প্রসঙ্গঃ প্রবাসী বিমান যাত্রীদের নিয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের মন্তব্য
মুহাম্মদ ফয়জুর রহমানঃ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক প্রবাসী বিমান যাত্রীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন- আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তাঁর এহেন দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্খিত মন্তব্য বহির্বিশ্বে অবস্থারত প্রবাসী বাংলাদেশী এবং দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নাগরিকদের শুধু বিস্মিতই করে নি, দারণভাবে মর্মাহতও করেছে। প্রজাতন্ত্রের একজন পদস্থ কর্মকর্তার মুখে এ ধরণের মন্তব্য বেদনাদায়ক এবং বেমানান।
উপমহাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাঙলা এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। দেশমাতৃকার সকল দূর্যোগ-দূর্দিনে প্রবাসী বাংলাদেশীরা সহমর্মিতা আর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। এক্ষেত্রে সুদূর অতীত কাল থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন আমাদের যুক্তরাজ্য প্রবাসীগণ। আর যুক্তরাজ্যে অভিবাসী বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশেরও অধিক সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী।
এদিকে, বাঙলা এবং বাঙালির সকল জাতীয় নেতার দূর্দিন আর সংকট কালের একটি নিরাপদ ঠিকানা এবং আশ্রয়স্থল ছিলো এই যুক্তরাজ্য। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল জাতীয় নেতা যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্তরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় প্রীত-আপ্লুত হয়েছেন।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করতে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের উদ্যোগে লন্ডনে ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’ গঠন এবং পাকিস্তানের আদালতে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য বিলেত থেকে কুইন্স কাউন্সিলের বিশ্ববিখ্যাত আইনজীবীকে পাকিস্তানে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনেও যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা বঙ্গবন্ধু এবং তা্ঁর দল আওয়ামী লীগকে সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমর্থন দিয়েছেন।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীরাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে, শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, অস্ত্র, বস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মূদ্রার প্রথম রিজার্ভ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের দানকৃত সাড়ে ৪ লক্ষ পাউন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলে প্রদান করা হয়। আর প্রবাসীদের দানকৃত এ বৈদেশিক মূদ্রার মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের শুভ সূচনা হয়।
এদিকে,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমেই চলে যান লন্ডনে যক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে মিলিত হতে। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রবাসী স্বজনদের কৃতজ্ঞতা জানাতে। লন্ডনে অবস্থানকালে প্রবাসী বাংলাদেশী স্বজনদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে একটি বিশেষ বিমানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি,১৯৭২ তাঁর জীবনভর সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল প্রিয় জন্মভূমি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এদিকে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী একদল নিখাদ দেশপ্রেমিক তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৭২ সালের জানুয়ারির একেবারে গোড়ার দিকে লন্ডন থেকে একটি এয়ার ক্রাফট্ চার্টার করে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁ বিমানবন্দরে অবতরণের মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যুদ্ধ বিধ্বংস্ত বাংলাদেশের প্রথম বিমান যোগাযোগের শুভ সূচনা করেন। ।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং দেশ ও জাতির সকল ক্রান্তিলগ্নে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐতিহাসিক অবদান এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা সকলেরই জানা আছে। সর্বোপরি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে প্রবাসী জনগোষ্ঠীর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মূদ্রা সুদুরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে যূগ যূগ ধরে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে,বাংলাদেশ বিমানকে আকাশে টিকিয়ে রাখতে মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি নাড়ির টান এবং গভীর মমত্ববোধে আবদ্ধ প্রবাসী বাংলাদেশী ভাই-বোনদের অবদানই মুখ্য।
সুদূর অতীত কাল থেকে দেশমাতৃকার কল্যাণে এবং জাতির অগ্রযাত্রায় প্রবাসীদের অবদানের কথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিমান ও পর্যটন সচিবের অবশ্যই জানা থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু প্রবাসীদের নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক নেতিবাচক এবং দুঃখজনক বক্তব্য দেশে-বিদেশে সকলকে হতাশ করেছে।
প্রবাসী বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের নিয়ে বিমান ও পর্যটন সচিবের এহেন দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্খিত মন্তব্য বিশ্বের দেশে দেশে অবস্থানরত সকল প্রবাসী বাংলাদেশীসহ দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। বিষয়টি স্পর্শকাতরও বটে।।
প্রবাসী বিমান যাত্রীদের নিয়ে বিমান ও পর্যটন সচিবের অপ্রত্যাশিত মন্তব্য’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। দেশে-বিদেশে তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এমনই প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিমান ও পর্যটন সচিব তাঁর এহেন অনাকাঙ্খিত মন্তব্যটি প্রত্যাহার করে নেবেন এবং এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন বলে আমরা আশা করছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ”দেশ ও জাতির দূর্দিনের বন্ধু প্রবাসী’দের সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্ভুত এ বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। এব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী এবং মাননীয় বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি এবং আশু ইতিবাচক পদক্ষেপ একান্তভাবে কামনা করছি । – লেখকঃ মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক