ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রথম ও একমাত্র পুরুষ সংসদ সদস্য একজন ফয়ছল হোসেন চৌধুরী এমবিই’র গল্প
বিশেষ প্রতিবেদনঃ ফয়ছল হোসেন চৌধুরী, একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, যিনি স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টের প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশী পুরুষ সংসদ সদস্য হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। তাঁর এই সাফল্য শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর জীবন সংগ্রাম, সংগ্রাম এবং অর্জন শুধুমাত্র তাঁকে নয়, বরং সমগ্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর শিকড় বাংলাদেশে, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বদরদী গ্রামে। তাঁর পরিবার ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক উন্নয়নে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। দাদা মরহুম শামসুল আলম চৌধুরী ও বাবা মরহুম গোলাম রাব্বানী চৌধুরী ছিলেন স্থানীয় সমাজে পরিচিত এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁদের পরিবার ছিল এলাকার উন্নয়নের অগ্রদূত। পরিবার থেকে পাওয়া এই সমাজসেবার শিক্ষা ফয়ছল চৌধুরীকে ভবিষ্যতে বড় মাপের সমাজসেবী ও নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
ফয়ছল চৌধুরী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন খোয়াই নদীর তীরবর্তী হবিগঞ্জের পুরান মুন্সেফী এলাকার রামচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রথম দিক থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তাঁর পরিবার যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
যুক্তরাজ্যে প্রবাসী জীবন এবং শিক্ষা
যুক্তরাজ্যে আসার পর, ফয়ছল চৌধুরী স্কটল্যান্ডের এডিনবারা শহরে বসবাস শুরু করেন। পরিবারের সাথে যুক্ত হয়ে প্রথমে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যাটারিং ব্যবসায় হাতেখড়ি নেন। বড় ছেলের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং বাবার অসুস্থতার কারণে তিনি পরিবারের ব্যবসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তিনি ব্যবসা ও নেতৃত্বের দক্ষতা অর্জন করেন, যা পরবর্তীকালে রাজনীতিতে তাঁর সফলতার ভিত্তি রচনা করে। ব্যবসায় সাফল্যের পাশাপাশি তিনি নিজের কর্মজীবনে স্কটল্যান্ডের বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
রাজনীতিতে প্রবেশ
ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ ২০১৭ সালে। তিনি লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে স্কটল্যান্ডের এডিনবারা সাউথইস্ট আসন থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যদিও তিনি সেই সময় নির্বাচিত হতে পারেননি, এটি ছিল তাঁর জন্য রাজনীতিতে একটি বড় পদক্ষেপ। তাঁর লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং অবিচল থাকায় তিনি ২০২১ সালে স্কটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচনে লোদীয়ান অঞ্চল থেকে স্কটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। এর মাধ্যমে তিনি স্কটল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশী সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
এটি ছিল একটি বড় অর্জন এবং বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত। তাঁর এই জয় বাংলাদেশী কমিউনিটিকে বিশ্বমঞ্চে আরো উজ্জ্বল করেছে। তাঁর এই রাজনৈতিক জয় তাঁকে স্কটল্যান্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের একটি অঙ্গ করে তুলেছে।
Sir Keir Starmer MP, Prime Minister of the United Kingdom – Anas Sarwar MSP, Leader of the Scottish Labour Party and Foysol Choudhury MSP, Shadow Minister for Culture, Europe and International Development.
কমিউনিটি সেবা এবং সামাজিক কাজ
ফয়ছল চৌধুরী শুধু একজন রাজনীতিবিদই নন, তিনি একজন সমাজসেবীও। স্কটল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও দাতব্য কাজে সম্পৃক্ত হন। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার গণভোটের সময় তিনি “বাংলাদেশীজ ফর বেটার টুগেদার ক্যাম্পেইন” এর সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কোভিড-১৯ মহামারির সময়, স্কটল্যান্ডে বসবাসকারী দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত এথনিক মাইনরিটি পরিবারের জন্য খাদ্য বিতরণের ব্যাবস্তা করেন। এডিনবরার এলরেক প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি ফুড সাপোর্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন এবং অসহায় পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করেন। তাঁর এই সমাজসেবামূলক কাজ স্থানীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
এমবিই খেতাব প্রাপ্তি
ফয়ছল চৌধুরীর সমাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং দায়িত্ববোধকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০০৪ সালে তিনি ব্রিটিশ রাণীর কাছ থেকে এমবিই (মেম্বার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) খেতাবে ভূষিত হন। এটি ছিল তাঁর জীবনের এক বিশাল অর্জন এবং তাঁর দীর্ঘদিনের সমাজসেবার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
এমবিই খেতাবের প্রাপ্তি ফয়ছল চৌধুরীকে শুধু একজন সফল রাজনীতিবিদ নয়, বরং একজন সমাজকর্মী এবং নেতা হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে। এই খেতাবের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে তাঁর নেতৃত্বের জন্য আরো বেশি সম্মানিত হন।
King Charles III, formerly known as The Prince of Wales and Foysol Choudhury
নেতৃত্ব এবং উদ্যোগ
ফয়ছল চৌধুরী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তিনি স্কটিশ পার্লামেন্ট এ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেন। এ ধরনের কার্যক্রম স্কটল্যান্ডের মূলধারায় বাংলাদেশী সংস্কৃতিকে প্রমোট করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশীদের জন্য তিনি একজন মডেল নেতা হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশী যুবকদের জন্য কর্মসংস্তান এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকার এবং তাদের সমস্যা নিয়ে তিনি সবসময় সচেতন রয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশী কমিউনিটি আজ স্কটল্যান্ডে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।
ব্যক্তিগত জীবন
ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবনও তাঁর সাফল্যের গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর স্ত্রী মির্জা তাহমিনা ফয়ছল চৌধুরী (মনি) একজন সমর্থক এবং সহানুভূতিশীল স্ত্রী, যিনি সবসময় তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁদের দুই সন্তান, ইকরাম হোসেন চৌধুরী এবং মাদিহা জান্নাত চৌধুরী, তাদের বাবার মতোই সমাজসেবা এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করছেন। মাদিহা স্কটিশ যুব সংসদের সদস্য, যা পরিবারের মধ্যে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ফয়ছল চৌধুরীর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশী কমিউনিটিকে আরো শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের ভূমিকা আরও সুসংহত করা। তিনি চান প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে কষ্ট ও সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলো সমাধানে কাজ করতে। তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনায় রয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত করা এবং তাদের কল্যাণে কাজ করা।
Robert Chatterton Dickson, British High Commissioner, Dr Wali Uddin MBE and Foysol Choudhury
ফয়ছল হোসেন চৌধুরী একজন আদর্শ সমাজসেবক এবং সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশীদের গর্বিত করেছেন। তাঁর সংগ্রাম, সেবা, এবং অর্জন আজকের এবং আগামী দিনের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর নেতৃত্বে স্কটল্যান্ডে বাংলাদেশীদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা এবং বাংলাদেশী জাতির জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
ফয়ছল হোসেন চৌধুরী, স্কটিশ পার্লামেন্টের সদস্য, ছায়ামন্ত্রী, সংস্কৃতি, ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রনালয় ।