তালেবানদের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে এক বাবা যে কৌশল নিয়েছিলেন
ডেস্ক রিপোর্টঃ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের কুন্দুজের একটি গলিতে খেলা করছিল নিলোফার আয়ুব। সে সময় একটা থাপ্পড়ের ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটি।
যখন ওর বয়স ছিল মাত্র চার বছর, তখন একজন বিশালাকায় দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি তাকে অশালীন ভাবে স্পর্শ করে।
গালে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারার পরে নিলোফারকে সেই ব্যক্তি ধমকে বলেছিল বোরখা না পরলে, তাঁর বাবাকে ছেড়ে কথা বলা হবে না।
সেই ঘটনার ২৩ বছর পরে, বিবিসির রেডিও অনুষ্ঠান ‘আউটলুক’-এ একটি সাক্ষাৎকারে মিজ আয়ুব বলেন, “সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি পৌঁছেছিলাম। বাবার মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছিল। রাগে তাঁর পুরো শরীর কাঁপছিল।”
“আমার মনে আছে, বাবা রেগে গোটা ঘরে পায়চারি করছিলেন। তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন- ওর সাহস কী করে হল তোমাকে ছোঁয়ার। এরপর একটা বড় সিদ্ধান্ত নেন। উনি মাকে কাঁচি আনতে বলেন আর তারপর আমার চুল কেটে ফেলে,” তিনি বলেছিলেন।
বাবা আমার মাকে বলেন, “ওকে ছেলেদের জামা পরাও।”
আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের প্রথম পর্যায় নিলোফার বড় হয়েছেন। সময়টা ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর মাঝের। তালেবানদের শরীয়া আইন থেকে বাঁচতে নিজের জীবনের দশটা বছর তিনি ছেলে সেজে কাটিয়েছেন।
নিজেদের মতো করে তালিবানরা শরীয়া আইনের ব্যাখ্যা করে আর তাঁদের অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করে।
মিজ আয়ুব বর্তমানে পোল্যান্ডে বসবাস করেন। ছেলেবেলার ঘটনা মনে করে তিনি বলেন, “সেই দিনগুলোতে আফগানিস্তানে বড় হওয়ার মানে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষণশীল অঞ্চলে বেড়ে ওঠা।”
“এখানে, অধিকার নির্ধারণ করা হয় আপনি পুরুষ বা মহিলা কি না তাঁর বিচারে,” নিলোফার আয়ুব বলেছিলেন।
ছেলেবেলার দিনগুলো
নিলোফারের জন্ম ১৯৯৬ সালে, পাসপোর্টে যদিও লেখা রয়েছে, ১৯৯৩।
মার্কিন সেনা ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আসার পর তালেবানরা পিছু হটতেই, নিলোফারের বাবা তাকে স্কুলে ভর্তির চেষ্টা শুরু করেন। তিনি চাইছিলেন, মেয়ে যত দ্রুত সম্ভব স্কুলে ভর্তি হোক।
মিজ আয়ুব জানিয়েছেন, কুন্দুজ নারীদের জন্য থাকা সহজ ছিল না। নারী তো ছেড়ে দিন, পুরুষদের পক্ষেও এই শহরে থাকা কঠিন ছিল।
তিনি বলেন, “আফগানিস্তানে ছেলে হওয়াটা আপনা থেকেই একটা শক্তি জোগায়। আপনার বয়স যদি দুই হয় তাহলে আপনি সেই মায়ের চাইতে বেশি সম্মান পাবেন যিনি আপনার জন্ম দিয়েছেন। আর বয়স চার হলে তো জন্মদাত্রী মায়ের অভিভাবক হয়ে ওঠে ছেলেরা। তাঁর (মায়ের) অবস্থা হয় দাসীর মতো। একজন নারী হিসেবে আপনি কোথাও স্থান নেই; একেবারে অদৃশ্যই।”
এই কারণে পরিবারের মেয়েদেরকে ছেলেদের মতো পোশাক পরানোর বিষয়টা সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে বলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
যদি কোনও পরিবারে সামনে দাঁড় করানোর মতো পুরুষ না থাকে, তাহলে যে কোনও সম্পদশালী ব্যক্তিই সেখানকার মহিলা সদস্যের কাছাকাছি পৌঁছে তাঁকে নিজের স্ত্রী বানানোর চেষ্টা করবে।
তাঁর (নিলোফারের) কথায়, “আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম ছিল। পরিবারে পুরুষ সদস্য থাকায়, আমরা স্বাধীন ভাবে থাকতে পেরেছিলাম।”
স্বাধীনতা
অদ্ভুত ভাবে চুল কাটা আর ভাইয়ের জামা পরে যে নিলোফারের জীবনটাই পুরো বদলে যেতে চলেছে, সেটা বোধহয় তিনি আন্দাজ করেননি।
“আমার ভাইদের সঙ্গে যেমনটা করা হত, আমিও ঠিক সেই রকম ব্যবহারই পেতাম। আমি ছেলেদের পোশাক পরে বাবার সঙ্গে বাজারে যেতে পারতাম, বাসে চেপে ঘুরে বেরাতে পারতাম। আশপাশের ছেলেরা আমার বন্ধু হয়ে গেছিল। আমি সারাটা দিন বাড়ির বাইরে খেলতাম,” ছেলেবেলার স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বলেছেন মিজ আয়ুব।
তাঁর বাকী বোনদের পরিস্থিতি কিন্তু আফগানিস্তানের অন্য নারীদের মতোই ছিল। মাথা ঢেকে তাঁদের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকতে হত। পোশাক দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হত নিজেদের যাতে শরীরের কোনও অংশ দেখা না যায়। নিলোফারের বাবা এই বিষয়টিকে ঘেন্না করতেন।
মিজ আয়ুব বলেন, “প্রথাগত হলুদ রঙের জামা পরার পক্ষে আমার বাবা একেবারেই ছিলেন না। কেন আমাদের সঠিক ভাবে পোশাক পরানো হয় না, সে বিষয়ে বাবা প্রায়শই মায়ের সঙ্গে ঝগড়াও করতেন। বলতেন কেন আমাদের ঢিলেঢালা, বৃহদাকার জামা পরানো হয়।”
বাস্তবতার ছোঁয়া
তেরো বছর বয়সে, নিলোফার একটি কঠোর জুডো প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসেন। পায়ে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলেন তিনি। কোনও মতে বিছানায় গিয়ে বিশ্রাম করতে চাইছিলেন। বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পা বেয়ে রক্তের ধারা বেরিয়ে আসতে দেখেন। ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন নিলোফার কিন্তু তিনি কখনই বুঝতে পারেননি যে তাঁর জীবন একটি নতুন মোড় নিয়েছে।
“পরের দিন আমি আমার এক মেয়ে বন্ধুকে বিষয়টি জানাই। সে হাসতে থাকে। আমাকে বলে, ‘তুমি একটা বোকা। তোমার বোনেরা কি এ বিষয়ে কিছু বলেনি?” তিনি বলেছিলেন।
এই বন্ধুই তাকে এই ‘রহস্যময়’ বিষয়টি সম্পর্কে বলেন আর বুঝিয়ে বলেন, টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা স্যানিটারি ন্যাপকিনের গুরুত্ব কী।
তিনি বলেন, “বাড়ি ফেরার পর মা আমার পোশাকে কিছু একটা দেখতে পান। কাছে এসে আমায় ভাল বোধ করানোর বদলে অভিশাপ দিতে থাকেন যে কেন আমি এত দ্রুত বড় হচ্ছি।”
নিলোফারের জীবন তাঁর আর তাঁর অন্যান্য মেয়েদের জীবনের মতো হয়ে যাবে এটা ভেবেই মা কাঁদতে থাকেন। তাঁদের জীবন চার দেয়ালের মাঝে বদ্ধ ছিল।
বিদ্রোহের স্বর
একজন কিশোর হিসেবে বেড়ে ওঠাটা নিলোফারের জীবনকে বিদ্রোহে ভরিয়ে দিয়েছিল। এই কারণেই মেয়েদের শরীরের পরিবর্তনগুলি বুঝিয়ে বলার জন্য একটি ‘গ্রুপ’ তৈরি করেন।
এই মনোভাবই তাকে ভারতে গিয়ে পড়াশোনা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিয়ে সম্পর্কে ধারণাগুলি গঠনের ক্ষেত্রেও এটা সাহায্য করেছিল।
“আমি অনেক বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি। যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাবা এ বিষয়ে আমায় নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলে দিয়েছিলেন, ও (নিলোফার) এখনই বিয়ে করতে যাচ্ছে না। আগে পড়াশোনা শেষ করবে তারপর ও ঠিক করবে কি হবে,” নিলোফার আয়ুব বলেন।
শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। নিলোফারের বাবার মৃত্যুর পর যে শূন্যস্থানটা তৈরি হয়েছিল, সেটা তাঁর স্বামী পূরণ করেন।
তাঁর কথায় “অবশ্যই বাবার জায়গাটা নেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু উনি (নিলোফারের স্বামী) সেই ভূমিকা পালন করেছেন। উনি খুবই সাহায্য করেছেন আমায়।”
বেরিয়ে আসার রাস্তা
মিজ আয়ুবের পরিবার শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসে। তাঁরা রাজধানী কাবুলে পৌঁছে একাধিক আসবাবপত্রের দোকান খোলেন। এক সময় ৩০০ জন কর্মচারী তাঁর দোকাগুলিতে কাজ করত। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন এমন নারী যাঁদের কোন পুরুষ অভিভাবক ছিল না।
কিন্তু ২০২১ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানরা আবার ফিরে আসে। এটা নিলোফার এবং তাঁর পরিবারের জন্য গা ঢাকা দেওয়ার সময় ছিল।
কাবুলের রাস্তায় বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর তিনি তাঁর কর্মস্থলের কাছে আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। আর তাঁর মা এবং বোনরা শহরের অন্য প্রান্তে চলে যান। নিলোফার কিন্তু তাঁদের নাগালের বাইরে চলে যান।
সে সময় তিনি আফগানিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে আগ্রহী সাংবাদিকদের সে বিষয়ে তথ্য জানাচ্ছিলেন।
পোল্যান্ড-এর এক সাংবাদিক মিজ আয়ুবকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি ও তার পরিবার আফগানিস্তান ছাড়ার অনুমতি পেতে পারে এমন ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন কি না।
“আমি বললাম না। এ কথা শুনে তিনি বলেন, আমায় এক ঘণ্টা সময় দিন,” নিলোফার আয়ুব স্মরণ করেন।
এরপর একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তার নাম যোগ করা হয় এবং তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাবুল বিমানবন্দরে পৌঁছাতে বলা হয়। নিলোফার সঙ্গে আনেন শুধুমাত্র দুটি ব্যাকপ্যাক ।
“আমার মা সেখানে কোরান হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই শেষবারের মতো আমার মা আর বাড়িকে দেখেছিলাম,” তিনি বলেন।
একটা নতুন জীবন
মিজ আয়ুব ও তাঁর পরিবার বর্তমানে পোল্যান্ডে বসবাস করেন। আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিমানে ওঠার আগে তিনি এই দেশ (পোল্যান্ড) সম্পর্কে খুব কমই জানতেন তিনি।
কিন্তু সমস্ত বাধার সম্মুখীন হয়েও তিনি আজ একজন এমন আইনজীবী যিনি নিজের দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করেন। ইতিমধ্যে ব্রাসেলস, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন নিলোফার। সেখানকার মানুষকে তাঁর জীবনের কথাও বলেছেন।
তাঁর কথায়, “আমার জীবন ছিল অভিশাপের পাশাপাশি আশীর্বাদও।”
মিজ আয়ুব বলেন, “অভিশাপ কারণ এটি আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে,” তিনি বলেন।
“আমি পুরোপুরি নারী বা পুরুষ হতে পারি না। তবে এটিও একটি আশীর্বাদ বলেই প্রমাণ হয়েছিল। আমি দুটো অভিজ্ঞতাই পেয়েছি। আজ আমি একজন শক্তিশালী নারীতে পরিণত করেছে আমায়। আজ আমি সেই শক্তিশালী নারীই।”
(বিবিসি রেডিওর অনুষ্ঠান ‘আউটলুক’-এ সম্প্রচার হওয়া নিলোফারের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাফেল আবুচাই।)