থানায় নেই পুলিশ, পোড়া ভবনের সামনে দগ্ধ গাড়ির সারি
থানা ভবনের সামনে আগুনে পোড়া গাড়ির সারি। ভেতরে ঢোকার কলাপসিবল গেট ভাঙা। ভবনে ঢুকে চোখে পড়ল ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। নথিপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। থানা থেকে লুটপাট করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা জিনিসপত্র। থানায় নেই কোনো পুলিশ সদস্য।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে এই চিত্র দেখা গেল। শুধু মোহাম্মদপুর নয়, আদাবর, মিরপুরসহ কয়েকটি থানায় গিয়ে প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে দেখা গেল, ভবনের সামনে তিনজনের মরদেহ পড়ে আছে। এর মধ্যে দুজনের মরদেহে পুলিশের পোশাক। আরেকটি মরদেহের হাতে হাতকড়া পরানো।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ থানা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুটপাট করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
সাতমসজিদ রোডের পাশে মোহাম্মদপুর থানার অবস্থান। স্থানীয় লোকজন জানান, গতকাল সোমবার সারা দিন থানা ঘেরাও করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা। বিকেলের দিকে ব্যাপক গুলির শব্দ শুনতে পান তাঁরা। পরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ থানা ছেড়ে যায়। এরপরই দুর্বৃত্তরা থানায় ঢুকে লুটপাট চালায়।
আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে পোড়া তিনতলা থানা ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। থানার চত্বরে শ খানেক গাড়ি। এগুলো পুলিশের ব্যবহৃত ও আটক করা গাড়ি। অধিকাংশ গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। বাকিগুলোতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
থানার নিচতলায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষসহ, অন্যান কর্মকর্তা ও কর্তব্যরত কর্মকর্তার (ডিউটি অফিসার) কক্ষ। নিচতলার মতো দ্বিতীয় তলায় পুলিশের মোহাম্মদপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনারের কক্ষ আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে। মেঝেতে থানার নথিপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। তৃতীয় তলায় পুলিশের ব্যারাকের মেস। সেখানে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের পোশাক দেয়ালে ঝুলছে। তাদের কাপড়চোপড় লেপ–তোশক লন্ডভন্ড।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দুর্বৃত্তরা থানা থেকে টেলিফোন সেট, কম্পিউটার ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), আগ্নেয়াস্ত্র ও রসদ সরঞ্জামাদি লুট করে নিয়ে গেছে।
আজ সকালে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট হচ্ছে। গাড়ি থেকে যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
উপকমিশনারের কার্যালয় ভাঙচুর
শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উল্টো দিকে খিলজি রোডে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়। পুলিশ জানায়, বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা–কর্মচারী পালিয়ে যান। এরপর সেখানে ঢুকে পড়ে দুর্বৃত্তরা।
আজ দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে কাচের টুকরা। উপকমিশনারের কার্যালয়ের প্রধান ফটক ভাঙা। উপকমিশনার কার্যালয়, অভ্যর্থনা ও অফিস কক্ষের দরজা-জানালা, এসিসহ মালামাল খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। উপকমিশনার কার্যালয়ে ভাঙচুরের পর তার পাশের আরেকটি কার্যালয়ে দুই দফায় আগুন দেওয়া হয়। দুই দফায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মোবারক আলী প্রথম আলোকে বলেন, রাতে আগুন নেভায় ফায়ার সার্ভিস। পরে সকালে আরেক দফা আগুন দেওয়া হলে তা–ও তাঁরা নিভিয়েছেন।
মোহাম্মদপুর রিং রোডের পাশে আদাবর থানা। সেখানে গিয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়। থানার সামনে পুলিশের চারটি পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। থানা ভবনে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। থানার উল্টো দিকের রাস্তায় জব্দ গাড়ির ডাম্পিং। সেগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে পোড়া গাড়ি থেকে যন্ত্রাংশ খুলে নিতে দেখা যায় কিশোর-তরুণদের।
পুলিশ জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে আদাবর থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যান। আদাবর থানার প্রধান ফটকে তালাবদ্ধ থাকায় ভেতরে ঢোকা যায়নি।
মিরপুর মডেল থানায় আগুন
এর আগে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, পোড়া ভবনের সামনের রাস্তায় সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। ভেতরে তথ্য সংগ্রহের জন্য যেতে চাইলে তাঁরা যেতে দেননি।
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রধান ফটকে তালা
দুপুর ১২টার দিকে ফুলবাড়িয়ার পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো পুলিশ সদস্য নেই। মূল ফটক তালাবদ্ধ। তবে অভ্যর্থনা কক্ষে কয়েকজনকে পাওয়া যায়। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের নিরাপত্তাকর্মী তাঁরা। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের মূল ভবনে লুটপাট করা হয়। সেই ভবনে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তবে তাঁরা এই প্রতিবেদককে ভেতরে যেতে দেননি।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ের ফটকে কয়েকজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। তাঁরা নিজেদের পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে জানান, ভেতরে কোনো কর্মকর্তা নেই। ভেতরে কোনো ভাঙচুর হয়নি। তবে কার্যালয়ের ভেতরে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এ সময় ডিবির অভ্যর্থনা কক্ষে কাউকে দেখা যায়নি।
বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। বাইরের ফটক তালাবদ্ধ ছিল। প্রায় একই সময়ে ডিএমপি সদর দপ্তরের মূল ফটকে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। তবে গেটটি তালাবদ্ধ ছিল।