবে। এতে করে প্রথমেই তারা একটি বিশাল অঙ্ক শুধু মুজুরি বাবদ নিয়ে নিতে পারে। এখানেই হোল রাষ্ট্রীয় বারগেইনিং পাওয়ার। একটি জনদরদী, স্মার্ট এবং ডাইনামিক রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বই পারে দরকষাকষি করে দেশের সর্বাধিক স্বার্থ হাসিল করতে।

বাংলাদেশও আজ ঋণের ভারে জর্জরিত, রাস্তা, ঘাট, ব্রিজ অনুৎপাদনশীল খাতের উন্নয়নের নামে-বেনামে যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে তা দেশবাসীকে খেসারত দিতে হবে, কেননা আজ বাংলাদেশে যে শিশুটি জন্ম গ্রহন করলো, সেও মাথায় এক বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম নিল। অথচ সে জানেওনা যে তার মাথায় ঋণের এক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথবা তার পিতা এই ঋণের সাথে সম্পৃক্ত নয়।

পরিশেষে, আজকের শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে, চিন্তার উপাদান রয়েছে, কৌশলগত দিক নির্দেশনা ঠিক করার বিষয় রয়েছে।বিশেষ করে, চীন থেকে ঋণ নেয়ার আগে কমপক্ষে দশবার চিন্তা করতে হবে এর ভবিষ্যত পরিণতি কি হতে পারে।

লেখকঃ ব্যারিস্টার ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব
সলিসিটর, সিনিয়র কোর্ট অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস।
৩১/০৩/২০২২, লন্ডন।


Spread the love

Leave a Reply