পিয়াইনগুল কলিমূল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব : ফেলে আসা সোনালী দিনের স্মৃতি…
নজরুল ইসলাম মাসুমঃ
৯১ সাল, জানুয়ারী মাসের কোন এক সকালে আমার হাইস্কুল জীবনের যাত্রাশুরু। স্কুলের নাম, পিয়াইনগুল কলিমুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়। আমাদের অনেক স্মৃতি আর আবেগের একটি কেন্দ্র। যে বিদ্যালয়ের প্রতিটি ধুলু-বালু কনার সাথে হৃদয়ের গভীরতম আবেগ আর অনুভূতি জড়িত। সেই শৈশব-কৈশোরের প্ররম্ভে, ধুরু ধুরু বুকে মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা স্কুলে যেতাম, সেই সময়ের এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর বর্তমান বাস্তবতা অনেকটাই পাল্টে গেছে! পাল্টে গেছে এখনকার মানুষের আবেগ-অনুভুতির ধরনও। সময়ের পরিক্রমায়, বৈশ্বিক জীবন ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। সে এক অন্য ইস্যু।
আসি আমার আজকের বিষয়ে, প্রানের বিদ্যালয়ে। বলছিলাম পিয়াইনগুল কলিমূল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা, যাকে আমরা পি কে উচ্চ বিদ্যালয় নামে ডাকতাম। তো বলছিলাম বিদ্যালয়ে আমারা ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম একঝাক কিশোর-কিশোরী। সময়টা তখন বিংশ শতাব্দীর শেষ। মানে,১৯৯১ সালের কথা। আমাদের জন্য নতুন বিদ্যালয়, নতুন পরিবেশ। শুধুকি তাই? নতুন সব বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠি, নতুন সব শিক্ষক। মজার বিষয় হলো প্রথমদিকে শিক্ষক কিছু জিজ্ঞেস করলেই প্রায় সবাই জ্বী বলতাম। যেমন- তোমার নাম কি? আজ কি পড়ছো? সবাই উত্তর দিতাম জ্বী, জ্বী । কি একটা যাচ্ছেতা অবস্থা? আমরা ভর্তি হয়ে শিক্ষক হিসেবে যাদের পেলাম তাদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল মান্নান এবং অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে সর্বজনাব উসমান গনি, নির্মলেন্দুপাল নান্টু, জুনু স্যার, মাহফুজর রহমান, মঞ্জুর আহমেদ, বিনিত ভোষন, আইয়ূব আলী, মাও বশির আহমদ, মারফত আলী, আব্দুল আহাদ, সজল দাস , কেরানী স্যার সহ আরোও কিছু খন্ড কালিন তরুণ মেধাবী শিক্ষক জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুন, জনাব রুহুল আমীন, জনাব আব্দুর রশীদ সহ অনেকেই।
আমারা ৯১ সালে ক্লাস সিক্স এ যারা ভর্তি হয়েছিলাম তারা ৯৬ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থী ছিলাম, নতুন সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা হওয়ার কারণে সারা দেশে, সকল শিক্ষা বোর্ডের পাসের হারছিল স্নরণকালের সর্বনিম্ন! ২৮ শতাংশ !! আমাদের স্কুল থেকে আমরা মাত্র ১১ জন পাস করেছিলাম এ বছর। এমনও শত শত স্কুল ছিল যেখানে একজনও পাস করে নাই। আমাদের এই ব্যাচে অনেকে খুবই মেধাবী হওয়া স্বত্তেও পাসের সংখ্যা ছিলো কম।
সে যাই হোক,দীর্ঘদিন দেশের বাহিরে অবস্থান করার কারণে প্রিয় সব সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব অনেকের সাথেই দেখা- সাক্ষাৎ নাই বহুদিন, বহুবছর, 91 ব্যাচে ক্লাস সিক্সে আমরা যারা ভর্তি হয়েছিলাম– নজরুল, আজিজ,অলক, কামাল, বিলাল ,রুবেল, নিরঞ্জন, হেলাল ,মাসুক,বিভাস,বশির1,বশির, লিটন, সাজু, লুৎফর1, বিমল (মৃত) ,বিকাশ,কামাল, মোহাম্মদ আলী, জিয়াউর, ফয়সল, অসখ, রিপন, লুৎফর, রিংকু, শাহীন, ফখর, মফিজ,মানিক, বিপ্লব, বুলবুল, ইব্রাহিম, মালিক(মৃত), ওয়াহিদ, শীতিল, আশিক, আঞ্জলাল, আশক, কইয়ুম, নুরুজ্জামান, ময়নুল,বেলাল,চম্বক (মৃত), রুনা, আয়শা, জাহানারা, জেবুনেচ্ছা, শিবলী, সপ্না, রুমানা, লক্ষী, শুক্লা, নাছিমা, মীরা, রুপালী,অর্পণা, ফাহিমা, সিবানী, সেলিনা, পারভীন (মৃত), রিনা সহ আরও অনেকেই।
নাম লিখতে সহযোগিতা করেছে আমেরিকা প্রবাসী ইফতেখার আহমেদ হেলাল, তার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
ফেইসবুকের কল্যাণে কারো কারো সাথে যোগাযোগ হয় মাঝে-মধ্যে। তবে, যে যেখানেই আছে সবাই যেন ভালো থাকে এটাই কামনা।
এবার আসি এই স্কুলের সবচেয়ে মজার যে স্মৃতি আমার, ৯৩-৯৪ সালে আমারা আট সদস্যের একটি বয়েজ স্কাউট টিম অংশগ্রহণ করি ইন্টারন্যাশনাল এশিয়া প্যাসিফিক জাম্বুরীতে। এ উপলক্ষে ৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসব্যাপী আমাদের ক্যাম্পীং এর আয়োজন করা হয় স্কুলে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আট সদস্যের স্কাউট টিমের দিন-রাত সার্বক্ষণিক থাকার ব্যবস্থা করা হয় স্কুলের সাইন্স বিল্ডিংয়ে, টিম লিডার এবং প্রশিক্ষক ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় জনাব আইয়ূব আলী স্যার। আইয়ূব আলী স্যারের নেতৃত্বে আর আমাদের প্রিয় নান্টু স্যারের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে আমাদের ট্রেনিং চলল দিন-রাত। ৯৩ সালের২২শে ডিসেম্বর থেকে ৫ই জানুয়ারির ৯৪ সাল পর্যন্ত আমরা গাজীপুরের শৃপুরে ইন্টারন্যাশনাল জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করে অনেক পুরষ্কারসহ সম্মাননা নিয়ে এসেছিলাম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য করি সিলেট জেলা থেকে দি এইডেড হাই স্কুল এবং আমরা মাত্র দুটি স্কুলই ইন্টারন্যাশনাল এই জাম্বুরীতে অংশগ্রহন করেছিলাম।স্কাউট জাম্বুরীর উদ্বোধন করেন তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর সমাপনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। জাম্বুরীতে অংশগ্রহণকারী দলের আট সদস্য হলেনঃ- গিয়াস উদ্দিন,ইমাম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, ফয়সল আলম, মাসুক আহমেদ, অসখ দাশ, লুৎফর রহমান, অনিমেষ পাল।
এবার আসি শ্রদ্বেয় শিক্ষক মন্ডলী প্রসঙ্গে, আমাদের সময়ে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মান-শ্রদ্বা, ভয়-সমীহ সবই ছিল। শিক্ষক বৃন্দ আন্তরিকতার সাথে পাঠদানের পাশা-পাশি কিভাবে মানবিক গুন সম্পন্ন মানুষ হওয়া যায়, তার শিক্ষাও দিতেন। প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল মান্নান এলাকার মানুষের আবেগ-আনুভুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নিজের ব্যাংকের লোভনীয় চাকরী ছেড়ে, শিক্ষার আলোয় নিজ এলাকা আলোকিত করার জন্য স্কুলে যোগদান করেন এবং চাকুরী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিরলস প্ররিশ্র্ম করেন। তিনি সুযোগ পেলেই ক্লাসে চলে আসতেন এবং আমাদের ইংরেজী পড়াতেন।
জনাব উসমান গনি স্যারকে সম্ভবত আমরা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পেয়েছিলাম, স্যার খুবই ভালো মানের শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে দশগাও নোয়াগাও স্কুল প্রতিষ্ঠাকরে সেখানে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
জনাব নির্মলেন্দুপাল নান্টু স্যার অনেক আন্তরিকতার সাথে পড়াতেন আমাদের, আবার কঠোর শাসনও করতেন। হাসি হাসি অল্প আঘাতে বেত মারলেও খবর হয়েযেত। আমার বাবার সাথে স্যারের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো।
এবার আসি জুনু স্যারের কথায়, স্যার নবম-দশম শ্রেণীতে আমাদের ভূগোল পড়াতেন। ক্লাসে এমন কেউ নেই যে, স্যারের পড়া মুখস্থ করে আসতোনা। আমাদের সময়ে স্যারের ভূগোল বিষয়ে কেউ কখনও ফেল করছে শুনিনি। স্যার আমাদের মাঝে নেই, তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
জনাব মাহফুজুর রহমান, সালাম স্যার নামে পরিচিত ছিলেন। আমারা বিএসসি স্যার বলে ডাকতাম, এতে মঞ্জুর স্যার মাঝে-মাঝে আপত্তি করতেন। যে, সালাম সাহেবতো বিএসসি না! তোমারা কেন বিএসসি স্যার ডাকো? তা যাইহোক সালাম স্যার আমাদের গণিত পড়াতেন। পরবর্তীতে স্যার তোয়াকুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। স্যারের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
জনাব আইয়ূব আলী স্যার ছিলেন স্কুলের সবার মধ্যমনি।স্যার খুবই স্ট্যাইল করে পড়াতেন, কথা-বার্তা, খেলা-ধুলা এই সব নিয়ে সব সময় সবাইকে প্রানোচ্ছল করে রাখতেন। ইন্টারন্যাশনাল জাম্বুরীতে অংশগ্রহন করেছিলাম স্যারের নেতৃত্ব। নিজের সন্তানের মতোই সবাইকে আগলে রাখতেন।
জনাব বিনিত ভোষন স্যার আমাদের গণিত পড়াতেন, খুবই হাসি-খুশি প্রাণবন্ত ক্লাস নিতেন।
জনাব মঞ্জুর আহমেদ স্যারের কাছে আমাদের কোনো ক্লাস সম্ভবত ছিল না। পরবর্তীতে স্যার গোয়াইনঘাটের কোন একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
মাও বশির আহমদ হুজুর আমাদের ইসলাম শিক্ষা পড়াতেন। হুজুর ক্লাসে অনেক হাসি-ঠাঠ্ঠা করে পড়াতেন। হুজুরের ক্লাসে আমরাও অনেক আনন্দ করতাম।
আমাদের সময়ে আমরা কয়েকজন মেধাবী শিক্ষক পেয়েছিলাম খন্ড কালীন, জনাব আব্দুল্লাহ আল মামুন, জনাব রুহুল আমীন এবং আব্দুর রশীদ প্রমুখ। পাঠদানে উনাদের অনেক অনেক আন্তরিকতা ছিল।
পিয়াইনগুল কলিমূল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই অত্র বৃহত্তর সালুটিকর অঞ্চলের শিক্ষা- সংস্কৃতি ও উন্নয়ন-যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সালুটিকর ডিগ্রি কলেজ বৃহত্তর এই জনপদে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আলোকিত করছে। এই অঞ্চলে এখন অনেক মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই স্কুলকে কেন্দ্র করেই আমাদের সময়ে সালুটিকর ছাত্র পরিষদ নামে একটি অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বেশ তৎপর ছিল। এলাকার যেকোন দাবি আদায়ে আমরা খুবই সোচ্চার ছিলাম। আর
এসবই হচ্ছে পিয়াইনগুল কলিমূল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের ফসল।
পিয়াইনগুল স্কুলের সাবেক ছাত্ররা আজ দেশে-বিদেশেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতার সাক্ষর রাখছেন। উত্তর সিলেটের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বানিজ্য এবং সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সময়ে তাঁরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন সর্বত্র। রকিব আল হাফিজ, ড.জফির সেতু, মরহুম আব্দুল খালিক চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, অধ্যাপক আইয়ূব আলী, আজির উদ্দিন, আব্দুর রশীদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজু আহমেদ,আব্দুল
মানিক,শিব্বির আহমেদ, সিনিয়র লেকচারার নজরুল ইসলাম, সিনিয়র লেকচারার আজির হাসিব এই স্কুলেরই সাবেক ছাত্র।
অনেকেই ব্যবসা ক্ষেত্রে সফলতার সাক্ষর রেখেছেন, রুহুল আমীন, ইমাম উদ্দিন, রফিক আহমেদ,ফরিদ আহমেদ, ইব্রাহিম আলী, শাহীন আহমেদ সহ আরোও অনেকেই।
পিয়াইনগুল স্কুলের সাবেক ছাত্ররা আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে ব্যাবসা-বানিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, আব্দুল লতিফ বাবুল(USA), আমিনৃর রশীদ (UK), আব্দুল ওয়াদুদ (Kuwet), বুরহান উদ্দিন(USA), সুলতান আহমেদ (DUBAI), বাছা মিয়া (SAUDIA), নজরুল ইসলাম মাসুম (IRELAND), ইফতেখার আহমেদ হেলাল(USA), কামাল উদ্দিন(UK), ফখরুল ইসলাম(USA) বজলূর রশীদ বদর(UK)
ইয়াসিন আলী(USA)সহ আরোও অনেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে পরিবারের পাশা-পাশি এলাকার আর্থ -সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন।
পিয়াইনগুল স্কুলের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় শতাধিক আছেন শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন প্রাইমারী-মাধ্যমিক স্কুল কলেজে। এছাড়া আরোও অনেকেই আছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দক্ষতার সাথে। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবার নাম এবং কাজের বিবরণ দেওয়া খুবই কঠিন।
পরিশেষে, পিয়াইনগুল কলিমুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তী উপলক্ষ্যে- সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব-২০২৩ এর সাথে সংশ্লিষ্ট,স্কুলের সাথে সম্পর্কিত এবং স্কুলের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকল শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং কর্মচারীসহ সকলের সূস্বাস্হ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করছি। সবার জন্য ভালবাসা অবিরাম।
লেখক: সাবেক সিনিয়র লেকচারার ও আজীবন দাতা সদস্য, সালুটিকর ডিগ্রি কলেজ।
এস এস সি ব্যাচ ৯৬, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী।