ছুরি হামলার ঘটনা থেকে যেভাবে দেশব্যাপী সহিংস বিক্ষোভ ছড়াল

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ যুক্তরাজ্যের সাউথপোর্টের এক নৃত্যকর্মশালায় ছুরিকাঘাতে তিন শিশুর মৃত্যুর পর হামলাকারীর পরিচয় সংক্রান্ত ভুয়ো তথ্যকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভের নিশানা হয়েছে মূলত মুসলিম এবং অভিবাসীরা।

দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে সহিংস বিশৃঙ্খলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান সহিংসতার তীব্র ভাষায় নিন্দা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার।

গত সপ্তাহের সোমবার আয়োজিত নাচের কর্মশালায় ছুরি হামলার ঘটনায় ওই তিন শিশুর মৃত্যু ছাড়াও আট শিশু এবং দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি গুরুতর জখম হন। আহতরা সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

ঘটনার পর হটাৎই রটে যায়, আক্রমণকারী একজন ‘শরণার্থী মুসলিম যিনি নৌকায় চেপে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন’।

এই ভুয়ো তথ্যকে কেন্দ্র করে সাউথপোর্টের শোকের আবহাওয়া পরিণত হয় ক্ষোভে, যার আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্যের একাধিক শহরে। ফলে সেখানে দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

যদিও এই ঘটনায় অভিযুক্ত হিসাবে অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার নামে যে তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এদিকে, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিক্ষোভকারীদের অনেকেই। দাঙ্গাকারীরা ভাঙচুর চালায়, গাড়িতে এবং শরণার্থীদের আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলেও অভিযোগ। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একাধিক পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর জখম ।

মার্সিসাইড পুলিশ জানিয়েছে, অতি ডানপন্থী ইংলিশ ডিফেন্স লিগের সমর্থকরা এই সহিংসতার জন্য দায়ী।

রদেরহ্যামে শরণার্থীদের আবাসিক এক হোটেলে হামলার নিন্দা জানিয়ে স্যার কিয়ের স্টারমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই সহিংস পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী, “আইনের পূর্ণ শক্তি” দিয়ে তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা হবে।

রোববার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে হোটেলে অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য সহিংস ঘটনার নিন্দা করে অভিযুক্তদের হুঁশিয়ার করেন প্রধানমন্ত্রী ।

“এই গুণ্ডাদের বিচারের আওতায় আনতে যা কিছু দরকার” তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপরই ডাউনিং স্ট্রিটের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিক ‘কোবরা মিটিং’ ডাকা হয়েছে।

যে ঘটনা থেকে সূত্রপাত

সোমবার সাউথপোর্টের হার্ট স্ট্রিটে শিশুদের জন্য একটা নৃত্যকর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল যার থিম ছিল ‘টেলর সুইফ্ট’। এই অনুষ্ঠানে ছুরি হামলায় একাধিক শিশু ও দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে তিন শিশু- বেবে কিং (৬), এলসি ডট স্ট্যানকম্ব (৭) ও অ্যালিস দাসিলভা আগুয়ার (৯) নিহত হয়।

পালানোর সময় জোয়েল ভেরাইট নাম একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের সঙ্গে এক ঝলক দেখা হয় হামলাকারীর।

জোয়েল ভেরাইট স্কাই নিউজকে জানিয়েছেন রক্তাক্ত অবস্থায় এক নারীকে দেখে তিনি সাহায্যের জন্য ছুটে যান এবং হামলাকারীকে ছুরি হাতে দেখতে পান।

“আমি নিচের দরজা খুলি… সিঁড়ির নিচে এক ব্যক্তিকে পুরো ট্র্যাকস্যুট, হুড পরা অবস্থায় ছুরি নিয়ে দেখতে পাই।”

“আমরা একে অপরের দিকে তাকাই আর ও চলে যায়। এই দৃশ্য সম্ভবত বাকি জীবন আমার সঙ্গে থেকে যাবে,” তিনি বলেছিলেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে শহর। মঙ্গলবার, শহরের রাস্তায় প্রথমে আবেগময় সমাবেশ দেখা গিয়েছিল। নিহতদের উদ্দেশ্যে শোক জ্ঞাপন এবং আহতদের দ্রুত সুষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্য প্রার্থনা করতে দেখা যায় কয়েক হাজার মানুষকে।

নিহত তিন বালিকার স্মরণে এবং আহতদের দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য প্রার্থনায় যোগ দেন বহু মানুষ।
নিহত তিন বালিকার স্মরণে এবং আহতদের দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য প্রার্থনায় যোগ দেন বহু মানুষ।

কিন্তু এই শোকের পরিবেশ দ্রুত বদলে যায়। শোকার্তদের সমাবেশের কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ যা ক্রমে সহিংস হয়ে ওঠে। অভিযোগ, ভুয়ো তথ্যকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়ে যায় বিশৃঙ্খলা।

নাচের কর্মশালায় ছুরির হামলার ঘটনায় পুলিশ এক তরুণকে গ্রেফতার করেছে। অভিযুক্ত ল্যাঙ্কাশায়ারের ব্যাঙ্কসের বাসিন্দা অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার বিরুদ্ধে তিনজনের হত্যা, ১০জনকে হত্যাচেষ্টা এবং ধারালো অস্ত্র (রান্নাঘরে ব্যবহৃত একটা বাঁকা ছুরি) রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে জন্ম হয়েছিল এই ১৭ বছরের তরুণের। তার অভিভাবক রুয়ান্ডার বাসিন্দা। ২০১৩ সালে অভিভাবকের সঙ্গে সাউথপোর্ট এলাকায় চলে আসে অ্যাক্সেল মুগানওয়া রুদাকুবানার। পুলিশ জানিয়েছে তার সঙ্গে ইসলামের কোনও যোগ নেই।

কিন্তু ইন্টারনেট মাধ্যমে রটে যায়, ছুরির হামলায় অভিযুক্ত একজন শরণার্থী এবং মুসলিম।

এই তথ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ জন্ম নেয়। মার্সিসাইড সমুদ্র তীরবর্তী শহরে এরপরই বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়। ক্রমে এই বিশৃঙ্খলা সহিংসতার আকার নেয়।

বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রথম দফায় ৩৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন, যাদের মধ্যে আটজনের অবস্থা গুরুতর। এর পাশাপাশি একটা মসজিদে হামলা ও জরুরি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে দফায় দফায় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সহিংস অস্থির পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে । অতি ডানপন্থী ইংলিশ ডিফেন্স লিগের সমর্থকরা এই সহিংসতার জন্য দায়ী বলে জানিয়েছে মার্সিসাইড পুলিশ।

মার্সিসাইড পুলিশ কমিশনার এমিলি স্পুরেল বলেছিলেন, এই “অস্থিরতা” ইতিমধ্যে ট্র্যাজেডিতে জর্জরিত বাসিন্দাদের জন্য জন্য “আরও ক্ষতি ও দুর্ভোগ ডেকে আনবে”।

হোম সেক্রেটারি ইভেট কুপার সহিংসতার তীব্র নিন্দা করেছেন, এই “গুণ্ডামির” সঙ্গে কোনও সম্প্রদায়ের যোগ নেই।

মিডলসব্রোর পার্লামেন্ট রোডে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
মিডলসব্রোর পার্লামেন্ট রোডে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

অস্থির পরিস্থিতি

ট্যামওয়ার্থ, মিডলসব্রো, হাল এবং যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশে একাধিক সহিংসতার ঘটনার মোকাবিলা করতে দেখা যায় পুলিশকে।

সপ্তাহান্তে পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়ে ওঠে। সহিংস বিক্ষোভের সময় লিভারপুল, হাল, ব্রিস্টল, ম্যানচেস্টার, ব্ল্যাকপুল ও বেলফাস্টে বোতল নিক্ষেপ করা হয়। দোকানপাটে লুটপাট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ।

সাউথ ইয়র্কশায়ার পুলিশ জানিয়েছে, রদারহ্যামে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভকারীরা পুলিশদের তাকে করে কাঠের তক্তা ছুড়ে মারলে এবং অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করে স্প্রে করলে কমপক্ষে দশজন পুলিশ কর্মী আহত হন।

বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজন ‘হলিডে ইন এক্সপ্রেস’ নামে এক হোটেলে ঢোকার জন্য প্রথমে তার জানালা ভেঙে দেয়। একটা বড় আস্তাকুড়ের জন্য ব্যবহারকারী বিনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই হোটেলে শরণার্থীদের অনেককে রাখা হয়।

হোটেল কর্মচারী এবং আবাসিকরা (যাদের মধ্যে কেউ কেউ শরণার্থী) “আতঙ্কিত” হয়ে পড়েন।

তবে হতাহতের কোনও খবর নেই বলে পুলিশ জানিয়েছে।

হোম সেক্রেটারি ইভেট কুপার এই পরিস্থিতিকে “অত্যন্ত ভয়াবহ” বলে মন্তব্য করেছেন এবং জানিয়েছেন বিশৃঙ্খলা থামাতে পুলিশের “কঠোর পদক্ষেপ”-এর প্রতি সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

রোববার সন্ধ্যায় একইরকম ঘটনা ঘটে স্টাফোর্ডশায়ারের ট্যামওয়ার্থের আরেক হোটেলে।

স্ট্যাফোর্ডশায়ার পুলিশ জানিয়েছে, ওই হোটেলকে নিশানা করে বিক্ষোভকারীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। হোটেলের জানালা ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে কর্মরত এক পুলিশ আহত হয়েছেন।

এদিকে, মিডলসব্রোতে একদল দাঙ্গাকারীরা বাড়ি ও গাড়ির জানালা ভেঙে দেয় এবং পুলিশদের উপর তাকে করে জিনিস ছুঁড়তে থাকে।

বোল্টনে, অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মুখোমুখি হয় মুখোশধারী ৩০০ জনের একটা দল। মুখোশধারীদের দলকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দিতে শোনা যায়।

এমন ঘটনা রুখতে গ্রেটার ম্যানচেস্টার পুলিশ শহরে ৬০এএ ধারা জারি করেছে যাতে লোকজনকে “তাদের চেহারা গোপন করতে বা মুখ লুকানোর জন্য ব্যবহৃত আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলতে হবে”।

প্রসঙ্গত, সপ্তাহের শুরুতে সাউথপোর্ট, বেলফাস্ট, হার্টলপুল, হাল, লিভারপুল, স্টোক-অন-ট্রেন্ট, নটিংহ্যাম, সান্ডারল্যান্ড এবং অন্যান্য জায়গায় একই ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়।

তবে সব বিক্ষোভই যে সহিংস ছিল, তা নয়। একাধিক জমায়েতে বাসিন্দাদের শান্তিপূর্ণভাবে যোগ দিতে দেখা যায়।

সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের হুঁশিয়ার করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার।
সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের হুঁশিয়ার করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার।

শক্তহাতে বিশৃঙ্খলা দমনের প্রতিশ্রুতি

সহিংস বিশৃঙ্খলতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার । রোববারের ভাষণে তিনি বলেন, “এই দেশের মানুষের নিরাপদে থাকার অধিকার রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা হতে দেখেছি, মসজিদে হামলা হতে দেখেছি।”

“অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একঘরে হয়ে গেছে, রাস্তায় নাৎসি স্যালুট চলছে, পুলিশের উপর হামলা হচ্ছে। বর্ণবাদী বক্তৃতার পাশাপাশি অযৌক্তিক সহিংসতা দেখা যাচ্ছে। তাই এটা ঠিক যা, আমি সেটা বলতে পিছপা হব না- এটা অতি ডানপন্থী গুণ্ডামি।”

তিনি জানিয়েছেন, যারা মুসলিমদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিশানা করছে, মসজিদে হামলা চালাচ্ছে, পুলিশকে আক্রমণ করছে, তাদের সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার জানিয়েছেন, এর জন্য দায়ী ব্যক্তিরা ‘অনুতপ্ত’ হবেন।

এর মধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।


Spread the love

Leave a Reply