নতুন সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৪ বছর
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভাবতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তিনি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে ভারতের কাছে আমরা অভিযোগ দিয়েছি। বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থায় সমাধান হওয়া উচিত। আল জাজিরা টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আরও বলেছেন, সংস্কারের মাধ্যমে আসা সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৪ বছর। শেখ হাসিনার বিচার ইস্যুতে তিনি বলেন, ভারতের কাছে তাকে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা আকস্মিক দেশ ছেড়ে পালানোতে প্রত্যেকে বিস্মিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করেন তিনি। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়েও মন্তব্য করেন ড. ইউনূস।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে ডনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় সহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ করেছিলেন, তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রশাসনের সম্পর্ক উত্তেজনাকর হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মত দেন। কিন্তু ড. ইউনূস বলেছেন- বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দল ডেমোক্রেটের অনেক সদস্য যেমন তার বন্ধু, তেমনি রিপাবলিকান দলেও তার বন্ধু আছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট তার ওপর তাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে না। তাদের পররাষ্ট্রনীতি স্থিতিশীল। একবার একদিকে, আবার অন্যদিকে তা যায় না। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সমালোচনা করেন ড. ইউনূস। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু এবং তাতে বাংলাদেশের ঝুঁকি, বিশ্বের ঝুঁকি এবং করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন নোবেল পুরস্কার পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) এ যোগ দেন ড. ইউনূস। সেখানে তার সাক্ষাৎকার নেন আল জাজিরার বিশেষ সংবাদদাতা নিক ক্লার্ক। তিনি বলেন, যেখানে বিশ্বে মনোযোগ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নিবদ্ধ, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকিতে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। দেশটি ২০৫০ সালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের জলসীমা উচ্চতার ফলে শতকরা ১৭ ভাগ ভূমি হারাতে পারে। ফলে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষিজমি নিশ্চিহ্ন হতে পারে এবং লাখ লাখ মানুষকে বিপন্ন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশগত হুমকির চেয়েও আরও সংকট মোকাবিলা করছে।
ড. ইউনূসের কাছে নিক ক্লার্ক জানতে চান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে, আপনি বাকুতে বিশ্বের অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শীর্ষ কপ-২৯ এ যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আপনি এই সম্মেলন থেকে কী আশা করছেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, প্রথমত জলবায়ুর নেতিবাচক দিক সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করা। বিশ্বের অনেক দেশই এ বিষয়ে অসচেতন। জলবায়ু সংকট একটি দেশের অস্তিত্বের সমস্যা। বিশেষ করে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য এই সংকট মোকাবিলা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূস বলেন- এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে চাই। জলবায়ু সংকট নিয়ে সরব হওয়ার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করি। তা হচ্ছে- জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিক্ষিপ্ত কোনো পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। যেহেতু এটা বৈশ্বিক সমস্যা। সুতরাং আমি মনে করি বিক্ষিপ্তভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ না করে এই সংকট বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করা উচিত। তবে প্রকল্পের গুরুত্বও আমি অস্বীকার করছি না। অবশ্যই এই সমস্যা মোকাবিলা বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তবে এক্ষেত্রে আমাদের অব্যবস্থাপনা এড়িয়ে চলতে হবে। আপনি একদিকে পরিবেশের ক্ষতি করছেন আবার অন্যদিকে সে ক্ষতিসাধনের জন্য কাজ করছেন। কিন্তু আপনি পরিবেশ ক্ষতির যে ধারা গঠিত হয়েছে তা বন্ধ করছেন না, তাহলে তো হবে না। এ জন্যই আমি বললাম, যখন গোটা পদ্ধতিই ক্ষতির কারণ তখন কেন আপনি কিছু কিছু করে সমাধান করতে থাকেন। সুতরাং আমি নিজে নিজে একটি প্রস্তাবনা কল্পনা করেছি। তা হচ্ছে- জলবায়ু সংকট মোকাবিলার মৌলিক উপায় প্রকল্পের পরিবর্তে প্রকল্প দাঁড় করানো নয়। জলবায়ু আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত তাই আমি এ বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই আমার কথা হচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রার অভ্যাসের পরিবর্তন না হলে পরিবেশের মৌলিক সমস্যাটি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
জলবায়ু পরিস্থিতি এবং অতি বন্যায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান কমিয়ে আনতে সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশের আগাম ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, এটি মোকাবিলা করার জন্য সংকট তৈরিতে সহায়ক সকল বিষয় বন্ধ করতে হবে। নইলে এ সমস্য ক্রমাগতভাবে হতেই থাকবে। আমরা এসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি বলছি, পরিকল্পনা গ্রহণ সাময়িক বিষয়ের জন্য ঠিক আছে। তবে মৌলিক নীতির দিক থেকে সাময়িক সমাধান এটি ভুল জিনিস। কেননা আপনাকে চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সমস্যাযুক্ত গোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমি বারবার আমাদের মূলে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। কেননা, আমরা এই সমস্যার কোনো ইতি টানতে পারছি না। যা বাংলাদেশ সহ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই খারাপ হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশ বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগও ছিল। তখনকার সমস্যাগুলো যেন এখন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অব্যবস্থাপনা, অপশাসন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করা এবং আরও নানান অপকর্মে ভরে উঠেছিল বাংলাদেশের বিগত ১৬টি বছর। এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে উত্তরণের জন্য আমাদের বিশাল কাজ রয়েছে। প্রতিটি খাত ধরে ধরে আমাদের তা স্বচ্ছ করতে হবে। তবে এটা সাময়িক সময়ের জন্য করলে হবে না। পুরনো নীতিতে চলা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করছে তাতে জনগণ সরকারি কার্যালয়ে যেতে ভয় পায়। কেননা সেখানকার কেউ টাকা চেয়ে আপনাকে হয়রান করতে পারে। যদিও এ বিষয়টি লজ্জার; তবুও আমি এখানে তা উল্লেখ করলাম। সরকারকে জনগণের সহায়ক হতে হবে। এখন নাগরিকরা সরকারি অফিসগুলোকে নির্যাতনের চেম্বার হিসেবে দেখে। আপনি একবার সেখানে প্রবেশ করলে তাদের কেউ আপনার কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য আপনাকে চেপে ধরবে। গোটা ব্যবস্থাপনাতেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলার পুরোটাই হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ এই অর্থের তহবিল কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, তা জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, আমরা যা করতে চাই তার সঙ্গে তহবিলের সম্পর্ক খুব সামান্য। আমরা আমাদের জন্য একটি উপায় হচ্ছে- সরকারি সার্ভিসের ক্ষেত্রে জনগণকে যেন সরকারি অফিসগুলোতে স্বশরীরে উপস্থিত হতে না হয়। এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবশত ডিজিটাইজেশন আমাদের সাহায্য করতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব। আর্থিক সেবাসহ অন্যান্য আরও সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেয়া সম্ভব। তাই আমরা কর ব্যবস্থার মতো সিস্টেমকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করার চেষ্টা করছি। অন্য কোনো পদ্ধতিতে হয়তো কাউকে আপনাকে অর্থ প্রদানে বাধ্য করা হতে পারে।
ড. ইউনূস আরও বলেন, আমাদেরকে একত্রে কাজ করতে হবে। এর অর্থ হলো এই সমস্যার সমাধান শুধু বাংলাদেশ করতে পারে না। আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত থেকে আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ হলো নদীগুলোর সবটার উৎস হলো ভারতে না হয় তা ভারতের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, নেপাল থেকে এসেছে, আরও উত্তর থেকে ভারতে এসে তারপর তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর বাংলাদেশে এসে বেশির ভাগ বড় নদী শেষ হয়েছে। এখানে নদীগুলো বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। ফলে নদীগুলোর উৎস তিব্বত, নেপাল, ভারতের কোনো না কোনো স্থানে। তাই আমাদের একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনা সিস্টেম থাকতে হবে, যেখানে পানির কারণে মানুষ মারা না গিয়ে তা থেকে সুবিধা পান। একত্রে আমাদের একটি ভালো পানি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত এটা শুধু কোনো এক দেশের পক্ষে করা সম্ভব না। ভারতের সঙ্গে আলোচনা, অবশ্যই, ভারত হলো সেই দেশ বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা।
ড. ইউনূসের কাছে প্রশ্নকর্তা জানতে চান- তিনি (শেখ হাসিনা) সেখানে (ভারত) অবস্থান করা এবং সেখান থেকে বিবৃতি এবং ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি আপনার প্রশাসন কীভাবে দেখছে? এ প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, তিনি যেটা করছেন সে সম্পর্কে আমরা অভিযোগ দিয়েছি। এটা বাংলাদেশকে একরকম অস্থিতিশীল করার চেষ্টা। কারণ, তিনি বাংলাদেশের ভেতরে আন্দোলন চালানোর জন্য বিবৃতি, বক্তব্য ও আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহায়ক হবে না। ফলে আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সেটা হলো আপনারা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এটা ভালো। কিন্তু আপনাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের জন্য তিনি যেন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করেন। এমন হলে আমরা আবার পেছনে ফিরবো এবং আপনাদের (ভারত) কাছে অভিযোগ করবো যে, আমাদের জন্য খারাপ এমন ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছেন। তাই আমি মনে করি এ বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থায় সমাধান হওয়া উচিত। তিনি অবশ্য নিজেকে এখনো (বাংলাদেশের) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবেন। তিনি নিজেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়।
ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এমনকি তাকে (শেখ হাসিনা) ভারত পর্যন্ত বলে আসছে তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং তার আশ্রয়দাতারা তাকে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য স্বীকৃতি দিচ্ছে না। এ অবস্থায় তাকে কি দেশে ফেরত পাঠানোর চাপ দিয়ে যাবেন আপনারা? এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন- হ্যাঁ। কারণ, আইনগত প্রক্রিয়া চলমান। তাকে অভিযুক্ত পাওয়া গেছে। অবশ্যই আমরা তাকে ফেরত দেয়ার আহ্বান জানাবো।
এ পর্যায়ে ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। বলা হয়, প্রাথমিকভাবে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন আপনি। কিন্তু এর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে বলে আলোচনা আছে। আসলে বাস্তবতা কি? জবাবে ড. ইউনূস বলেন- না। কেউ কেউ বলছেন স্বল্প সময়ের (সরকার এটা)। কখনোই এটাকে স্বল্পমেয়াদি হিসেবে কল্পনা করা হয়নি। পুরো সরকারের প্রধান আকর্ষণ ছিল সংস্কার। কারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে পুরো আন্দোলনই হলো একটি নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। তাদের কাছে নতুন শব্দ ছিল নতুন বাংলাদেশ। শুধু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়েই একটি নতুন বাংলাদেশ আসবে না। একটি নির্বাচন করা পুরনো রাজনীতি এবং তারই কিছু ধারাবাহিকতার পুনরাবৃত্তি। এসব বিষয় থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। পুরো দেশের মানুষ এটাই চায়। পুরনোর চেয়ে কিছু আলাদা, কিছু নতুন জিনিস। সুতরাং এর অর্থ অনেক কিছু। এর অর্থ হলো আইন ব্যবস্থার সংস্কার। কারণ, বিচার বিভাগকে (বিগত) সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। পুরো দুর্নীতিপরায়ণ করা হয়েছে এবং আরও অনেক কিছু। পুরো পুলিশ ব্যবস্থা সহ অনেক কিছুকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সর্বোপরি সংবিধানের সংস্কার প্রয়োজন। সংবিধানের একেবারে মৌলিক আইনগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে আপনি সংবিধানকে নতুন করে সাজাবেন? এ জন্য আমরা নতুন করে ডিজাইন করেছি, নিয়োগ দিয়েছি, কমিশন করেছি। এর মধ্যে আছে প্রাতিষ্ঠানিক কমিশন, আইন সংস্কার কমিশন, সবকিছু। আছে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন। এ জন্য সময় লাগছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তারা রিপোর্ট জমা দেবেন। ওইসব রিপোর্ট জমা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হবে না। হ্যাঁ, এটাই পুরো ধারণা। আমি আগেই বলেছি সমান্তরালে দু’টি বিষয় চলছে। এক. নির্বাচনের প্রস্তুতি। দুই. সব রকম সংস্কারের প্রস্তুতি। ব্যাস। এখন বিষয়টি জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে যে কোন পথে যাবে। আমি বলবো মনে রাখবেন, নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে ট্রেন। শিগগিরই নির্বাচনের কাছে চলে যাবে। এই ট্রেন ছুটছে। সুতরাং এক পর্যায়ে একটি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবে তা। আমরা দেশের জনগণের কাছে জানতে চাইবো আপনারা কি এই সিস্টেমে চলতে পছন্দ করেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নির্বাচন চায় জনগণ। এ জন্য আপনাকে কিছু করতে হবে। বিষয়টি নির্ভর করছে আপনার ওপর। আমাদের ওপর নয়। এটা তাদের বিষয়। সবসময় আমরা বলে আসছি আপনাদের সঙ্গে আমরা পরামর্শ করছি। কোনো কিছুই চাপিয়ে দিচ্ছি না আমরা। যদি আপনারা বলেন- সামনে এগিয়ে যান, নির্বাচন দিন, সংস্কারের কথা ভুলে যান, তাহলে আমরা নির্বাচন করবো। যদি আপনারা বলেন- না। তাহলে ‘না’। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অন্য কোনো সরকার এটা করতে পারবে না। পুরো ইতিহাসে এই সরকারটি সৌভাগ্যবান যে, আপনি সব কাজ করতে পারবেন। যদি রাজনৈতিক দলগুলো এর সঙ্গে একমত থাকেন, তাহলে তা করা যাবে। আমরা সংস্কার করে নির্বাচন দেবো। প্রশ্নকর্তা জানতে চান- তাহলে সঠিক সময় কখন হবে, সে সম্পর্কে আপনার মনে কি অনুমিত কোনো ধারণা আছে? অথবা অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে প্রস্তুতি নিতে সুনির্দিষ্টভাবে কতো সময় লাগবে। জবাবে ড. ইউনূস বলেন- না। আমার কোনো ধারণা নেই। আমি তো মনে করি সবারই অন্তর্বর্তী সরকার আছে। আমরা স্থায়ী সরকার নই। উদাহরণ হিসেবে মনে করুন, আমাদের এখানে নিয়মিত সরকারের মেয়াদ হয় ৫ বছর। এটাই বিষয়। কিন্তু নতুন সংবিধানে সম্ভবত এর মেয়াদ করা হচ্ছে ৪ বছর। কারণ, জনগণ দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হতে চায়। এ জন্য এর মেয়াদ ৪ বছরের নিচে থাকা উচিত। এটা নিশ্চিত। এর চেয়ে কমও হতে পারে। তবে বিষয়টি হলো জনগণের, তারা কি চায়। রাজনৈতিক দলগুলো কি চায়। যদি রাজনৈতিক দলগুলো বলে এসব বিষয় ভুলে যান, নির্বাচন দিন। এসব আমাদেরকে করতে দিন। তাহলে আমরা তাই করবো। আপনার সামনে একটি সুযোগ এসেছে। তা নেননি। এ পর্যায়ে প্রশ্নকর্তা জানতে চান- ফলে ৪ বছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে পারতেন আপনি, যেটা মোটামুটি নির্বাচনী টার্মের মতোই, তাই নয় কি? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি সেটা বলিনি। আমি বলিনি যে, ৪ বছরের জন্য আমি থাকবো। আমি বলেছি- এটাই যে কারও (সরকার) জন্য সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। ঠিক আছে। আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব কাজ শেষ করা। এ পর্যায়ে প্রশ্নকর্তা তার কাছে জানতে চান- আপনি কি নির্বাচন করবেন? সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন- না। আমি কোনো রাজনীতিক নই। আমার ভূমিকা, যেটা এখন চালিয়ে যাচ্ছি, তা-ই উপভোগ করছি। আমার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এসব বিষয়কে পরিবর্তন করার চেষ্টাও করছি না।
নিক ক্লার্ক জানতে চান- সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি আপনার প্রশাসন যেভাবে মোকাবিলা করছে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এসব ইস্যুকে সমাধানে কীভাবে পরিকল্পনা নিয়েছেন আপনি? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, বার বার এ ইস্যুতে দৃষ্টি দিয়েছি আমরা। কারণ, আমরা স্মরণে রেখেছি যে, সবাই এ দেশের নাগরিক। সংবিধান আপনাদের অধিকার, স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, নিজস্ব ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছে। সংবিধান এসব অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো সংবিধানের অধীনে যেসব অধিকারের গ্যারান্টি দেয়া আছে তা যেন নাগরিকরা নিশ্চিতভাবে উপভোগ করতে পারেন।
ওই সাংবাদিক আরও জানতে চান, কিন্তু হিন্দু সহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার রিপোর্ট আছে, তাই নয় কি? এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নয়। আমি বলবো ক্রমাবনতিশীল সহিংসতা। বিপ্লবের সময়ে সহিংসতা শুরু হয়েছিল। কারণ, এটা নয় যে, তারা হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী। এর কারণ হলো তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা ছিলেন ওইসব আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। তাই তারা (জনতা) তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এরা তারা, যেসব মানুষ আওয়ামী লীগার হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। প্রশ্নকর্তা জানতে চান- এই বিভক্তির মধ্যে কীভাবে আপনি সেতুবন্ধন রচনা করবেন? এসব সমস্যার কীভাবে সমাধান করবেন। ইস্যুটি হলো এই অংশগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে লেগে আছে। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি মনে করি না যে, বিভিন্ন উপাংশ একে অন্যের বিরুদ্ধে লেগে আছে। আমি বলি এটা একটি পুরো পরিবার। আমাদের মতবিরোধ থাকতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা একে অন্যের শত্রু। এটাই আইন। অধিকারের বিষয় আছে। আমাদের কাজ হলো প্রতিটি নাগরিকের সব অধিকার নিশ্চিত করা।
প্রশ্নকর্তা তার কাছে আবার জানতে চান- অবশ্যই আপনি জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এ বিষয়টিকে লুফে নিয়েছেন তার নির্বাচনের আগে। তাই নয় কি? বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তার নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, অবশ্যই। এটা মূলত প্রপাগান্ডা। এটা পুরোটাই ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা। এটা দুর্ভাগ্যজনক। যেকোনো কারণে এই প্রপাগান্ডার বেশির ভাগই ছড়ানো হচ্ছে ভারতের দিক থেকে। উদ্দেশ্য উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসবের কিছুই বিদ্যমান নেই। অধিক হারে উদ্যাপিত হয়েছে পূজা। এমন ঘটনাও আছে। তাতে যোগ দিয়েছেন হিন্দুরা। কয়েক হাজার পূজা বিষয়ক স্থাপনায় এই পূজা উদ্যাপন হয়েছে। কোনো অঘটন ছাড়াই তা চলেছে।
ড. ইউনূসের কাছে নিক ক্লার্ক জানতে চান, আচ্ছা আপনার ও তার (ট্রাম্প) মধ্যে তেমন ভালো সম্পর্ক যায়নি, তাই না? সুনির্দিষ্ট একটি টেনশন আছে। আমার মনে হয়, আমি ঠিক বলতে যাচ্ছি। আপনার এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এর আগে ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। সুতরাং ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। যদি আপনি রিপাবলিকান পার্টির বিষয়ে কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো ডেমোক্রেট পার্টিতে আমার বন্ধু আছেন। রিপাবলিকান পার্টিতেও আমার বন্ধু আছেন। আমাকে দেয়া কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেলের জন্য ভোট দিয়েছিল হাউস (কংগ্রেস)। উভয় দল শতভাগ সম্মতি দিয়েছিল এতে। তাই সেখানে আমার কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং রিপাবলিকান পার্টি অথবা ডেমোক্রেট পার্টি অথবা ট্রাম্প উদ্বিগ্ন হলে এ পর্যন্ত আমার তাতে কোনো রকম সমস্যা হবে না। তাই আকস্মিকভাবে নেতিবাচক কিছু ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, ট্রাম্প হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আমি মনে করি, কে প্রেসিডেন্ট তার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়ে একবার সামনে, একবার পেছনে যায় না। এটা তাদের একটি স্থিতিশীল নীতি। ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে আপনি কি মনে করেন, এ অঞ্চলে তিনি ভিন্ন অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হবেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, একেবারেই না।
পাল্টা প্রশ্নে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আপনি যদি বাংলাদেশে থাকতেন, তাহলে এ ধরনের কথাবার্তায় পাগলের মতো মনে হতো। এই ছাত্ররা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন, তাদের জীবন দিয়েছেন, সব দিক থেকে তাদের (শাসক গোষ্ঠী) বাড়িঘরের দিকে উত্তেজিত জনতা এগিয়ে যাচ্ছিল, লাখ লাখ জনতা তাদের বাড়িঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। অবশেষে তার (শেখ হাসিনা) পরিবারের সদস্যরা তাকে পালিয়ে যেতে বলেছেন। কারণ, উত্তেজিত এই জনতা তার বাড়ি প্রবেশ করে নিয়ন্ত্রণ নেবে। এ জন্য তারা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছিল। তাকে পালিয়ে যেতে এবং পালিয়ে ভারতে যেতে সহায়তা করেছে সেনাবাহিনী। এভাবেই সব ঘটেছে। ফলে এটা কারও কাছ থেকে বিভ্রান্ত হওয়া নয়, ধরুন কেউ কিছু সেনা পাঠিয়ে দিলো, কাউকে পাঠিয়ে দিলো- বিষয়টি এমন নয়। এটা ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। তাতে যোগ দিয়েছিল সারা দেশের মানুষ।
যা ঘটতে যাচ্ছিল তাতে আপনি কি তা বুঝতে পেরেছিলেন, বিস্মিত হয়েছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি তো দেশে ছিলাম না। ফলে ঘটনার পরিবর্তন আমি দেখতে পাইনি। আমি শুধু মিডিয়ায় দেখতে পেয়েছি। কি ঘটেছিল আমি শুধু তার ফলটুকু দেখতে পেয়েছি। আমাকে সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। টেলিফোন কল পেয়েছি। তাতে বলা হয়েছে সরকার গঠনে আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তিন দিন দেশ ছিল সরকারবিহীন। এ সময়ে আমি দেশে ছিলাম না। তারপর দেশে পৌঁছে দায়িত্ব নিলাম এবং সরকার গঠন করলাম। এই ধরনের অনিশ্চয়তায় এবং পূর্বাভাস করা হয়নি- এমন ঘটনা ঘটছিল। কোথাও থেকে এটা যে ঘটতে চলেছে তা কেউ পরিকল্পনাও করেনি। এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এসব ঘটনা যখন ঘটছিল এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেছেন, তখন কি আপনি বিস্মিত হয়েছিলেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এত আকস্মিকভাবে এটা ঘটেছে যে, প্রত্যেকেই এতে বিস্মিত হয়েছেন। তিনি (শেখ হাসিনা) খুব সুরক্ষিত ছিলেন। কেউই ভাবেননি যে, তিনি বাস্তবেই পালিয়ে যেতে পারেন। ছাত্ররা আসছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল জনতা। সারা দেশের সব রকম মানুষ যোগ দিয়েছিল ছাত্রদের সঙ্গে। সারা দেশে প্রচুর পরিমাণে মানুষ জমায়েত হচ্ছিল। তারা ঢাকামুখী যাত্রা করেছিল। তার (হাসিনা) বাসভবনমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। সুতরাং এসব কিছু এর আগে শোনা যায়নি। এসব বিষয় কোনো পরিকল্পনা করে করা হয়নি। কেউ জানতেন না যে, এটাই ঘটবে। পুরো দেশ ছিল তার (হাসিনা) বিরুদ্ধে। তাই এমন কিছু যে ঘটবে তা ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা ঘটেছে। পুরো দেশ তার বিরুদ্ধে ছিল। যখন আমি বলি পুরো দেশ, তখন এর মানে হলো পুরো দেশ তাদের বিরুদ্ধে ছিল।
প্রশ্নকর্তা তার কাছে জানতে চান- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য যখন আপনি ফোনকল পেলেন, তখন আপনাকে কতোটা বিবেচনা করতে হয়েছিল? তাৎক্ষণিক জবাবে কি বলেছিলেন ঠিক আছে আমরা এটা করবো? জবাবে ড. ইউনূস বলেন- দেখুন আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে, আমি রাজনীতিতে যুক্ত হতে চাই না। সব সময় আমি এটা (রাজনীতি) থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। তাই আমার মনে হয়েছে আমার এতে যুক্ত হওয়া উচিত হবে না। আমি বলেছিলাম দেশ চালানোর জন্য অন্য কাউকে দেখুন, আমাকে নয়। পরের দিন আমাকে কল করবেন, দেখি আপনারা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যথারীতি তারা আমাকে পরেরদিন কল করলেন। তারা বললেন, আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক ও আলোচনা করেছি। তাই আপনার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। আপনাকে অনুগ্রহ করে সম্মতি দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, দেখো তোমরা এর জন্য জীবন দিয়েছো। এর জন্য এত দুর্ভোগের শিকার হয়েছো। এরই মধ্যে যদি তোমরা এতকিছু করে থাকো, তাহলে আগে আমি যা বলেছিলাম তা ভুলে যাবো এবং আমি তোমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবো। আমি ফিরে আসবো। এ জন্যই ফিরে এসেছি।
ড. ইউনূসের কাছে নিক ক্লার্ক জানতে চান- বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী নয়। বর্তমান আর্থিক সংকটের মধ্যে আইএমএফের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে এই অর্থনীতি। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি এবং কীভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসবেন বলে আপনি আস্থাশীল? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এটা (অর্থনীতি) ভয়াবহ অবস্থায়। আমাদের পুরো অর্থনীতি ভয়াবহ এক অবস্থায় আছে। পূর্ববর্তী সরকার অনেক বড় প্রকল্প করেছে। এক বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প এদিক- সেদিক করেছে। পুরো ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের বন্ধুবান্ধব ও অন্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের এই ধ্বংসাত্মক কাজের কারণে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় নিম্নমুখী হয়েছে। যখন আমরা (ক্ষমতায়) ফিরলাম, তখন পুরো সিস্টেমকে আমরা বিধ্বস্ত অবস্থায় পাই। অর্থনীতি ছিল অকার্যকর এবং একই রকম আরও অনেক কিছু। সৌভাগ্যক্রমে বিশ্ব আমাদেরকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে। প্রতিটি জায়গা থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ সাপোর্ট পেয়েছি। তারা টিকে থাকতে, অব্যাহত ধারাবাহিকতা রক্ষা ও অন্যান্য কাজে সহায়তা করবে। এ জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা সরকারগুলো এবং অন্যদের কাছে গিয়েছি আমাদের সহায়তা করার জন্য। আর্থিক সহায়তা করার জন্য। সিস্টেমকে সহায়তা দেয়ার জন্য। তারা আমাদের প্রতি খুবই উষ্ণ সমর্থন দেখিয়েছেন। তাদের সহায়তা আমাদেরকে ব্যাংকিং খাতের সব সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেছে, একে সঠিক পথে আনতে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন ও বড় অংকের পাওনা পরিশোধে সহায়তা করেছে। আমাদের যেটুকু রিজার্ভ বা আন্তর্জাতিক রিজার্ভ আছে তাতে হাত না দিয়ে বড় বড় অংকের পেমেন্ট এরই মধ্যে পরিশোধ করেছি। ড. ইউনূসের কাছে আল জাজিরা জানতে চায়- কীভাবে এবং কখন এই পরিবর্তিত ব্যবস্থা রাস্তার মানুষ, রাস্তার নারী ও পুরুষদের সুবিধা দেবে? তারা নিজেদেরকে মনে করবেন তারা অর্থ খরচের সক্ষমতা রাখেন। ড. ইউনূস বলেন, এরই মধ্যে তারা এটা অনুধাবন করছে। কারণ, এখন যে সিস্টেম আছে তার ওপর তারা নির্ভর করতে পারেন। ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের বৈদেশিক বিনিময় অদৃশ্য হচ্ছে না। প্রতি মাসে আমাদের বৈদেশিক বিনিময় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মানুষ আস্থা পাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আস্থা ফিরে আসছে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিক নিক ক্লার্ক আরও জানতে চান, বাংলাদেশের ভেতরে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে উঠতে চলেছে- এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? প্রথমত ছাত্রদের নেতৃত্বে ‘মুনসুন বিপ্লব’ হয়েছে। এই বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আপনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই নয় কি? কিন্তু যেকোনো নতুন সরকারের ভেতরে কি দলাদলির বিপদ থাকে না? ড. ইউনূস এ প্রশ্নের জবাবে বলেন- না। দেখতে পাচ্ছি তারা প্রচলিত রাজনৈতিক দল। তারা যথেষ্ট মুক্ত। সদ্যবিদায়ী শাসকগোষ্ঠীর অধীনে এর আগে এসব মানুষ কার্যকর থাকতে পারেননি। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন জেলে। শত সহস্র এসব নেতাকর্মী জেলে ছিলেন। তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারা এখন সক্রিয়। এ জন্য পুরনো রাজনৈতিক দল ও অন্যরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। তারা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। এটা নিয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। রাজনৈতিক সিস্টেমে কোনো সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তারা এখন অপেক্ষা করছেন সংস্কার প্রক্রিয়ায় এবং নির্বাচনে কীভাবে অংশগ্রহণ করা যায় তার জন্য। প্রশ্নকর্তা জানতে চান- এসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বর্তমানে যাদের অস্তিত্ব আছে। তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের জন্য এগিয়ে আসবেন। জবাবে ড. ইউনূস বলেন- একেবারে। এ পর্যায়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রচুর সম্মান অর্জন করেছেন, বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তা সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক প্রকল্প নিয়ে, দীর্ঘমেয়াদে ঋণের চক্রে এর প্রভাব নিয়ে কিছুটা সমালোচনা আছে। আপনি কি এসব সমালোচনার সঙ্গে একমত? জবাবে ড. ইউনূস বলেন- না। আমি একমত নই। কারণ তারা প্রতিটি কাহিনীকে নিয়ে গল্প তৈরি করেন। তারা অনেক কিছু পছন্দ করেন না। এ নিয়ে চিন্তা করেন না। তবে কেউ কেউ তা করেন। তার মধ্যে এটা একটা। যখন আপনি কোনো কিছুতে ইন্টারেস্ট (সুদ) দেখবেন তখনই তারা সেটাকে সামনে নিয়ে আসবে। ইন্টারেস্ট (সুদ) একটি শব্দ। ধর্ম এটাকে সমর্থন করে না। আমি বলি ধর্ম এ সম্পর্কে যেটা বলেছে সেটা অতিমাত্রায় বিপদগামী করার মতো সুদ নেয়ার বিষয়ে। আমরা সার্ভিসটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে সুদ আরোপ করেছি সেটার বিরুদ্ধে নয়। আরেকটি দিক হলো রাজনৈতিক। যদি দেখা যায় কেউ খুব জনপ্রিয় হচ্ছেন, তখন তার নিন্দা জানাতে হবে। এটা ভালো বিষয় যে, আমি আগের সরকারের হাতে হয়রানির শিকার হয়েছি। আমাকে প্রায় জেলে পাঠানো হয়েছিল। বিগত শাসকগোষ্ঠীর সময়ে আমার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২০০ মামলা হয়েছে আদালতে। এটা হলো গল্পের আরেকটি দিক। আমাকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম আছে। এর নাম ড্রামা ইন আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি শহরে কাজ করছে তারা। আমি কাজ করছি নিখুঁত রেকর্ডসহ। ফলে এটা একেবারে স্বচ্ছ। বাংলাদেশে কি ঘটেছে সে বিষয়টি ভুলে যান। আপনি দৃষ্টি দিয়েছেন মাইক্রোগ্রিডের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে সিস্টেমে চলা, স্বচ্ছ সিস্টেমে চলা মাইক্রোগ্রিডের দিকে কেন তাকাচ্ছেন না? সেখানে নারীরা ঋণ নিচ্ছেন। তারা এক লাখ ডলার নিচ্ছেন এবং সুদের প্রতিটি পেনি সহ অর্থ পরিশোধ করছেন। তাদের কেউই ঋণ খেলাপি নন। তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ শতকরা ৯৯ ভাগ বা তারও বেশি। সব শহরে, অথবা ৩৫টি শহরে এর বিস্তার। যুক্তরাষ্ট্রে এর সবাই নারী। তাদের বেশির ভাগই অভিবাসী নারী। আছেন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের। তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। ফলে তারাই এই ঋণ নিচ্ছেন। সুতরাং কেউ যদি বলতে চায় ক্ষুদ্রঋণ খারাপ, তাহলে খুঁজে বের করুন স্বচ্ছ বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ খারাপ কিনা, যেদেশে দুর্নীতি বিস্তার করে আছে। এসব নিয়ে আপনি অনেক গল্প ফাঁদতে পারবেন। এখানে (গ্রামীণ ব্যাংক) সব কিছুই স্বচ্ছ। খতিয়ে দেখুন সিস্টেম কাজ করছে কিনা। জনগণ এটাকে পছন্দ করছে কিনা। আমরা অনিশ্চিত এক বৈশ্বিক সময়ে এখন। বিশেষ করে জলবায়ু বিষয়ক এই অনিশ্চিত সময়ে। এ সময়ে অনেক কিছুর অবনতি হচ্ছে। প্রশ্নকর্তা তার কাছে জানতে চান- উগ্রবাদ আরও খারাপ হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার দেশের মতো দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে বিশ্ব ও বাংলাদেশের ভূমিকা কি? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমি কোনো রাজনীতিক নই। এ বিষয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ, গবেষণা দিতে পারবো না। তাই কোনো মন্তব্য করবো না। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যা মনে করে তা হলো আমরা সবাই বন্ধু। আমরা চাই সবাই একে অন্যের সহায়ক। এ জন্যই আমরা একসঙ্গে কাজ করি।
প্রশ্ন- আপনি যখন নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকান তখন কি মনে হয় কখনো ভেবেছেন বর্তমানে যে ভূমিকায় আছেন, দেশের নেতৃত্বে সেখানে পৌঁছবেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন- এটা খুব মজার বিষয়। কারণ, লোকজন সবসময় বলে যে, আপনি দেশ চালাবেন। তাদেরকে আমি সব সময় বলেছি- না। না। আমি না। কিন্তু এখন আমাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর কয়েক বছর আগে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় চলছিল, তখন আমি চেষ্টা করেছি। সেনাবাহিনী বলেছিল আপনি এখন ক্ষমতা নিন। তাদের প্রস্তাবের জবাবে বলেছি- না। আমি না। অন্য কাউকে বেছে নিন। তারা পুরো একটি রাত অপেক্ষা করলো। কিন্তু আমি বললাম- না। আমি এই ‘না’ কথাটির ওপরই অটল থাকলাম। ক্ষমতা নিইনি। তারপর থেকে যখনই কিছু ঘটে তখনই লোকজন খোঁজে কে হবেন সরকার প্রধান। এই ধারা চলছেই। এটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। যখনই এমন ঘটনা সামনে এসেছে তখনই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি এবারের মতোই বলেছি- না। আমি না। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার বার বারের ইতিহাস আছে আমার। কিন্তু এবারই প্রথম আমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তারপর রাজি হয়েছি।