করোনার ঢেউয়ে তলিয়ে গেল জাতির মেরুদণ্ড !

Spread the love

এক বছরেরও বেশি সময় থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দেশের শিক্ষা মন্ত্রনালয় আবারও ২৯ মে পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বৃদ্ধি করেছে । বিশ্বের একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে করোনার দোহায় দিয়ে বিগত ১৪ মাস থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায় করোনার ঢেউয়ে তলিয়ে গেছে জাতির মেরুদণ্ড । কারন, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড । আর কোন জাতিকে ধবংস করতে হলে প্রথমে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধবংস করে দিতে হয়। বাংলাদেশে কি সেরকম কিছু হতে চলেছে ? বিষয়টি সত্যিই ভাবনার বিষয় । কোথায় কখন কিভাবে কাদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে এব্যাপারে দেশের স্বাস্থ্য বিশারদদের বিস্তারিত কোন গাইডলাইন নেই। যতটুকু আছে কোন কার্যকারিতা আছে বলে মনে হয়না । আপাতদৃষ্টিতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, সরকার একের পর এক বন্ধ রেখে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা কী করোনাভাইরাস মোকাবেলার একমাত্র উপায় , নাকি জাতিকে মূখ্য রাখার কোন ষড়যন্ত্র ! কথায় আছে, জাতি মূখ্য থাকলে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার মসনদে ঠিকে থাকার ছিঁড়ি দীর্ঘায়িত করা যায় ।

শিক্ষার্থীরা যদি ক্লাস রুম থেকে এক বছরের বেশি সময় দূরে থাকে ,আর এর ফলে শিক্ষার ধারাবাহিকতায় যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তা কী আসলেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব ? দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ৩০ মে র পর পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলে দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি বারবার পিছিয়ে অবশেষে ২৯ মে ২০২১ পর্যন্ত গড়ায় ।
সরকারের যুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশে করোনা সংক্রমণের হার আশঙ্কার তুলনায় কম। কিন্তু আমাদের জানা নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে সংক্রমণের হার কত কম হতো। যদিও ব্রিটেন বা উন্নত কোন দেশের গবেষণায় সংক্রমণের বৃদ্ধি যে স্কুল খোলার কারণে হয়েছে, তার গবেষণাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য–উপাত্ত আছে বলে মনে হয় না।

করোনা যে সহজে বিদায় নিচ্ছে না এটা মোটামুটি অনুমেয়। জাতিসংঘও বলছে, মৌসুমি রোগ হিসেবে এটি পৃথিবীতে বিরাজ করতে পারে। তাই সারা বছর বাংলাদেশে অল্পবিস্তর করোনা রোগী থাকা অনেকটা স্বাভাবিক। আর তাই যদি হয়, তাহলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ থাকবে? মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তি। পুরো এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি বাংলাদেশকে তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এ ক্ষতি কলকারখানা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকার যে ক্ষতি, তার মতো সহজে প্রকাশ করা যায় না। যেমন ধরুন, গত বছর বাংলাদেশে লকডাউনের তিন মাসের অর্থনৈতিক ক্ষতির যে হিসাব করা হয়েছে, তাতে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় আনা হয়নি। কেননা শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। আর জিডিপির ভিত্তিতে ক্ষতির হিসাব করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণই পাওয়া যাবে না। কারণ, কিছু কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছাড়া আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিসহ অন্যান্য লেনদেন যথারীতি করোনা–পূর্ব অবস্থায় আছে। তাহলে কেউ হয়তো বলতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছর বন্ধ থাকার ফলে তেমন তো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাই আরও কিছুকাল বন্ধ থাকলেই–বা কী হয়?
কিন্তু কথা হচ্ছে , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী। আর তাই দীর্ঘ এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়তো এখন পরিমাপ করা যাবে না। তাই বলে এটা যে অনুপস্থিত, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। একটু ভাবুন তো, একটি স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে কীভাবে দীর্ঘ ১২ মাস পার করল। শহরে না হয় অনলাইনের কল্যাণে স্কুলের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা সংযুক্ত আছে। কিন্তু লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা গ্রামে বসবাস করে, তাদের কথা কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছেন? বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানেরা হয়তো আর স্কুলেই ফিরতে পারবে না। অনেকেই হয়তো উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই মুঠোফোনসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়েছে। আর এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো একটু ভাবুন তো? তারা স্কুলে ফিরলেও তাদের শিক্ষার মান কী রকম হবে, তা–ও সহজেই অনুমেয়।

বিশ্বের সবকটি দেশ করোনা মহামারি সত্বেও যতটুকু সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার চেস্টা করেছে। ব্রিটেনের মতো দেশ যেখানে করোনার থাবায় ১ লক্ষ ২৭ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন সেই দেশটিতে লকডাউনে সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খোলা রাখা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । প্রশ্ন হল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টোটা কেন ? দেশটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে দোকানপাট, শপিং সেন্টার, মিছিল সমাবেশ বড় বড় ইভেন্ট সহ সব কিছুই খোলা রাখা হয়েছে । তাহলে স্কুল কলেজ বন্ধ কেন এব্যাপারে সরকারের কোন পরিস্কার বক্তব্য নেই , যদিও বলা হচ্ছে বাচ্ছাদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। সরকারের এই যুক্তি ধরে নিলে বলতে হবে সরকারের স্বাস্থ্য বিশারদদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জ্ঞানের যতেষ্ট অভাব রয়েছে।

সরকারের যুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে । কারন স্কুল কলেজে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস নেওয়া সম্ভব না । তাদের যুক্তি প্রতিটি স্কুল কলেজে অবকাঠামো সংকট ।
কিন্তু সরকারের এই অজুহাত কতটা যুক্তিসঙ্গত ? আসলেই কী এর কোন সমাধান নেই ? বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটি ক্লাসে সাধারনত ২০০/৩০০ অথবা আরও বেশি শিক্ষার্থী বসার ব্যবস্থা রয়েছে ,এক্ষেত্রে একটি ডেক্সে ৪/৫ জন শিক্ষার্থী বসতে হয় । কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আরও কম হতে পারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে একজন ছাত্রের জন্য একটি ডেস্ক থাকে । এক্ষেত্রে প্রতিটা প্রাইভেট স্কুল কিংবা কলেজে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস নেওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু না । কিন্তু সরকারী প্রতিষ্ঠানে কেন সম্ভব হবে না । একটি ক্লাসে যদি ২০০/৩০০ শিক্ষার্থী থাকে সেক্ষেত্রে ৩০/৪০ জনের গ্রুপ তৈরী করে ক্লাস নেওয়া অসম্ভব কিছু না । জায়গা সংকূলান না হলে ক্লাসের সময় সীমা ও সিলেবাস সংকীর্ন করেও পাঠদান করানো যায় । এতে অন্তত শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকত। আরেকটা প্রশ্ন অবশ্যই থেকে যায়, বিগত ১৪ মাস সময়ের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব তৈরী করে ছাত্রদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনা কেন সম্ভব হয়নি ? আমরা দেখেছি বিশ্বের সবকটি দেশ তড়িগড়ি ক্লাস রুমে সামাজিক দূরত্ব তৈরী করে ছাত্রদের ক্লাসে ফিরিয়ে এনেছে । কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিগত ১৪ মাসেও কেন সেটা সম্ভব হল না ।

শিক্ষকরা ক্লাস রুমে না গিয়ে বেতন নিচ্ছে , শিক্ষার্থীরা ক্লাস রুমে না গিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে ।এতে বলির পাঠা হচ্ছে অভিভাবকরা , এটা কিভাবে সম্ভব ? সরকারের মাথা ব্যাথা নাই বুঝলাম , দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীরা আজ চুপ কেন ? বিগত দিনগুলোতে কওমী শিক্ষা চালু ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কওমী শিক্ষার্থীরা কী তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করেছিল ? আমরা যতটুকু জানি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের সামাজিক দূরত্ব রেখে ক্লাস নেওয়া একেবারেই অসম্ভব,কারন একটা স্কুল বা কলেজের তুলনায় কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবে অনেক বেশি থাকে। তাহলে কওমী মাদ্রাসা খোলা রাখা সম্ভব হলে স্কুল কিংবা কলেজ খোলা রাখা অসম্ভব কেন ?

বাচ্চাদের মাধ্যমে যটটুকু ভাইরাস ছড়াতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি গতীতে ভাইরাস ছড়ায় বয়স্কদের মাধ্যমে। তাছাড়া বয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকিও অনেক বেশি । বাংলাদেশে বিগত ১৪ মাসের মধ্যে ৩ মাস লকডাউন থাকলেও বয়স্কদের জন্য কোন রেস্ট্রিকশন ছিলনা। লকডাউন সত্বেও খোলা রাখা হয়েছে শপিং সেন্টার , দোকান পাট , বিয়ে সাদি, বিভিন্ন ইভেন্ট , সভা সমাবেশ,মিছিল ইত্যাদি। যার ফলে অতি সহজে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরতে পারে। বয়স্কদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাচ্চাদের তুলনায় অনেকাংশে কম থাকে । এক্ষেত্রে বয়স্ক লোকদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ও মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে বেশি । এব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কোন সুস্পস্ট গাইড লাইন নেই । তাছাড়া সামাজিক দূরত্বের কোন বিধিমালাও নেই দেশে । নেই ফেইস মাস্ক পড়ার কোন বাধ্যবাধকতা । কিছু গাইডলাইন থাকলেও নেই কোন কার্যকারিতা ।

বাংলাদেশ বলছে তারা অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কতটা ডিজিটাল হতে পেরেছে ? কত শতাংশ মানুষের হাতে লেপটপ, ট্যাবলেট রয়েছে । বাংলাদেশের কতটা অঞ্চলে আধুনিকায়ন সম্ভব হয়েছে। দেশের অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে এখন পর্যন্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না । বলা যায় দেশের শহরাঞ্চল ছাড়া গ্রামাঞ্চলে ডিজিটালের প্রশ্নই আসেনা । শহরাঞ্চলের কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করতে পারলেও গ্রামাঞ্চলে এটা মোটেও সম্ভব না। তাছাড়া অর্থনৈতিক সামর্থের একটা ব্যাপার আছে। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে তাদের সন্তানদের একটা লেপটপ কিংবা ট্যাবলেট কিনে দেওয়া সবার পক্ষে সম্ভব না । তাহলে প্রশ্ন হল সরকারের ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা কত শতাংশ শিক্ষার্থী পেল। অনেকেই মনে করেন, একটু বেশি পড়াশোনা করে নিলে এসব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পড়ানো, পড়া এবং সর্বোপরি পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই হয়তো আমরা শিক্ষার বহুমুখী ইতিবাচক দিক নিয়ে কখনো ভাবি না। সন্তান ভালো জিপিএ পেলেই আমরা খুশি। সন্তান ভালো মানুষ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কেননা, জিপিএ-৫–এর মতো ভালো মানুষ পরিমাপ করার কোনো মাপকাঠি নেই। সমাজে তাই ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। জিপিএভিত্তিক ফলাফলমূলক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের আরও অন্ধ করে ফেলেছে। শিক্ষার বহুমুখী ইতিবাচক দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানুষের সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার এটি প্রধান নিয়ামক। আর শিশু সামাজিকভাবে গড়ে না উঠলে সে যত বড় বিদ্বানই হোক না কেন, সংকীর্ণতার কূপমণ্ডূকে নিমজ্জিত থাকবে। ( লেখকঃ সম্পাদক – বাংলা সংলাপ )


Spread the love

Leave a Reply