ডিজিএফআই দিয়ে বিচারপতি সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন হাসিনা

Spread the love

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা তার দেশত্যাগের কারণ হিসেবে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এক্সক্লুসিভ এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কীভাবে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সে সময় কী কী ঘটেছিল তার সঙ্গে।

সংবিধানের ষোড়ষ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পদ ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বিচারপতি এস কে সিনহা। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তার কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

গত ১৪ আগস্ট ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বিচারপতি সিনহা বলেন, সরকার তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট তা প্রমাণ করতে প্রস্তুত আছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব, এখন শুধু আমি গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করব এবং প্রমাণ করব যে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলি মিথ্যা।

সাক্ষাৎকারে এস কে সিনহা বিশদ আলোচনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছিলেন এবং ডিজিএফআই সদস্যদের মাধ্যমে তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। কারণ তিনি শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন।

সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো খুবই ভয়ংকর ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কারণ এটি উপলব্ধির প্রশ্ন। একজন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, আমার বাড়িতে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) স্ট্যান্ড গার্ড হিসেবে ছিল। তারা আমার বাড়িতে ঢোকার সময় আমার এক কর্মীকে মারধর করে। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।’

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তার সহকর্মীরা (বিচারক) সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আদালতে তার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানান। প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফেলে তাকে জানানো হয়, হাইকোর্টের বিচারকরা তাকে সহযোগিতা করবেন না।

‘তখন ভেবেছিলাম দেশে থাকার আমার কোনো অধিকার নেই’ বলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা।

তিনি বলেন, ‘তখন আমি ভেবেছিলাম সরকার হয়তো আমাকে দেশে থাকতে দেবে না। আমি তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজ শেষ করেছিলাম (রায়ের সম্পূর্ণ পাঠ্য প্রকাশসহ)। সে সময় আমি এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপান গিয়েছিলাম। কনফারেন্স রুম থেকে বের হওয়ার পর ডিজিএফআই থেকে কল আসে এবং একদিন পর আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। তখন ডিজিএফআই সদস্যরা আমাকে সেখানে উপস্থিত আমার কর্মকর্তাদের কাছে যেতে দিচ্ছিল না। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে তারা আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে যেতে চেয়েছিল। তখন আমি তাদের বলেছিলাম আমার গাড়ির প্রয়োজন নেই। আমি ভাবছিলাম এটি আরেকটি অশনি সংকেত।’

বিচারপতি এস কে সিনহার আরও বলেন, ‘একদিন আদালতে আমি সবেমাত্র আমার কাজ শেষ করেছি। তখন ডিজিএফআই প্রধান আমার অফিসে আসেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম। “আপনি কে এবং আপনি কী বলছেন?” তখন ডিজিএফআই প্রধান বলেন, তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়… আমি তাকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলাম এবং এরপর থেকেই আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।’

এস কে সিনহাই প্রথম প্রধান বিচারপতি, ২০১৭ সালের নভেম্বরে যার দায়িত্বের অবসান হয়েছিল পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সাবেক প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতির দায়ে যার সাজার রায় এসেছে আদালতে।

ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলার মঙ্গলবার তাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। বিচারক শেখ নাজমুল আলম তার রায়ে বলেছেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র অমুসলিম ও আদিবাসী বিচারক, যিনি বিচারাঙ্গণের শীর্ষ পদে পৌঁছেছিলেন।

প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে থেকেই নানা কারণে আলোচিত এস কে সিনহা তার ১০৩০ দিনের দায়িত্বে বার বার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন নানা ঘটনায়।

বয়স অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তবে কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে।

আদালতে আত্মসমর্পণ করব: এস কে সিনহা

সাত বছর আগে জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন সেসময়কার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা যে মিথ্যা ও বানোয়াট তা প্রমাণ করার জন্য দেশে ফিরতে প্রস্তুত।

গত ১৪ আগস্ট ভিডিও কলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ডেইলি স্টারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ফিরব। এখন আমি গ্রিন সিগনালের জন্য অপেক্ষা করছি।’

বিচারপতি এস কে সিনহা বলছিলেন কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছিলেন এবং ডিজিএফআই সদস্যদের মাধ্যমে তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি বলেন, তার (শেখ হাসিনা) নির্দেশ ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন বলেই তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পর নিম্ন আদালত যাতে বড় বড় চোরাকারবারি ও দুর্নীতিবাজদের জামিন দিতে না পারে সেজন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় দাবি করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।

বিচারপতি সিনহা নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণে বিচারকদের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে রেখে শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন এবং ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ষোড়শ সংশোধনীর (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ) মামলার রায় সরকারের অনুকূলে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো ছিল খুবই ভয়ংকর, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা কেবল উপলব্ধি করা যায়। আমি প্রধান বিচারপতি ছিলাম, সেই আমাকেই গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমার বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) পাহারা বসায়। আমার একজন স্টাফ বাসায় ঢুকতে গেলে তাকে পেটানো হয়। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।’

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তার সহকর্মীরা (বিচারপতিরা) সরকারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আদালতে তার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে বলেন যে হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাকে সহযোগিতা করবেন না। এতে তিনি প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েন।

‘তখন আমি ভেবেছিলাম আমার দেশে থাকার কোনো অধিকার নেই’ বলেন এস কে সিনহা।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে আসে।

বিচারপতি সিনহা বলেন, আগের রাতে (২ জুলাই) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে থাকা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের (বর্তমানে মৃত) সঙ্গে বৈঠকের জন্য বঙ্গভবনে ডেকে পাঠান।

তিনি বলেন, বৈঠকে শেখ হাসিনা তাকে পরদিন (৩ জুলাই) সরকারের পক্ষে রায় দিতে বললেও তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

‘আমি ধারণা করতে পারি যে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের সরকারের পক্ষে রায় দিতে রাজি করিয়েছেন। একপর্যায়ে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা চরমে ওঠে এবং আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি এখনই পদত্যাগ করব।

‘তখন তিনি আমাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেন এবং বলেছিলেন আমি পদত্যাগ করলে জনগণ এটা খুব খারাপভাবে নেবে। তিনি আমাকে আমার ইচ্ছামতো কাজ করার কথা বলেন,’ বলেন বিচারপতি সিনহা।

বিচারপতি সিনহা বলেন, ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিষোদগার করেছিলেন।

‘তখন আমি ভেবেছিলাম সরকার হয়তো আমাকে আর দেশে থাকতে দেবে না। আমি তড়িঘড়ি করে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম (রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশসহ) শেষ করেছিলাম। আমি এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপানে গিয়েছিলাম। কনফারেন্স রুম থেকে বের হওয়ার পর ডিজিএফআই থেকে ফোন আসে এবং আমাকে দেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়। একদিন পর আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ঢাকায় বিমানবন্দরে নামার পর দেখতে পাই পাঁচ-ছয়জন ডিজিএফআই সদস্য আমাকে ঘিরে রেখেছে। তারা সেখানে উপস্থিত আমার কর্মকর্তাদের কাছে যেতে দিচ্ছিলেন না। একজন লম্বামতো লোক আমাকে বললেন, তারা আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খেতে চান এবং আমাকে তাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে বলেন। আমি তাদের ভাষা সংযত করতে বলি এবং প্রোটোকল মানতে বলি। রেগে গিয়ে বলি, ‘গেট লস্ট’। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে তারা আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে চেয়েছিল। আমি তাদের বলি যে আমার একটি গাড়ি এবং নিরাপত্তা আছে। আমার তাদের কোনো দরকার নেই এবং চলে যাই। এটা ছিল আরেকটি বাজে সংকেত।’

‘আমি আদালতে সুপ্রিম কোর্টে যাই। একদিন আমি সবেমাত্র আমার কাজ শেষ করেছি তখনই ডিজিএফআই প্রধান আমার অফিসে আসেন। তিনি আমাকে বলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম ‘আপনি কে এবং আপনি এসব কী বলছেন? ডিজিএফআই প্রধান বলেন, তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর আদেশ বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়। আমি তাকে বেরিয়ে যেতে বলি। এরপর আমি ঘরে ফিরে গেলে আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।’

‘সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আমাকে বলেছিলেন যে তাদের কিছু করার নেই। তিনি আমাকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিতে বলেছিলেন। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সেক্রেটারি সাত দিনের ছুটির জন্য একটি দরখাস্ত তৈরি করেছিলেন এবং আমি তাতে সই করেছিলাম। বিকেলে আমি বাসায় ফিরে দেখি আমার বাসভবনের সমস্ত দরজা বন্ধ।

সাদাপোশাকে সেনা সদস্যরা আমার বাসভবনের ভেতরের সব জিনিসপত্র দখলে নিয়েছিল। আমার বাসার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

পরদিন সকাল ১০টার দিকে আমি আমার আবাসিক অফিসে আমার কাজ করছিলাম। মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আমাকে ফোন করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাকে আমার বাসায় আসতে বলেছিলাম। তিনি (ওয়াহহাব) আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন। তিনি বলেন, তার বাসায় অন্য বিচারপতিরা আছেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, এখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি তাদের আমার বাসায় আসার জন্য ডাকলাম। তখন তারা এসে আমাকে জানায় যে, তারা আমার সঙ্গে আদালতে বসবে না। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। সরকারের প্রভাবিত হয়ে তারা (বিচারপতিরা) এই অবৈধ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

এ অবস্থার মধ্যেই ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা।

বিচারপতি সিনহার অনুপস্থিতিতে তৎকালীন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ওয়াহাব প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বিচারপতি সিনহা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে অভিনন্দন জানান।

সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরতে প্রস্তুত।

‘আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমি দেশে ফিরব। আমি সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছি। আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করব এবং প্রমাণ করব যে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো মিথ্যা।’

২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর বিদেশে থাকা অবস্থায় প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করা বিচারপতি সিনহা অর্থপাচারের তিনটি মামলায় অভিযুক্ত। একটি মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং আরও দুটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।


Spread the love

Leave a Reply