ফাইনালের ‘টস, কন্ডিশন’ ও যেসব বিষয় বড় করে দেখছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটাররা
ডেস্ক রিপোর্টঃ ভারতের সাবেক ক্রিকেটার রাভি শাস্ত্রী ও সাঞ্জায় মানজ্রেকার বলেছেন টস ও কন্ডিশনের কারণেই ভারত ফাইনাল ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গেছে।
অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে বোলিং নিয়েছে এবং খুব অনায়াসেই ভারতকে ছয় উইকেটে হারিয়েছে।
২৪০ রানের লক্ষ্য শুরুর দশ ওভারে কঠিন মনে হলেও মার্নাস ল্যাবুশেইনের ধৈর্য্য ও ট্রাভিস হেডের দাপুটে ব্যাটিংয়ে সহজেই ছয় উইকেটের জয় তুলে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
এটা অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ ওয়ানডে বিশ্বকাপ শিরোপা, আটবার ফাইনাল খেলে ছয়বার শিরোপা জিতেছে দলটি।
প্যাট কামিন্সের অধীনে অস্ট্রেলিয়া এই বছর ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও জয় পেয়েছে।
এর আগে এই ব্যাচের ক্রিকেটাররা ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও জিতেছিল।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম দল হিসেবেই এগিয়ে যাচ্ছে।
এবারের বিশ্বকাপ আসরে ভারত শুধুমাত্র ফাইনালেই প্রথম অলআউট হয়েছে, অন্তত দুই দফায় টানা এক ঘণ্টা কোনও বাউন্ডারি মারতে পারেনি ভারতের ব্যাটাররা।
উইকেট নিয়ে কী বললেন শাস্ত্রি ও মানজ্রেকার?
রাভি শাস্ত্রি বলেন, “উইকেট ছিল মন্থর এবং অস্ট্রেলিয়া মাঠে নামার আগে উদ্বিগ্ন ছিল এটা নিয়ে। টসে তারা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।
শাস্ত্রির মতে, অস্ট্রেলিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, দারুণভাবে বল করেছে এবং উইকেটের যে ধীরগতি সেটাকে কাজে লাগিয়েছে।
বিশেষত অস্ট্রেলিয়া সুরিয়াকুমার ইয়াদাভকে যেভাবে বল করে থামিয়ে রেখেছে সেটার প্রশংসা করেছেন শাস্ত্রি।
তার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সুরিয়াকুমার ইয়াদাভকে ভালোভাবে চেনেন অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা। সুরিয়া গতিকে কাজে লাগিয়ে ভালো ব্যাট করেন, তাই তাকে একেবারে ধীরগতির বল দিয়ে পরাস্ত করার চেষ্টা করেছেন অজি বোলাররা।
সুরিয়া একটি হতাশাময় টুর্নামেন্ট কাটালেন এবার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের জন্য সুপরিচিত এই ভারতীয় নাম নিজের দক্ষতাকে ওয়ানডে ক্রিকেটে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ভারতের সাবেক ক্রিকেটার সঞ্জয় মানজ্রেকার বলেছেন, “এই খেলাটা এতোটাই পরিবেশ নির্ভর ছিল যে অস্ট্রেলিয়া টস জিতে আর ভাবেনি, বোলিং নিয়ে নিয়েছে।”
অস্ট্রেলিয়ার এই জয়ের পেছনে সঞ্জয় দেখছেন খাঁটি ক্রিকেটীয় যুক্তি, বাস্তবতা এবং উইকেট-যেটা অস্ট্রেলিয়া খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ফাইনালের আগে থেকেই আহমেদাবাদের রাতের আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। রাতের একটা সময়ে উইকেটে আর্দ্রতার কথা বলা হচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জয়ের জন্য যথেষ্ট রান তুলে ফেলেছে।
মানজ্রেকার বলেছেন, “সিদ্ধান্তটা দারুণ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া কারণ যে পরিমাণ শিশির এখানে রয়েছে তাতে ব্যাট করাটা তুলনামূলক সহজই।”
বিকালে যে উইকেটে ভারত ব্যাট করেছে সেটায় ব্যাট করা কঠিন ছিল বলে মনে করছেন সাঞ্জায় মানজ্রেকার।
তার বিপরীতে অস্ট্রেলিয়া যখন ব্যাট করেছে তারা স্বস্তিতে ছিল, এরপর শিশির এলো এবং এটাকে অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটা ‘বিশাল বোনাস’ বলেই মনে করছেন ভারতের এই সাবেক ক্রিকেটার।
ভারত যখন ব্যাট করছিল তখন বল সহজেই ব্যাটে আসছিল না।
রোহিত শর্মা আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতীয় ব্যাটাররা ওভারপ্রতি আট করে রান তুলছিল।
১০ ওভার থেকে ৫০ ওভার পর্যন্ত কখনোই এই রান রেট পাঁচের ওপর ওঠেনি।
পরে ব্যাট করা সহজ হয়ে উঠেছে বলছেন ভারতীয় ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।
রক্ষণাত্মক ছিল ভারত?
মানজ্রেকার বলছেন, গোটা পরিবেশের প্রভাব পড়েছে ভারতের স্পিনারদের বোলিংয়ে যেটা দলটার বড় শক্তি।
যে কারণে মাঝের ওভারগুলোতে অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যাট করেছে ১৯২ রানের জুটি গড়েছেন ট্রাভিস হেড ও মার্নাস ল্যাবুশেইন।
মানজ্রেকার বলেন, “ভারত মূলত কন্ডিশনের কারণেই হেরেছে, যেটা প্রমাণিত হয় কুলদীপ ইয়াদাভ ও রাভিন্দ্রা জাদেজা যখন যথেষ্ট টার্ন পাননি উইকেট থেকে”।
ভারত বাউন্ডারি মারতে হিমশিম খেয়েছে গোটা ইনিংসেই।
এমনকি এক ট্রাভিস হেডই গোটা ভারতীয় ক্রিকেট দলের চেয়ে ফাইনালে বেশি বাউন্ডারি মেরেছেন।
রাভি শাস্ত্রি বলেছেন, ভারতের যদি কোনও সমালোচনা করতে হবে তবে সেটা রক্ষণাত্মক ক্রিকেট।
তবে শুধু ব্যাটিংয়ে না, বোলিংয়ের দিক থেকেও ভারত রক্ষণাত্মক ছিল বলেই মনে করেন তিনি, যেমন অস্ট্রেলিয়ার ৩ উইকেট ফেলে দেয়ার পর আরও আগ্রাসী হওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তিনি।
রাভি শাস্ত্রির মতে, “স্লিপ দেয়া প্রয়োজন ছিল, ফিল্ড সেটাপ আরও আক্রমণাত্মকর করা প্রয়োজন ছিল। ২৪১ রানের টার্গেট দিয়ে প্রতিপক্ষকে আটকাতে হলে আপনার উইকেটের বিকল্প নেই”।
ট্রাভিস হেড যেন ‘অ্যাডাম গিলক্রিস্ট’
ট্রাভিস হেড গত রাতে প্রায় একাই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জিতিয়ে এনেছেন।
ম্যাচের কোনও মুহূর্তেই তাকে চাপে মনে হয়নি।
ফাইনাল ম্যাচ, দর্শকদের প্রেসার কিছুই তাকে কাবু করতে পারেনি।
ট্রাভিস হেড চলতি বছর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন।
ট্রাভিস হেডের এমন একটি ইনিংসের পর আজ উঠে এসেছে প্রয়াত কিংবদন্তী ক্রিকেটার শেন ওয়ার্নের ২০১৬ সালে করা একটি টুইট যেখানে তিনি লিখেছেন, “আমি ক্রিকেটার ট্রাভিস হেডের ভক্ত। আমি মনে করি সব ফরম্যাটের জন্য অস্ট্রেলিয়ার এক সম্পদ হয়ে উঠবেন ট্রাভিস হেড”।
ট্রাভিস হেডের ১৩৭ রানের ইনিংসটি মনে করিয়ে দিলো ২০ বছর আগে রিকি পন্টিংয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে ১৪০ রান, একই প্রতিপক্ষ ভারতের বিপক্ষে।
অস্ট্রেলিয়া প্রতিবারই বিশ্বকাপ ফাইনালে এমন নায়োকচিত পারফর্মার পেয়ে যায়।
যেমন ১৯৯৯ সালে শেন ওয়ার্ন, ২০০৩ সালে রিকি পন্টিং, ২০০৭ সালে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর এবারে ট্রাভিস হেড।
মাইকেল ভন ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফে একটি লেখায় এই জয়টিকে ‘অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ জয়’ বলে আখ্যা দেন।
কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন আহমেদাবাদের গোটা মঞ্চই তৈরি হয়েছিল ভারতের হাতে কাপ তুলে দেয়ার জন্য।
‘এক সমুদ্র সমর্থকদের মধ্যে ১১ জন অস্ট্রেলিয়ান যে পারফরম্যান্স দেখালো সেটা অতুলনীয়’।
ভারত আসলে কতোটা ভালো দল?
ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর যদিও কোনও দলেরই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব মেলানোর মতো অবস্থা থাকে না কিন্তু ভারত ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পর টানা তিন বিশ্বকাপে মোট ২৮ ম্যাচ খেলে মাত্র চারটিতে হেরেছে, যার মধ্যে দুটি সেমিফাইনাল আর একটি গতরাতের ফাইনাল।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া গত সাতটি ক্রিকেট বিশ্বকাপের পাঁচটিতেই চ্যাম্পিয়ন।
গোটা টুর্নামেন্টজুড়ে ভারতের ক্রিকেট ছিল নিখুঁত।
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ছিল শ্রেয়তর দল।
এটাই বাস্তবতা।
ভিরাট কোহলি ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কারটি হাতে নিয়েছেন মলিন মুখে, তার ব্যাটে ৭৬৫ রান এসেছে।
এক আসরে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অন্য কোনও ব্যাটারের ৭০০ রান নেই।
মোহাম্মদ শামি এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
রোহিত শর্মা, শ্রেয়াস আইয়ার, লোকেল রাহুল প্রত্যেকে নিজেদের কাজটা ভালোভাবে করেছেন গোটা টুর্নামেন্টে।
কিন্তু ফাইনাল ম্যাচে ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করলো ভারত।
অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার ব্রেট লি মনে করেন, স্লো পিচটাই ভারতের হারের বড় কারণ, এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটাকে লাঘব করেছে।
লি বিশ্বাস করেন ভারতের যে মানের ফাস্ট বোলার ছিল তাদের উচিত ছিল বাউন্সি পিচে খেলা এটা শামি-বুমরাদের জন্য ভালো হতো।
ফক্স স্পোর্টসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লি বলেন, “যদি আপনি দেখেন উইকেটে টার্ন ছিল এবং যত বেলা গড়ালো সেটা ব্যাটারদের জন্য সহজ হয়ে এল। আমি অবাক হয়েছি যে ভারত এমন ফাস্ট বোলারদের নিয়ে এমন উইকেট কেন বেছে নিলো”।
ব্রেট লি বিশ্বাস করেন, “কাপটা ভারতেরই নেয়ার কথা ছিল কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলটা ভীষণ জেদি এই জেদের সামনে ভারত টিকতে পারেনি”।
ভারতের এই দলটার দারুণ এই টুর্নামেন্টের কোচ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, তিনি প্রেস কনফারেন্সে জানিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে চালিয়ে যাবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি অনিশ্চিত তবে এই দলটা নিয়ে তিনি গর্বিত।
ক্রিকেটের জনপ্রিয় উপস্থাপক হারশা ভোগলে লিখেছেন, “এই দলটাই টানা ১০ ম্যাচে জিতে এই পর্যায়ে এসেছেন আর এর পেছনে ছিলেন একজন ব্যক্তি- রাহুল দ্রাবিড়। গোটা সময় তিনি ছিলেন পর্দার আড়ালে। সামনে এলেন যেদিন দল হারলো, প্রেসের মুখোমুখি হলেন, ক্রিকেটারদের সমর্থনে কথা বললেন”।
আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩- সেরা একাদশ
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩ এর সেরা একাদশ ঘোষণা করেছে কিছুক্ষণ আগে।
কুইন্টন ডি কক,
রোহিত শর্মা,
ভিরাট কোহলি,
ড্যারেল মিচেল,
কে এল রাহুল,
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল,
রাভিন্দ্রা জাদেজা,
জসপ্রিত বুমরাহ,
দিলশান মধুশানাকা,
অ্যাডাম জাম্পা ও
মোহাম্মদ শামি।
বিশ্বকাপের টুকিটাকি
- সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত স্কোর – গ্লেন ম্যাক্সওয়েল অপরাজিত ২০১ রান বনাম আফগানিস্তান।
- সবচেয়ে বেশি রান- ভিরাট কোহলি (৭৬৫)।
- সবচেয়ে বেশি উইকেট- মোহাম্মদ শামি (২৪)।
- সেরা ব্যাটিং গড়- ভিরাট কোহলি ৯৫.৬২।