চেহারা দেখান ভাল কথা, তবে..
আহমেদ শামীম:
বিশ্বাস করুন লেখাটি কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। তবে কেউ মনে কষ্ট পেয়ে থাকলে প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি। একটি সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করবো। যে ব্যাধি সমাজ-সভ্যতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।ভদ্রতা-অভদ্রতার মানদণ্ডে তুল্য হয়। বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের রুচিতে বাধে।
আমাদের সমাজে ‘নিজেকে জাহির করা’র লোকের অভাব নেই । নিজের চেহারা প্রদর্শনে অনেকে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহী থাকেন।এতে যে হিতে বিপরীত হতে পারে কিংবা নিজের অজান্তে নিজেকে হেয় করা হয়, তা বুঝে উঠতে পারেননা তারা ! অনেক সময় অযাচিত বাড়াবাড়ি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না কেউ কেউ।প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, কথিত বড় মাপের ব্যক্তিদের সাথে নিজের সখ্যতা কিংবা কাছের মানুষ হিসেবে তুলে ধরার অদম্য প্রয়াস।এটা সচরাচর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা সভা-সমাবেশে লক্ষণীয় ।কার আগে কে ফুল দেবেন, হাত মেলাবেন, হাস্যবদনে ছবি তুলবেন, সেলফি তুলবেন – এসব নিয়ে চলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। যাকে ফুল দেবেন বা যার সাথে ফটোসেশন করবেন তিনি বিরক্ত হচ্ছেন কিনা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
নেতাদের সাথে কর্মী, সমর্থক এবং অনুরাগীদের এসব কাণ্ড ঘটে বেশি। নিকট অতীতে এমনও দেখা গেছে, নেতার সাথে স্টেজে উঠে ফটোসেশন করতে গিয়ে স্টেজ ভেঙ্গে ধপাস পড়ে গিয়েছেন সবাই । অনেককে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে হয়েছে । এ নিয়ে ব্যাপক ট্রল হলেও কে শুনে কার কথা ! ‘যেই লাউ সেই কদু’।
ফটো সেশনের নামে গরীবদের নিয়ে মশকরার চিত্র তো ডালভাত ! প্রায়ই দেখা যায়, ৮-১০জন মিলে কাউকে কিছু ‘দান’ করছেন। ফটোসেশন চলে দীর্ঘক্ষণ । অনেক সময় দান গ্রহীতাকে চেনাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় !
হৃদয়বিদারক ঘটনারও খবর আসে মাঝেমধ্যে । অনেক স্থানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য লাইন ধরানো হয়। অসহায় দরিদ্র নরনারীকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখার পর আসেন কোন অতিথি । সাথে থাকেন পেইড/আনপেইড ক্যামেরা পার্সন। ভাগ্যবান ক’জনের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে ফটোসেশনের কাজ সম্পন্ন করে চলে যান তিনি। সেসাথে বন্ধ হয়ে যায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে অসহায় মানুষগুলোকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়-এমন খবরও আসে মিডিয়ায়।
অনেকে ফটোসেশনের ছবি মোবাইলে ধারণ করেন স্বার্থ হাসিলের জন্য। এসব ছবির ব্যক্তিবর্গকে ব্যবহার করে বৈধ-অবৈধ পন্থায় নানাবিধ সুযোগ সুবিধা আদায় করেন। তবে এটা যে সব সময় সুফল বয়ে আনে তা-ও নয়। দেখা যায়- যেসব নেতা-নেত্রী ক্ষমতায় থাকাকালে দাপট দেখাতেন, ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে তারা থাকেন দৌডের উপর। তখন তাদের নিজেদের ত্রাহী অবস্থা, লালঘরের চৌহদ্দিতে আটকা পড়া অথবা আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। যারা তাদের সাথে ফটোসেশন করেছিলেন, তখন এসব ছবি হাইড করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন ।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা সভা সমাবেশে দেখা যায় ফুল দেয়া কিংবা ফটোসেশনের সময় চলে তুমুল হুড়োহুড়ি । কার আগে কে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন, এ নিয়ে রীতিমতো হুলস্থুল কাণ্ড ! কোথাও দেখা যায়- একটি সংগঠনের লোকজনের ফুলের তোড়া দেয়া বা ফটোসেশনের সময় অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাদের সংগঠনের নামসম্বলিত তোড়া পেছন থেকে তুলে ধরেন।
পৃথিবী এগিয়ে গেছে বহুদূর কিন্তু আমরা কাণ্ডজ্ঞানের বহু বিষয় রপ্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। সর্বাবস্থায় আমাদের লালিত কালচারের অশালীন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে চলেছি। আমরা কবে সভ্য হবো?-সেই প্রশ্ন থেকে যায় । শত বছর আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন-“রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।”
উপসংহারে শুধু এটুকু বলা যায়, চেহারা দেখান ভাল কথা, তবে নেতা-নেত্রীদের পলায়ন শুরু হলে যেন নিজেরা পালাতে না হয়, ছবি ডিলিট করতে না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে ।শেষ কথা- যত পারেন ফুল দেন, ছবি তুলেন, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু অন্যকে বিরক্ত করে নয়।
লেখকঃ বার্তা সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলা সংলাপ, লন্ডন।