ডিবি অফিসে নির্যাতনের বর্ণনা সমন্বয়ক বারেকের: একজন বলে ওরে ঝুলা, এরপর ঝুলিয়ে মারা হয়
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। সে সময় ডিবি অফিসে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। গতকাল সোমবার এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি ডিবি অফিসের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ডিবি হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘তুই শিবির’। আমি দৃঢ়ভাবে এ কথার প্রতিবাদ জানাই। তিনি উচ্চস্বরে নানা অভিযোগ দিতে চাইলে, আমি তার প্রতিবাদ জানাই। এরপর আমাকে ওপরে একটি রুমে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। এক জন বলে ‘তোর তো বয়স বেশি না, ট্রেনিং পাইছোস কই’। আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। এরপর আরেক জন বলে এরে ঝুলা। এরপরই আমার হাত ওপরে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়। মারধরের এক পর্যায়ে পানি চাইলে ওরা বোতলের ছিপিতে করে পানি দেয়।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাকের বলেন, ‘ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন আমি, নাহিদ ভাই ও আসিফ ভাইকে ডিবি হারুনের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে। আমাদের বলতেছিল, আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না! দেখোস নাই, নূরুরে কি করে ছেড়ে দিছি! নূরু এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে। এক পর্যায়ে সে আমাকে বলে, ‘তুই শিবির’। আমি বলি, ‘না আমি শিবির না’ সে আবারও (একটু উচ্চশব্দে) বলে, ‘না, তুই শিবির’। আমি এবার ওর থেকে উচ্চস্বরে বলি ‘না’। সে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখ, সে কীভাবে কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘এরপর সে এক অফিসারকে ইশারা দিয়ে আমাদের তিন জনকে তিনটি আলাদা রুমে নিয়ে যেতে বলে। রুমে যাওয়ার তিন-চার মিনিট পর দুই জন লোক এসে আমাকে দরজায় আসতে বলে। দরজায় আসার সাথে সাথে তারা হাতে থাকা কালো একটি বড় টুপি দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে ফেলে ও হাতে হাতকড়া পরায়। এরপর বামে-ডানে ঘুরিয়ে হাঁটানো হয়। বারবার মনে হচ্ছিল, ছাদের কাছে নিয়ে ফেলে দেয় কি না। ওপরে একটি রুমে নিয়ে গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে চোখ বাঁধল আর হাতগুলোও বড় গামছা দিয়ে বাঁধল। তারপর উলটো ঘুরে এক পায়ে দাঁড়াতে বলে।’ বাকের বলেন, টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমানোর জন্য শরীরে ব্যালেন্স ছিল না তখন। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হই। শেষে সোজা হয়েই দাঁড়াতে বলে এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আমাকে শুরুতেই বলে, ‘তুই তো জুনের ৯ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছোস, তোর তো আন্দোলনকে বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে? তোর তো বয়স বেশি না! ট্রেনিং পাইছোস কই?’ এই কথার উত্তরে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা জানাই। তারপর কিছুক্ষণ পেঁচায়!
বাকের বলেন, ‘এমন অসংখ্য প্রশ্ন জিগ্যেস করে। সর্বশেষ বলে, সরকার তো কোটা নিয়ে সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছে, তারপরও এখন কীসের আন্দোলন? আমি চুপ থাকি, ওরা চিল্লাপাল্লা করে, ঝাড়াঝাড়ি করে, তখনো চুপ থাকি। এক জেন বলে ওঠে, ওরে ঝুলা। আমি তখনো চুপ থাকি। তারপর পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে হাত ওপরে ঝুলিয়ে বাধা হয়। আমি তাদের বলি, পিঠে মারলে মরে যাব, বাম পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাম পা-টা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না। একপর্যায়ে নিতম্বে মোটা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, আর আমি চিল্লানো দিয়ে উঠি, আর ওরা বলে, প্রাইম মিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি? আমি বলি, ‘না’। এরকমভাবেই চলতে থাকে। মারধরের এক পর্যায়ে আমি পানি চাইলে বোতলের ছিপি করে এক ছিপি পরিমাণ পানি দিয়েছিল। জিহ্বা-গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বেধড়ক মারার পর এক পর্যায়ে সামনে থেকে কেউ এক জন বলে, ওরে রেস্ট দে। বড় নিঃশ্বাস নিলাম।’