ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভান্সের স্ত্রী ও ‘গুরু’ ভারতীয় নারী ঊষা কে?
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হিসাবে বেছে নিয়েছেন জেডি ভান্সকে।
ওই পদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত প্রার্থী হওয়া ছাড়াও জেডি ভান্সের আরও অনেক পরিচয় রয়েছে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর একজন সেনেটর। একই সঙ্গে তিনি লেখক এবং একজন বিনিয়োগকারী, যিনি এক সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচকও ছিলেন। যদিও এখন তিনিই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘রানিং মেট’।
জেডি ভান্সের একটি ভারতীয় যোগও রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে তার স্ত্রী, যিনি একজন ভারতীয়।
এই প্রতিবেদনে জেডি ভান্সের সেই ভারতীয় যোগ, তার স্ত্রী ঊষা ভান্স এবং এই দম্পতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য রয়েছে।
জেডি ভান্সের ভারতীয় যোগ
সোমবার দলের উপ-রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন গ্রহণের জন্য আরএনসি কনভেনশন ফ্লোরে গিয়েছিলেন জেডি ভান্স। সে সময় উপস্থিত সবাই তার দক্ষতা আর অনবদ্য প্রশংসাপত্রের জন্য তাকে সাধুবাদ দেন।
তবে, ওহাইয়োর এই সেনেটর, যাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, আগেই জানিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী ঊষা ভান্সের সিভি বা যোগ্যতার বর্ণনার সামনে তার প্রশংসাপত্র কিছুই নয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচারের আলোয় না আসতে চাইলেও ঊষা ভান্স যে তার স্বামীর ক্যারিয়ারে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন সেটা প্রকাশ্যে অনেকবার স্বীকার করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী মি. ভান্স।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঊষা চিলুকুরিকে ২০১৪ সালে বিয়ে করেন তিনি। তার আগে ২০১৩ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে তাদের পরিচয় হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইয়েল ল স্কুলে পড়ার সময় ‘শ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক অবক্ষয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রথম দেখা হয় তাদের। তারপর অনেকটা পথ একসঙ্গে পেরিয়ে এসেছেন তারা।
বর্তমানে এই দম্পতির তিনটি সন্তান রয়েছে – ইভান, বিবেক ও মিরাবেল।
ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড
ঊষা ভান্স ও তার স্বামীর বেড়ে ওঠা এবং পারিপার্শ্বিক জগত একদম আলাদা।
ঊষা ভান্সের বাবা ও মা ভারত ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। ফলে ঊষা বড় হয়েছেন সান দিয়েগোর শহরতলিতে।
শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তার সাফল্য ছিল বেশ নজরকাড়া। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ঊষা। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের কেরানি হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি।
পেশা হিসাবে ওকালতিকে বেছে নেন তিনি এবং সেটি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন ৩৮ বছর বয়সী ঊষা ভান্স।
প্রায়ই স্ত্রীর প্রশংসা করতে দেখা যায় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জেডি ভান্সকে। ইয়েলে পড়ার সময় থেকেই ঊষা ভান্সকে নিজের ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ বলে মনে করেন তিনি।
স্বামীর বিষয়েও প্রকাশ্যে কথা বলতে শোনা গিয়েছে ঊষা ভান্সকে।
গত মাসে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি জেডিকে বিশ্বাস করি আর খুব ভালোবাসি। দেখা যাক, আমাদের জীবনে কী ঘটতে চলেছে।”
স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ জেডি ভান্স ঊষার বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার কথা প্রকাশ্যেই বলেন।
সিএনএনের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী স্ত্রী সম্পর্কে জেডি ভান্স লিখেছেন, “ও (ঊষা ভান্স) এমন সব প্রশ্ন সহজেই বুঝে যায়, যা আমি জানি না।”
“ঊষা সব সময় এমন সুযোগ লুফে নেওয়ার কথা আমাকে বলে থাকে, যে সুযোগের অস্ত্বিত্ব রয়েছে বলেও আমার জানা থাকে না।”
একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ওর একটা বিস্ময়কর দিকের কথা মানুষ জানে না – কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঊষা এক হাজার পৃষ্ঠার বই আত্মস্থ করে ফেলতে পারে।”
‘দ্য মেগান ক্যালি শো’তে ২০২০ সালে জেডি ভান্স বলেছিলেন, “আমাকে মাটির সঙ্গে জুড়ে রাখে ঊষা। যদি কখনও অহংকারী হয়ে পড়ি, তখন আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই, ও (ঊষা ভান্স) আমার চেয়ে অনেক বেশি সফল।”
একজন ‘শক্তিশালী নারী কণ্ঠ’ হিসাবে তাকে পথ দেখান স্ত্রী ঊষা, জানিয়েছেন জেডি ভান্স।
জেডি ভান্সের ছাত্রজীবন আর কর্মজীবন বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
মিডলটন হাইস্কুল থেকে পাশ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কর্পসে যোগ দেন। পরে ইরাকে মোতায়েন করা হয় তাকে। এরপর ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ইয়েল ল স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন।
পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।
জেডি ভান্সের বেড়ে ওঠা এবং তার ব্যক্তিত্ব শ্রমজীবী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারে ভেবেই তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প মনোনীত করেছেন বলে মনে করা হয়।
কেন তাকে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প?
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ানার গভর্নর মাইক পেন্সকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। খ্রিষ্টান ভোটার, যারা হয়তো মি. ট্রাম্পের মতো তিনবার বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ সাবেক ডেমোক্র্যাটের বিষয়ে কিছুটা ‘সন্দিহান’ ছিলেন, তাদের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলেই মনে করা হয়।
এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক জেডি ভান্সকে। এই সিদ্ধান্তও কিন্তু গতবারের মতোই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের কৌশল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়। পাশাপাশি এই ইঙ্গিতও দেয় যে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসেন তাহলে তিনি কীভাবে শাসন করবেন।
মি. ট্রাম্প জানেন যে এই নির্বাচনে জেতা বা হারা নির্ভর করছে হাতে গোনা শিল্পকেন্দ্রিক মিডওয়েস্ট ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটের উপরে। ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেট’ হলো এমন কয়েকটি অঞ্চল, যেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজ্য জুড়ে জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যে বইয়ের হাত ধরে খ্যাতি
ওহাইয়োর বাসিন্দা মি. ভান্সের লেখা ‘হিলবিলি এলেজি’ নামক স্মৃতিকথার সাফল্য তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় রয়েছে তার লেখা এই বইটি, যেটি অবলম্বনে ছায়াছবিও তৈরি হয়েছে, এটি নেটফ্লিক্সে দেখা যেতে পারে।
মি. ভান্সের জন্ম ওহাইয়োর মিডলটাউনে। ছোটবেলায় তার নাম ছিল জেডি বোম্যান। খুব একটা সুখকর ছিল না তার সেসব দিনের অভিজ্ঞতা।
জেডি ভান্সের বয়স যখন খুবই কম, তখন তার বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। আর মা যুদ্ধ করছিলেন মাদকাসক্তির সঙ্গে। দাদা-দাদী তখন দত্তক নেন তাকে। বর্তমানে তাদের পদবিটাই ব্যবহার করেন জেডি ভান্স।
তাদের সঙ্গে অ্যাপেলেচিয়াতে বাস করতেন মি. ভান্স। এই বিশাল পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চল ডিপ সাউথ থেকে শিল্প-কেন্দ্রিক মিডওয়েস্টের প্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত, যেখানে দেশের কয়েকটি দরিদ্র এলাকাও রয়েছে।
মি. ভান্সের বেড়ে ওঠা, তার চারপাশের পরিস্থিতি, বন্ধু ও পরিজনদের ভুল সিদ্ধান্ত আর অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলা করার যে অভিজ্ঞতা তার বর্ণনা রয়েছে ‘হিলবিলি এলেজিতে’। তার লেখনিতে প্রকাশ পেয়েছে, চারপাশে থাকা মানুষেরা কীভাবে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে এবং সেই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করেছে।
লেখক থেকে সমালোচক
‘হিলবিলি এলেজি’র সাফল্য তাকে শুধুমাত্র সর্বাধিক বিক্রিত বই লেখকদের একজন করে তোলেনি, ভাষ্যকার হিসাবেও তাকে পরিচিতি দিয়েছে। কারণ ভাষ্যকার হিসাবে তাকে বিভিন্ন নামকরা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হতো।
আশা করা হতো এসব অনুষ্ঠানে তিনি শ্বেতাঙ্গ ও শ্রমজীবী ভোটারদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের বিষয়েও মন্তব্য করবেন।
তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করার কোনও সুযোগই ছাড়েননি তিনি।
তিনি ২০১৬ সালের অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি মনে করি এই নির্বাচন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণির ওপর।”
“যেটি ঘটছে সেটি হলো মানুষ একে অপরের দিকে আঙুল তোলার অজুহাত পাচ্ছে। কখনও মেক্সিকান শরণার্থীদের বিষয়ে, কখনও চীনা ব্যবসার উপর এবং কখনও অন্য কোনও বিষয়ে।”
রাজনীতিতে পদার্পন ও উত্থান
ওহাইয়োতে ২০১৭ সালে ফিরে এসে একটি সংস্থায় কাজ শুরু করেন মি. ভান্স।
তার রাজনীতিতে প্রবেশের গুঞ্জন অনেকদিন ধরেই চলছিল। তবে ২০২২ সালে এই গুঞ্জন বাস্তবে পরিণত হয়, যখন ওহাইয়োর রিপাবলিকান সেনেটর রব পোর্টম্যান প্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথমদিকে মি. ভান্সের প্রচারণা বেশ ধীর গতিতে চলছিল। পরে তার প্রাক্তন বস তাকে এক কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করলে তার প্রচারে গতি আসে।
তবে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষিার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনায় দেয়া তার পুরনো বিবৃতি, কারণ ওহাইয়োতে বিপুল সংখ্যক রিপাবলিকান আছেন। পরে সেই মন্তব্যগুলোর জন্য শেষপর্যন্ত ক্ষমা চান তিনি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন পেতেও সক্ষম হন।
এভাবে মি. ভান্স ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’-এর রাজনীতিতে মূল খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমস্ত নীতির সঙ্গেই সহমত প্রকাশ করেন।
ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচিত পদটি পাওয়ার জন্য দৌড়ে শামিল হয়েছেন জেডি ভান্স।
আর তার এই সফরেও পাশে থেকে শক্তি জোগাচ্ছেন স্ত্রী ঊষা ভান্স।