নয়াপল্টনমুখী বিএনপি নেতাকর্মীদের স্রোত
ডেস্ক রিপোর্টঃ জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে রাজধানীতে বড় তিন দলের সমাবেশ। সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপি’র মহাসমাবেশ। একই কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি’র সমমনা দল ও জোট। এই সমাবেশের পাল্টা শান্তি সমাবেশ আওয়ামী লীগের। পাশাপাশি অনেক দিন পর আজ ঢাকায় মহা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। যদিও সমাবেশের কোনো অনুমতি পায়নি দলটি। তবে গত রাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ওদিকে বড় তিন দলের এই সমাবেশ ঘিরে রাজনীতিতে কৌতূহল, উত্তাপ। কী হবে এই রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে। বিরোধীদের কর্মসূচি থেকে পরবর্তী কেমন কর্মসূচি আসছে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা নানা মহলে।
অনেকে বলছেন, নির্বাচনের আগে আজকের রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনের রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে দিতে পারে। বিরোধীরা নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে কতোটা সক্ষম তার একটা ইঙ্গিত মিলতে পারে আজকের কর্মসূচি থেকে। পাশপাশি ক্ষমতাসীন দল চাইবে পাল্টা বড় সমাবেশ করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে। তাই আজ পুরো দেশের দৃষ্টি থাকবে রাজধানীতে। ঢাকায় আজ দৃষ্টি রাখবে কূটনীতিক দুনিয়াও। দলগুলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে পরবর্তী কর্মসূচি দেবে এমনটা আগে থেকেই বলে আসছে। তারপরও উদ্বেগ উৎকণ্ঠার শেষ নেই। বিশেষ করে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার বিষয়টি আগেই জানিয়ে দেয়ার পরও তাদের সমাবেশ প্রস্তুতি নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। যদিও দলটির তরফে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের কথাই বলা হচ্ছে।
শক্তির মহড়া দিতে রাজধানীতে কয়েকশ’ গজ দূরত্বে সমাবেশ করবে বড় তিন দল। নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ থেকেই সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। মহাসমাবেশ সফল করতে স্মরণকালের সর্ববৃহত্তম লোকসমাগম করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে দলটি। মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে জানিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারি দল যদি কোনো রকমের বাড়াবাড়ি করে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। ওদিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শাপলা চত্বরে যেকোনো মূল্যে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। ওদিকে নিজেদের শক্তির মহড়া দিতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া। গত দু’দিন ধরেই তারা রাজধানীতে মিছিল, শোডাউন করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তির মহড়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি, গ্রেপ্তার অভিযানে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে আন্তর্জাতিক বিশ্বও। নানা সতর্কতা জারি করছেন তাদের দেশের নাগরিকদের প্রতি। তিন দলের মহাসমাবেশকে ঘিরে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসনও। দু’দিন আগে থেকেই রাজধানীর প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে র্যাব-পুলিশের চেকপোস্ট। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় চালানো হয়েছে গ্রেপ্তার অভিযান।
এদিকে গত ১২ই জুলাই সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও সমমনা ৩৬টি রাজনৈতিক দল। এরপর তিন ধাপে জেলায় জেলায় রোডমার্চ, পদযাত্রা, সমাবেশ, যুব সমাবেশ, শ্রমিক কনভেনশন, ছাত্র কনভেনশন, পেশাজীবী কনভেনশনসহ লাগাতার নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। সর্বশেষ গত ১৮ই অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দীর্ঘ চার মাস ধরে সরকার পতনের একদফা দাবিতে রাজপথে থাকা বিএনপি আন্দোলনকে এবার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চায়। সেই লক্ষ্যে আজ নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করবে দলটি। বেলা ২টায় শুরু হবে মহাসমাবেশ। সেই মহাসমাবেশ থেকে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবে তারা। মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রাখবেন।
ওদিকে একই দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো রাজধানীতে সমাবেশ করবে আজ। সকাল ১১টায় বিজয়নগর হোটেল ৭১-এর সামনে এবি পার্টি, একই সময়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদ, বেলা ১১টায় বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে গণঅধিকার পরিষদ (নুর), দুপুর ১২টায় মতিঝিল নটর ডেম কলেজের উল্টোদিকে গণফোরাম ও পিপল্স পার্টি, বেলা ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণতান্ত্রিক বামঐক্য, বেলা ২টায় বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে জনতার অধিকার পার্টি, একইস্থানে একইসময়ে ১২দলীয় জোট, দুপুর ২টায় পুরানা পল্টন আলরাজি কমপ্লেক্সের সামনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বিকাল ৩টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, তিনটায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণতন্ত্র মঞ্চ, তিনটায় কাওরানবাজার এফডিসি সংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ের সামনে এলডিপি, একইসময়ে মালিবাগ মোড়ে এনডিএম, একই সময়ে পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে গণঅধিকার পরিষদ (রেজা), বিকাল ৪টায় পুরানা পল্টন মোড়ে লেবার পার্টির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
আসছে ঘেরাওসহ নিয়মিত কর্মসূচি: মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে সমমনা শরিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে বিএনপি। এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। শেষধাপের কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপি’র নীতি-নির্ধারণী ফোরামের এক নেতা মানবজমিনকে জানান, ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশ শেষে চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। একদিন বিরতি দিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর থেকে সচিবালয় অভিমুখে ঘেরাও কিংবা পদযাত্রা দিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন, আদালতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও, অবস্থান কর্মসূচি, রেলপথ, নৌপথ অবরোধ, ঢাকা অবরোধসহ নিয়মিত নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তবে সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করে কর্মসূচির ধরনও পরিবর্তন করা হতে পারে। এছাড়া তফসিল ঘোষণার দিন থেকে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নয়াপল্টনমুখী বিএনপি নেতাকর্মীদের স্রোত: মহাসমাবেশে যোগ দিতে শুক্রবার জুমার পর থেকেই নয়াপল্টনে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। পুলিশের কড়াকড়ির শিথিলতা দেখে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ভিড় করতে থাকেন তারা। বিকাল হতেই সহস্রাধিক নেতাকর্মী জড়ো হয়ে যান। তারা স্লোগানে স্লোগানে সরগরম করে তোলেন নয়াপল্টন এলাকা। দলের নেতারা নয়াপল্টন এলাকা ছেড়ে দেয়ার নির্দেশনা দিলেও জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা তা কর্ণপাত করেননি। জুমার নামাজের পর থেকেই মূলত এলাকায় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মো. আব্বাস আলী হ্যান্ডমাইক নিয়ে তাদের নির্দেশনা প্রচার করছেন। সড়কে যেন যানবাহন চলাচল বন্ধ না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখার জন্য নেতাকর্মীদের মাইকে বলা হয়। আসরের পর নয়াপল্টনে অন্তত ৫ সহস্রাধিক নেতাকর্মী জড়ো হন। এ সময় বিএনপি কার্যালয়ের বিপরীত সড়কে কয়েকজন রিকশাচালককে তাদের রিকশা দাঁড় করিয়ে বিএনপি’র মহাসমাবেশের পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এদিকে নয়াপল্টন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। বাড়তি নিরাপত্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
যে কৌশলে ঢাকায় আসছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা: পুলিশি গ্রেপ্তার ও তল্লাশি এড়িয়ে নানা কৌশলে ঢাকায় আসছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিশোরগঞ্জ থেকে সবজি বিক্রেতা সেজে ঢাকায় আসা মালেক বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় সবজি নিয়ে ঢাকায় এসেছি। কাওরান বাজারে ওইগুলো বিক্রি করে সেখানেই রাতে ছিলাম। সকালে এখানে আশপাশে ঘুরছিলাম। এখন লোক জমছে দেখে অফিসের (বিএনপি’র কার্যালয়ের) সামনে এসেছি। কুতুবদিয়া উপজেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, আমরা ঢাকার বাইরে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছি আমাদের কর্মসূচি সফল করতে। আমাদের যাওয়ার অন্য কোনো জায়গা নেই তাই নয়াপল্টনে অবস্থান করছি। গ্রেপ্তার হলেও আমরা এখানে অবস্থান করবো। বিজয় অর্জন না করে ঘরে ফিরবো না। পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছেন আব্দুল জলিল। সঙ্গে করে আরও দু’জনকে নিয়ে এসেছেন তিনি। ঢাকায় ঢুকতে বাধা এড়াতে অনেক কর্মী কয়েকদিন আগেই ঢাকায় প্রবেশ করেছেন। যার সম্ভব হয়েছে আত্মীয় বাড়িতে এসে উঠেছেন। কেউ আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ থেকে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসার নাম করে তিনদিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন নুর আলম। তিনি বলেন, গত তিনদিন ধরে ঢাকায় আছি। প্রত্যেকদিনই আসি কার্যালয়ের সামনে। ভালো লাগে। বিএনপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় প্রবেশ করা বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা হাসপাতালে ভর্তির নাম করে ঢাকায় এসেছেন। তারা বলেন, চিকিৎসার পাশাপাশি সমাবেশে যোগ দিতে তাদের আসা। রাজধানীর একটি হাসপাতালে রোগী নিয়ে এসেছিলেন জানিয়ে জয়পুরহাট থেকে আসা আউয়াল বলেন, আমি ভর্তি ছিলাম না। তবে সঙ্গে রাতে রোগী ছিল। তার সঙ্গেই আসছি। তারে ডাক্তার দেখিয়ে ভর্তি করে আসছি।