প্রিন্স হ্যারি নিজেই নিজের পথ তৈরি করেছেন
বাংলা সংলাপ ডেস্ক: গণমাধ্যমের স্পট লাইটে বেড়ে উঠেছেন ডিউক অব সাসেক্স- মায়ের মৃত্যুতে শোকাক্রান্ত রাজপরিবারের কিশোর সদস্য থেকে শুরু করে, পার্টি করে বেড়ানো তরুণ বয়স এবং তার সামরিক বাহিনীতে তার ক্যারিয়ার, সবই উঠে এসেছে সংবাদ শিরোনামে।
তখন থেকেই হ্যারি তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন, বিশ্ব জুড়ে দাতব্য কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। তিনি বিয়ে করেছেন এবং পিতা হয়েছেন।
এখন তিনি এবং ডাচেস অব সাসেক্স নতুন একটি অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছেন: তারা তাদের রাজকীয় দায়িত্ব, উপাধি এবং সরকারি তহবিল ত্যাগ করছেন এবং ধারণা করা হচ্ছে- তারা তাদের বেশিরভাগ সময় কাটাবেন কানাডাতে।
হ্যারি তার ব্যক্তিগত এবং দাপ্তরিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চেষ্টা করেছেন। অনেক সময়, রাজ মুকুটের ষষ্ঠ উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রচারণা তাকে দাতব্য প্রচেষ্টায় সমর্থন জোরালো করতে সাহায্য করেছে।
কিন্তু অনেক সময় আবার এই মনোযোগ অতিরিক্ত হয়ে দেখা দিয়েছে এবং তিনি তার পরিবারের গোপনীয়তা রক্ষায় কঠোরভাবে লড়েছেন।
বাল্যকাল
১৯৮৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর পেডিংটনের সেন্ট মেরি’স হসপিটালে জন্ম নেন হ্যারি। সে বছরের ডিসেম্বরে উইন্ডসরের সেন্ট জর্জে’স চ্যাপেলে আর্চবিশপ অব ক্যানটারবারি তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তার নামকরণ করেন হেনরি চার্লস অ্যালবার্ট ডেভিড।
কিন্তু জন্মের পর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে বলা হয় যে তিনি হ্যারি নামে পরিচিত হবেন।
১৯৯৭ সালে তার মায়ের মৃত্যু হলে তার শৈশব জীবনও সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে।
২০১৭ সালে ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিন্স বলেছিলেন, “আমি বলতে পারি যে, ১২ বছর বয়সে আমার মাকে হারানো এবং এ কারণে গত ২০ বছর ধরে আমার সব আবেগকে দমিয়ে রাখার বিষয়টি শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবন নয় বরং আমার কাজের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।”
শিক্ষাক্ষেত্রেও বড় ভাই উইলিয়ামের পথই অনুসরণ করেছেন তিনি, ১৯৯৮ সালে ইটনে যাওয়ার আগে নটিংহিলের ওয়েদারবি স্কুলে পড়াশুনা করেন।
২০০৩ সালে দুটি এ লেভেল শেষ করার পর ইটন ত্যাগ করার পর এক বছরের বিরতি নেন হ্যারি।
অস্ট্রেলিয়ায় একটি ভেড়ার খামারে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং লেসোথোতে একটি এতিমখানায় সহায়তা করার বিষয়টি পরবর্তীতে সেখানে তার একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পথকে সুগম করে।
স্পট লাইটের জীবন
হ্যারির জীবনে সংবাদ মাধ্যমের মনোযোগ পাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিয়মিত ব্যাপার ছিল।
২০০২ সালে তৎকালীন সংবাদ মাধ্যম নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড(বর্তমানে বিলুপ্ত) তাদের প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম করে ছেপেছিল: “হ্যারির মাদক বিতর্ক”, এবং দাবি করেছিল যে, প্রিন্স চার্লস তার ছেলেকে গাঁজা খাওয়ার কারণে শাস্তি স্বরূপ পুনর্বাসন ক্লিনিকে পাঠিয়েছেন।
সেন্ট জেমস’স প্যালেস নিশ্চিত করেছিল যে, সেসময় ১৭ বছর বয়সী “বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরীক্ষামূলক ভাবে মাদক নিয়েছিল” কিন্তু এই ব্যবহার “নিয়মিত” ছিল না।
পরের বছর, ফ্যান্সি ড্রেস পার্টিতে প্রিন্সের নাৎসিদের পোশাক পড়া ছবি প্রকাশিত হলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ক্লারেন্স হাউস পরে জানিয়েছিল যে, যেকোনো ধরণের “অপরাধ এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি” তৈরির জন্য প্রিন্স ক্ষমা চেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে “তার পোশাক পছন্দের বিষয়টি ভাল ছিল না”।
২০০৯ সালে, এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে হ্যারি তার সেনা প্লাটুনের এক এশিয় সদস্যের বিষয়ে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করছেন।
সেন্ট জেমস’স প্যালেস বলে যে, প্রিন্স তার “ভাষার কারণে সৃষ্ট যেকোনো অপরাধের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত” কিন্তু সাথে এটাও বলে যে তিনি “কোন ধরণের বিদ্বেষ থেকে তিনি ওই ভাষা ব্যবহার করেননি এবং তার প্লাটুনের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় সদস্যের ডাক না হিসেবে তিনি সেটি ব্যবহার করেছেন।”
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক গেমসে অলিম্পিক অ্যাম্বাসেডর হিসেবে গণমাধ্যমের তার ভূমিকা নিয়ে খবর উপভোগ করেছেন তিনি।
একই বছর রানীর জয়ন্তী উপলক্ষে তিনি ক্যামেরার সামনে অনেক সময় পার করেছেন।
যাই হোক, সে বছর অগাস্টে, লাস ভেগাসে একটি হোটেলের কক্ষে এক তরুণীর সাথে প্রিন্সের নগ্ন ছবি প্রকাশিত হয়।
পরে তিনি বলেন যে, “আমি একটি সংরক্ষিত এলাকাতে ছিলাম এবং সেখানে ন্যূনতম মাত্রায় হলেও গোপনীয়তা থাকা উচিত ছিল যা একজন মানুষ আশা করে।”
সামরিক বাহিনী এবং দাতব্য কর্মকাণ্ড
হ্যারি প্রায় ১০ বছর সামরিক বাহিনীতে কাজ করেন, ২৫ বছরের মধ্যে তিনিই রাজপরিবারের একমাত্র সদস্য যিনি যুদ্ধাঞ্চলে কাজ করেছেন।
তিনি হতাশ হয়েছিলেন যখন ২০০৭ সালে সেনাপ্রধান তাকে ইরাক পাঠাতে অসম্মতি জানান “অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি”র কারণ দেখিয়ে, কিন্তু পরে ২০০৮ সালে আফগানিস্তানে তিনি ১০ সপ্তাহ দায়িত্ব পালন করেন।
পরে তিনি বর্ণনা করেন যে, তিনি কিভাবে এক তালেবান বিদ্রোহীকে গুলি করেছিলেন এবং বলেন যে, এটা তার জন্য “যেমনটা হওয়ার কথা ছিল তেমন স্বাভাবিকই” ছিল।
যখন তিনি ঘোষণা দেন যে ২০১৫ সালে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিচ্ছেন তখন তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী কাটানো সময় “বাকি জীবন সব সময় আমার সাথে থাকবে”।
এটা তার দাতব্য কর্মকাণ্ডেও ফুটে উঠেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং তাদের সহযোগিতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
১৯৯৭ সালে অ্যাঙ্গোলায় সক্রিয় মাইন পুঁতে রাখা মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন ডায়ানা।
নিজের সেই সফরের সম্পূর্ণ প্রভাব-যেমন অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি সই- দেখার আগেই সে বছরই প্যারিসে মারা যান তিনি।
কিন্তু ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হ্যারি যখন তার(ডায়ানার) পদাঙ্ক পুনরায় অনুসরণ করতে শুরু করেন, তখন তিনি তার অর্জনগুলো তুলে ধরেন।
মানসিক আঘাত মোকাবেলা
সম্প্রতি বছরগুলোতে, হ্যারি তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিয়েছেন।
২০১১ সালের এপ্রিলে তার ভাই উইলিয়ামের বিয়েতে বেস্টম্যান ছিলেন হ্যারি এবং তখন থেকে তিনি বলছেন যে, সেখানে ডায়ানা উপস্থিত না থাকাটা কতটা কষ্টের ছিল।
ডেইলি টেলিগ্রাফে দেয়া হঠাৎ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে তিনি তার আবেগ এবং তার মা সম্পর্কে চিন্তা করাটাকে দমিয়ে রেখেছেন।
‘সুন্দর বিস্ময়’
বিশ্বের অন্যতম হাই প্রোফাইল ব্যাচেলর হওয়ার কারণে, হ্যারির প্রেমের বিষয় নিয়েও বছরের পর বছর ধরে মানুষের আগ্রহ ছিল।
২০১৬ সালের শেষের দিকে, এক বিবৃতিতে তিনি মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের সাথে নতুন সম্পর্ক গড়ার কথা নিশ্চিত করেন। সাথে অভিযোগও তোলেন যে, সাংবাদিকরা তাকে(মেগানকে) হয়রানি করেছে।
২০১৮ সালের মে মাসে উইন্ডসরের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে এই যুগল বিয়ে করে এবং ডিউক এবং ডাচেস অব সাসেক্স বলে অভিহিত হন।
সে বছর অক্টোবরে ১৬ দিনের অস্ট্রেলিয়া সফরে ডিউক এবং ডাচেস ঘোষণা দেন যে, তারা তাদের প্রথম সন্তান আশা করছেন, এবং তারা তাদের এই “ব্যক্তিগত আনন্দের” খবর জানিয়ে খুশি।
২০১৯ সালের ৬ই মে বেবি আর্চি জন্মগ্রহণ করেন।
পরবর্তী অধ্যায়
ডিউক গত বছরটিতে নানা চড়াই-উৎরাই পার করেছেন।
আইটিভি’র এক ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয় যে, ডাচেস স্বীকার করেন যে রাজপরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে তাকে বেগ পেতে হচ্ছে। একই সময়ে ডিউক বলেন যে, প্রতিনিয়তই তার মানসিক স্বাস্থ্যের ‘খেয়াল রাখতে হচ্ছে’।
কিন্তু তার ভবিষ্যতের বেশিরভাগ বিষয়- যেমন তার স্ত্রী এবং ছেলের সাথে তিনি আসলে কোথায় বাস করবেন- এখনো স্পষ্ট নয়।