প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতায় স্তম্ভিত বৃটেনবাসী, সরকার পরিচালনায় সংকট
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃকরোনাভাইরাস মহামারি গত ৭৫ বছর তো বটেই, কারও কারও মতে গত এক শতাব্দীর সবচেয়ে নজিরবিহীন সংকটে ফেলেছে ব্রিটেনকে। কিন্তু এই ভয়াবহ সংকটের সময় দৃশ্যপটে নেই প্রধানমন্ত্রী। তিনি লণ্ডনের এক হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে শয্যশায়ী।
তাহলে দেশ চলবে কিভাবে? এই জরুরী সংকটের সময় রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কে নেবেন? কিভাবে নেবেন? সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন?
ব্রিটেনে গতরাত থেকে ঘুরে ফিরে এসব প্রশ্ন উঠছে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রথম সারির নেতা আর মন্ত্রীদের এসবের উত্তর দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে যেসব সাক্ষাৎকার তারা দিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে সংশয় তো দূর হয়ই নি, বরং আরও ঘনীভূত হয়েছে।
স্তম্ভিত বৃটেনবাসী
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়েছিলেন আজ থেকে ১১ দিন আগে। এরপর তিনি সেখান থেকে সোশ্যল মিডিয়ায় বেশ কিছু টুইট করেছেন, কয়েকটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন।
ব্রিটেনের ন্যশনাল হেলথ সার্ভিসের ডাক্তার-নার্স-কর্মীদের ভূমিকাকে সন্মান জানাতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন দেশজুড়ে সবাই যার যার ঘর থেকে হাততালি দিয়েছেন, তখন দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের দোরগোড়ায় তাকেও দেখা গেছে। কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে, তার শারীরিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়।
এরপর পরিস্থিতি বেশ নাটকীয় মোড় নেয় রোববার। সেদিন হঠাৎ ঘোষণা করা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য।
তারপর সোমবার সন্ধ্যায় এলো আরও গুরুতর এক খবর- বরিস জনসনকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নেয়া হয়েছে। কারণ তার তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে শ্বাসকষ্টের জন্য তাকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
সরকার পরিচালনায় সংকট
জরুরী সংকটের সময় সবাই যখন সরকারের দিকে তাকিয়ে, তখন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অসুস্থতা এবং অনুপস্থিতি সরকারকে কিছুটা বিপাকে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন বিবিসির রাজনৈতিক সংবাদদাতা লরা কুনসবার্গ।
সরকারের একজন মন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন, সরকার বেশ বলিষ্ঠ, দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গেই তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যাচ্ছে, দায়িত্বে যিনিই থাকুন না কেন।
কিন্তু লরা কুন্সবার্গ বলছেন, ব্রিটেনের সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তো কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতীক নন, তিনি সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্র্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এরকম এক গুরুতর জাতীয় সংকটের কালে, যখন কিনা জনগণের স্বাস্থ্য আর দেশের অর্থনীতি নিয়ে এত গুরুতর সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, তখন প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতি পুরো সরকার এবং প্রশাসনযন্ত্রের জন্য একটা সংকটময় মূহুর্ত। বরিস জনসনের অসুস্থতার কারণ সরকার যেন অতটা স্থিতিশীলভাবে কাজ করতে পারছে না।
বরিসের ডেপুটি
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে, রেডিও টকশোতে আজ উপস্থাপকরা কোন লুকোছাপা না করে সরাসরি সরকারের মন্ত্রীদের কাছে প্রশ্ন রাখতে শুরু করেছেন- যদি প্রধানমন্ত্রীর কিছু হয়, যদি তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন কী ঘটবে? কে সরকারের দায়িত্ব নেবে?
দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের তরফ থেক জানানো হয়েছে, ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রাব, যিনি ‘ফার্স্ট সেক্রেটারি অব স্টেট’, তিনিই এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করবেন।
বরিস জনসনকে গতকাল (সোমবার) ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তরের পরপরই টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এসে মিস্টার রাব কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি এমন এক বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটবে না।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অসুস্থতা যদি আরও গুরুতর রূপ নেয় এবং তিনি সরকারের কাজ-কর্ম চালাতে শারীরিকভাবে একেবারেই অক্ষম হয়ে পড়েন, তখন কী ঘটবে?
এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আসলে কী করতে হবে, ব্রিটেনের রাষ্ট্রাচারে সেই নিয়ম-কানুন স্পষ্ট নয়। এর একটা কারণ ব্রিটেনের কোন লিখিত সংবিধান নেই। আর কোন জাতীয় দুর্যোগের সময় এভাবে প্রধানমন্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, সেরকম নজিরও নেই।
বিবিসির রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিটার বার্নস বলছেন, আগামী কয়েকদিন এক্ষেত্রে সরকার কীভাবে কাজ করবে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে ‘কেবিনেট ম্যানুয়াল’ দেখে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাজ এবং ভূমিকা এই ম্যানুয়ালে বর্ণনা করা আছে।
যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডোমিনিক রাব হচ্ছেন ‘ফার্স্ট সেক্রেটারি অব স্টেট’, সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনিই তার কাজকর্ম দেখবেন। প্রধানমন্ত্রী যদি তার দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, ডোমিনিক রাবই দায়িত্ব নেবেন।
কিন্তু তার মানে কী? একজন প্রধানমন্ত্রী যেসব কাজ করেন, যা যা করার ক্ষমতা তার আছে, ডোমিনিক রাব কি তার সব কিছুই করতে পারবেন?
বিবিসির রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিটার বার্নস মনে করেন, মিস্টার রাব প্রধানমন্ত্রীর বেশিরভাগ কাজই চালিয়ে যেতে পারবেন কোন সমস্যা ছাড়াই। যেমন বিচার বিভাগের উর্ধ্বতন বিচারকদের বা চার্চ অব ইংল্যাণ্ডের উচ্চপদে নিয়োগের জন্য রাণীর কাছে সুপারিশ করা।
কিন্তু মন্ত্রিপরিষদে তিনি কোন রদবদল আনছেন – এমন একটি পরিস্থিতি কল্পনা করা কঠিন, যদিও মনে হতে পারে তার সেই ক্ষমতা আছে। এমন সম্ভাবনা কম অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও।
বাস্তবে তাকে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করে। তাকে পরামর্শ করতে হবে কেবিনেট সচিব এবং অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
সামরিক সিদ্ধান্ত
এক্ষেত্রে সবচেয়ে জটিল অবস্থা দেখা দিতে পারে কোন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে। জরুরী কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তাকে হয়তো সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, তবে সেটি মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে।
এরকমই আরেকটি সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে। ব্রিটেনের কয়েকটি পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিন আছে। দেশ যদি আক্রান্ত হয়, তখন কী করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে হয় এসব সাবমেরিনের কমান্ডারদের কাছে।
তবে বরিস জনসন যদি অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজকর্ম চালাতে অক্ষম হয়ে পড়েন, অথবা নিজের পদ থেকে সরে না দাঁড়ান, ততক্ষণ ডোমিনিক রাবকে এরকম চিঠি লিখতে হবে বলে মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে তখন কী?
যদি প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু ঘটে বা যদি তিনি অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য শারীরিকভাবে দায়িত্ব পালনে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েন,তখন রাণী হয়তো ডোমিনিক রাবকে একটি সরকার গঠন করতে বলতে পারেন। অন্তত অর্ন্তবর্তীকালীন এক সরকার। যতক্ষণ না মন্ত্রীপরিষদ সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অন্য কারও নাম প্রস্তাব না করছে।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি একজন নতুন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত ডোমিনিক রাবই দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্রিটেনের একটি থিংক ট্যাংক ‘ইনস্টিটিউট ফর গভর্নমেন্ট’ এর মতে, প্রধানমন্ত্রী যদি মারা না যান বা পদত্যাগ না করেন, তিনিই ঐ পদে আছেন বলে ধরে নিতে হবে।
ইনস্টিটিউট ফর গভর্নমেন্ট বলছে, “রাজনৈতিক দল তাদের নেতা পদত্যাগ করলে বা একেবারে অক্ষম হয়ে পড়লে তখন একজন ‘অস্থায়ী নেতা নির্বাচন করতে পারে, কিন্তু ব্রিটেনে “অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী” বলে কোন পদ নেই।
ডোমিনিক রাবকে কী অন্য মন্ত্রীরা মানবেন?
এরকম প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে যখন এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে যে মিস্টার রাবই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ডেপুটি, তখন কোন কোন মন্ত্রী তাদের সাক্ষাৎকারে গুরুত্ব দিচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর।
যদিও তিনি এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কনজারভেটিভ পার্টির একেবারে সুপরিচিত প্রথমসারির কেউ নন ডোমিনিক রাব।
মিস্টার রাবের বয়স ৪৬। চেক বংশোদ্ভুত ইহুদী শরণার্থী পরিবারের সন্তান তিনি, যারা ১৯৩৮ সালে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন।
তিনি অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। ২০১০ সালে তিনি প্রথম এমপি হন। তিনি ছিলেন ব্রেক্সিটের কট্টর সমর্থক।
আরেকটি মজার তথ্য হচ্ছে, তিনি কারাতে ব্ল্যাক বেল্টধারী।
কোন কোন রাজনৈতিক ভাষ্যকার এমন আশংকা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, কনজারভেটিভ পার্টিতে যেন নেতৃত্বের জন্য ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে না যায়।
যদি সেরকমটি ঘটে, তা ব্রিটেনের বর্তমান সংকটকে আরও গভীর করে তুলতে পারে।