প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে জো বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনের জন্য দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পরিবর্তে, তার উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নাম প্রস্তাব করেছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের।
তার এই প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হোয়াইটি হাউসের দৌড়কে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা। তাকে ঘিরে প্রার্থীদের প্রচারও জোর কদমে চলছে। এসবের মাঝেই তার পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রচারে ইতি টেনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মি. বাইডেন।
সাম্প্রতিক কালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তার উপর ‘চাপ বাড়ছিল’।
রোববার একটি লিখিত বিবৃতিতে ৮১ বছরের মি বাইডেন জানিয়েছেন, সেবা করা ‘সবচেয়ে বড় সম্মানের’ কিন্তু সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত ‘আমার দল ও দেশের সর্বোত্তম স্বার্থে’।
গত ২৭ জুন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী এবং তার (জো বাইডেনের) প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি ডিবেট বা বিতর্ক অনুষ্ঠানে জো বাইডেনের ‘হতাশাজনক পারফর্ম্যান্সের’ পর প্রার্থী হিসাবে নিজেকে প্রত্যাহার করার জন্য তার উপর চাপ বাড়ছিল।
তাও তিনি পুনর্নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়াবেন না সে বিষয়ে প্রচার শিবির থেকে অবশ্য ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। তার এই সিদ্ধান্তে আবার ডেমোক্র্যাটদের অন্দরমহলের অনেকেই খুশি ছিলেন না।
একে কেন্দ্র করে মার্কিন রাজনীতিতে সম্প্রতি একটা টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের রোববারের ঘোষণা অবশ্য সেই পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটিয়েছে।
মি. বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকবেন।
ঘটনা পরম্পরা
গত সপ্তাহে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর ডেলাওয়ারে ছিলেন জো বাইডেন। তার প্রচার শিবিরের পক্ষ থেকে তার শারীরিক পরিস্থিতির বিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি জানানো হয়, চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনী প্রচারে বাইডেনকে আবার দেখা যেতে পারে।
দলের অন্দরমহল এবং বাইরে থেকে চাপের মুখোমুখি হয়েও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য ছবি বদলে যায়।
শনিবার সন্ধ্যায় আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেবেন কি না সে বিষয়ে জো বাইডেন ভাবনা চিন্তা করতে থাকেন বলে জানা গিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত যে তার ৫০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অন্যতম কঠিন সিদ্ধান্ত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা স্টিভ রিচেটি, চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট মাইক ডনিলন, তার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ অ্যানি টমাসিনি এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের চিফ অব স্টাফ অ্যান্থনি বার্নাল-সহ সহযোগীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন জো বাইডেন।
নির্বাচন সংক্রান্ত নতুন তথ্য, জনমত জরিপ এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে ঘনিষ্ঠ মহলের সঙ্গে তার আলোচনা হয়।
নতুন তথ্য, দলের অভ্যন্তরে চাপের মতো একাধিক বিষয়ের কথা মাথায় রেখে একটা সিদ্ধান্তে নিতেই হতো জো বাইডেনকে – এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
এরপর মি. ডনিলনের সঙ্গে বসে তার বিবৃতির খসড়া তৈরি করেন। তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার সংক্রান্ত ঘোষণা কার্যকর করা এবং সে বিষয়ে অন্যান্য কর্মীদের জানানোর দায়িত্ব নেন মি. রিচেটি।
রোববারের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, সেদিন (রোববার) সকালে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার চিফ অফ স্টাফ জেফ জিয়েন্টস, প্রচার শিবিরের চেয়ারম্যান জেন ও’ম্যালি ডিলন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ফোন করে তার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরেই তিনি (মি বাইডেন) বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন।এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল।”
কমলা হ্যারিসের প্রতি সমর্থন
জো বাইডেনের বিবৃতিতে প্রথমে কমলা হ্যারিসের নাম প্রস্তাব না থাকলেও, কিছুক্ষণ পরে সে বিষয়ে জানান।
উত্তরসূরি হিসাবে তার নাম প্রস্তাব করায় তিনি ‘সম্মানিত’ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন কমলা হ্যারিস। জানিয়েছেন, তার দলের মনোনয়ন তিনি ‘অর্জন করবেন এবং জিতবেন’ । শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধও করবেন।
কমলা হ্যারিস বলেছেন, “নির্বাচনের দিন অব্দি আমাদের হাতে ১০৭ দিন সময় আছে। আমরা সবাই এক সঙ্গে লড়াই করব। এক সঙ্গে আমরা জিতব।”
ডেমোক্র্যাটদের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার সমর্থন পেলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইতে মনোনীত হননি কমলা হ্যারিস।
এবং আনুষ্ঠানিক মনোনয়নের প্রক্রিয়া আগামী আগস্ট মাসে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের আগে নাও হতে পারে বলে অনেকে অনুমান করছেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সিনেট নেতা চাক শুমার এবং সাবেক হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি-সহ বহু নেতা মি. বাইডেনের প্রশংসা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ কমলা হ্যারিসের নাম প্রস্তাবকেও সমর্থন জানিয়েছেন, কেউ আবার উন্মুক্ত মনোনয়নের পক্ষে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, তারা নভেম্বরের নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করছেন। তাদের কথায়, “আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে তাকে (কমলা হ্যারিসকে) জেতাব।”
অন্যদিকে, মি. ওবামা অবশ্য কমলা হ্যারিস বা কারও নাম উল্লেখ না করেই বলেছেন যে তিনি (মি ওবামা) ‘ভীষণভাবে আত্মবিশ্বাসী’ ছিলেন যে একজন ‘অসাধারণ মনোনয়ন প্রত্যাশী’ আসবেন।
মিজ পেলোসি অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর পিটার ওয়েলচ কমলা হ্যারিসকে মনোনয়নের জন্য একটি ‘উন্মুক্ত প্রক্রিয়া’ গ্রহণের কথা বলেছেন। তিনিই প্রথম জো বাইডেনকে তার পুনর্নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এদিকে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জনমত জরিপে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, তার উপর হত্যার হামলার ঘটনার দিন কয়েকের মধ্যেই মিলওয়াকিতে অনুষ্ঠিত তার দলের কনভেনশনে রিপাবলিকান প্রার্থী হিসাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে মনোনয়ন গ্রহণও করেছেন।
এখন কী হতে পারে ?
ডেমোক্র্যাটরা কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী হিসাবে বেছে নেওয়ার বিষয়ে যদি একমতও হন তাহলেও নভেম্বরের নির্বাচনে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন করার আগে একাধিক বিষয় নিশ্চিত হতে হবে।
৩ হাজার ৮৯৬ প্রতিনিধির সমর্থন পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচনের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন মি. বাইডেন। এই সংখ্যা কিন্তু তার মনোনয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য যে পরিমাণ সমর্থন প্রয়োজন, তার চাইতে অনেক বেশি।
তবে তিনি এই নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সেই সমীকরণ বদলেছে।
নতুন মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কাকে বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে ওই ডেলিগেটদের উপর। আগামী ১৯শে আগস্ট শিকাগোতে ডেমোক্রেটদের কনভেনশনে তাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
যদি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নতুন প্রার্থীকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে যদি একমত না হতে পারে, তা হলে ১৯৬৮ সালের পর প্রথমবার ‘ওপেন কনভেনশন’ হতে পারে।
দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে একজন প্রার্থীর প্রয়োজন ১ হাজার ৯৭৬জন প্রতিনিধির ভোট।
তবে, কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়নের বিষয়ে অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা সমর্থন জানাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
মি. বাইডেনের উপর নির্বাচনি লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর চাপ বাড়ার সময় থেকেই গুঞ্জন ছিল তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করলে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন কমলা হ্যারিস।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম, যার প্রেসিডেন্ট হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে বলে মনে করা হয়, মি. বাইডেনকে “নিঃস্বার্থ” বলে প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি ট্রাম্পের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ‘নির্ভীক’ এবং ‘দৃঢ়’ মিস হ্যারিসকে সমর্থন করেন।
মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার বলেছেন যে তার কাজ “একই থাকবে … ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচিত করতে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে থামাতে সম্ভাব্য সব কিছুই” করছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
বাইডেনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার দলের পক্ষ থেকে সমালোচনা শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কটাক্ষ করে মি. ট্রাম্প লেখেন, ” তিনি যদি নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্য না হয়ে থাকেন তা হলে দেশ চালানোর যোগ্যও নন।”
মি. বাইডেনকে ‘ভণ্ড’ বলে কটাক্ষ করেছেন ট্রাম্প। মি বাইডেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছেন, ‘মিথ্যা ও ভুয়ো খবরের ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে পৌঁছেছেন। এমনকি নিজের বেসমেন্ট থেকেও বের হননি। চিকিৎসক ও গণমাধ্যমসহ তার চারপাশের সবাই জানতেন তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য নন।’
অন্যান্য সিনিয়র রিপাবলিকানরাও এই সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন এবং মি. বাইডেনকে শুধু তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহারই নয়, অবিলম্বে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার কথা বলেছেন।
ডিবেট অনুষ্ঠানই কি অনুঘটকের কাজ করেছে ?
সাম্প্রতিক একটি তর্কে অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেখানে বর্তমান প্রেসিডেন্টের পারফরম্যান্স আশানুরূপ ছিল না বলে অনেকেই সরব হন। এমনও কি তার নিজের দলের অন্দরমহল থেকেও ‘বয়সজনিত’ কারণ এবং অন্যান্য বিষয়কে মাথায় রেখে তাকে পরবর্তী নির্বাচন থেকে সরে আসার কথা বলা শুরু হয়।
এই অনুষ্ঠানই মি. বাইডেনের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ‘অনুঘটকের’ কাজ করেছে বলে মনে করেনা বিশেষজ্ঞরা।
বিবিসি ফাইভ লাইভে আমাদের সহকর্মীরা নির্দলীয় নিউজলেটার ইনসাইড ইলেকশনের সম্পাদক জ্যাকব রুবাসকিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। মি রুবাসকিন মনে করেন জো বাইডেনের অবস্থান “রাজনৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য” ছিল।
“এটা (বর্তমান পরিস্থিতি) কিন্তু নির্বাচনে সবকিছু বদলে দিয়েছে এবং আমাদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
“গত ২৭ জুনের সেই তর্ক অনুষ্ঠানই কিন্তু বর্তমান ঘটনার পিছনে অনুঘটকের কাজ করেছে। এটা (বাইডেনের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার) যদি হওয়ারই ছিল তা হলে এখনই হতে হতো।”