ফ্রান্স নির্বাচন: কীভাবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ভোটে জিতলেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ প্রথমেই বলা দরকার – এমানুয়েল ম্যাক্রঁর দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনী বিজয় কোন সাধারণ ঘটনা নয়।
ফ্রান্সে গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুননির্বাচিত হলেন।
বিবিসির বিশ্লেষক হিউ স্কোফেল্ড বলছেন, এক হিসেবে বলা যায়, ফ্রান্সে পঞ্চম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হবার পরের ইতিহাসে এই প্রথম বার এমন ঘটনা ঘটলো।
কারণ হলো, এটা ঠিকই যে এর আগে ১৯৮৮ সালে ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ এবং ২০০২ সালে জ্যাক শিরাক দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন – কিন্তু নির্বাচনের সময় এরা দু’জনেই প্রায় বিরোধী দলের প্রেসিডেন্টে পরিণত হয়েছিলেন। কারণ ভোট যখন হচ্ছিল, তখন ফ্রান্সের আসল ‘সরকার’ ছিল তাদের বিরোধীদের কব্জায়, রাজনৈতিকভাবে এরা দু’জনেই তখন ছিলেন ক্ষমতাহীন।
এ ছাড়া ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন শার্ল দ্য গলও – কিন্তু প্রথম মেয়াদে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন না।
সুতরাং, আধুনিক ফ্রান্সে মি. ম্যাক্রঁই হচ্ছেন প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি একটি পুরো মেয়াদ তার দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির প্রতিটি দিক পরিচালনা করার পর – দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও জনগণের আস্থা অর্জন করলেন।
বলা হয় – ফ্রান্সের জনগণের সাথে তাদের সরকারের সম্পর্কটা ঠিক সুবিধের নয়, কারণ ফরাসীরা নাকি যেটা করে তা হলো – হর্ষধ্বনি দিয়ে এক একটা সরকারকে ক্ষমতায় এনে বসায়, তার পর সেটাকে আবার প্রথম সুযোগেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
তাহলে প্রশ্ন হলো: এমানুয়েল ম্যাক্রঁ এটা সম্ভব করলেন কেমন করে?
‘লা পেনকে ঠেকাতেই ম্যাক্রঁকে ভোট দিচ্ছি’
বিবিসির ইউরোপ সম্পাদক কাতিয়া অ্যাডলার বলছেন, নির্বাচনের আগে থেকেই ফ্রান্সে একের পর এক ভোটার তাকে বলেছিলেন, মারিন লো পেনের জয় ঠেকানোর জন্যই ম্যাক্রঁকে ভোট দেবেন তারা।
ফ্রান্সের রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী প্রার্থীকে ঠেকানোর জন্য ভোটারদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নতুন কিছুই নয়।
মি. ম্যাক্রঁকে পছন্দ করেন না এমন বহু প্রার্থী এবার মারিন লো পেনকে ভোট দেন – যিনি এবার রেকর্ড ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। লক্ষ লক্ষ লোক তাদের ভোট নষ্ট করেছেন, এমনকি ভোট দিতে যানও নি।
তার পরও মি. ম্যাক্রঁ ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন । এর পেছনে তার সমর্থকরা তো আছেনই, আরো আছেন তারা – যারা মারিন লো পেন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন এটা কোনমতেই দেখতে চান না।
প্যারিসে কথা হচ্ছিল সাংবাদিক ও লেখক আনা ইসলামের সাথে।
আনা ইসলামের কথায়, মারিন লো পেনদের রাজনীতির মূল কথাই হচ্ছে বিদেশী-অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ, তাদের কথা ‘ফ্রান্স শুধু ফরাসীদের।’ কিন্তু ম্যাক্রঁর বার্তা ছিল: এ দেশ সব নাগরিকের – যে যেখান থেকেই এসে থাকুক।
এর পাশাপাশি মারিন লো পেনের মত একজন ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট হবেন -এটাও লোকে মেনে নিতে পারছিল না। এখানে ল মঁদ পত্রিকা লিখেছে, যেসব কারণে ফ্রান্সকে প্রগতিশীল দেশ বলা হয়, এই দক্ষিণপন্থীরা সেটাকে একেবারেই নষ্ট করে দিয়েছে। সাম্য, মৈত্রী আর ভ্রাতৃত্বের আদর্শের বিরোধী কেউ এ দেশের নেতৃত্বে আসুক এটা কোন মতেই লোকে চাইবে না” – বলছিলেন আনা ইসলাম।
তিনি বলছিলেন, গত পাঁচ বছরে ফ্রান্সের ভোটারদের মধ্যে এমানুয়েল ম্যাক্রঁর সমর্থন অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন রুশ অভিযানের পর তার ভুমিকার কারণে মি. ম্যাক্রঁর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়।
বিশেষ করে দ্বিতীয় রাউণ্ডের নির্বাচনে যখন ম্যাক্রঁ বা মারিন লা পেন – এই দুজনের কোন একজনকে বেছে নেবার প্রশ্ন উঠলো – তখন অনেক ভোটারই শুধু মারিন লো পেনকে ঠেকাতে ম্যাক্রঁকে ভোট দেন।
“এখানে অনেকে আছে যারা মনে করেন মি. ম্যাক্রঁ ধনীদের প্রেসিডেন্ট এবং তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সামাজিক খাতে বিশেষ কিছুই করেননি । তারাও কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেই ভোটটা দিয়েছেন” – বলেন আনা ইসলাম।
অভিবাসী-বংশোদ্ভূতদের ভোট
প্যারিসে ২০২০ সালের অক্টোবরে একটি স্কুলের শ্রেণীকক্ষে ইসলামের নবীর কার্টুন প্রদর্শনের পর শিক্ষক স্যামুয়েল পাতিকে হত্যার ঘটনা নিয়ে এমানুয়েল ম্যাক্রঁর কথাবার্তা ফরাসী মুসলিমদের অনেকেরই পছন্দ হয়নি।
আনা ইসলাম বলছিলেন, তার অভিজ্ঞতায় এরকম পটভূমিতে বিশেষ করে মাগরেব অর্থাৎ আলজেরিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়ান অভিবাসী বংশোদ্ভূতদের অনেকেই ম্যাক্রঁকে ভোটদানে বিরত ছিলেন।
তবে এবার নির্বাচনের আগে উগ্র-ডানপন্থী মারিন লো পেন বলেছিলেন, তিনি জয়ী হলে মুসলিম নারীদের প্রকাশ্যে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করবেন, ফ্রান্সকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের করে আনবেন।
কিন্তু তার বিপরীতে মি. ম্যাক্রঁ স্পষ্টই বলেন, তিনি হিজাব নিষিদ্ধ করবেন না এবং ইইউ ও তাতে ফ্রান্সের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবেন।
“একারণে অন্য অনেক অভিবাসী-বংশোদ্ভূত ভোটারই আবার ভেবেছেন, মারিন লো পেনের সাথে তুলনা করলে এমানুয়েল ম্যাক্রঁর বিকল্প তো কেউই নেই – তাই তাকেই ভোট দিতে হবে। ”
কীভাবে জনমতকে তার পক্ষে আনলেন ম্যাক্রঁ
হিউ স্কোফেল্ড বলছেন, মি. ম্যাক্রঁ ফ্রান্সের জনমতকে তার পক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছেন প্রধানতঃ দুটি উপায়ে।
একটি হলো: সামাজিক মাধ্যমে প্যারিসের উদ্ধত বড়লোক আর ক্রুদ্ধ প্রাদেশিক জনতার হাজার হাজার টিটকারি-ঠাট্টা-বিদ্রুপ সত্ত্বেও ফ্রান্সের লক্ষ লক্ষ মধ্যপন্থী মানুষ মনে করে যে মি. ম্যাক্রঁ প্রেসিডেন্ট হিসেবে খুব একটা খারাপ করেননি।
এই লোকেরা মনে করেন, ফ্রান্সে ম্যাক্রঁ যেসব সংস্কার এনেছেন সেগুলোর ফলে বেকারত্ব আর কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়। তারা মনে করে কোভিডও ভালোই সামাল দিয়েছেন তিনি। আর তিনি অবসর নেবার বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন – এটা আসলে অবধারিত ছিল।
হিউ স্কোফেল্ডের কথায়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মি. ম্যাক্রঁর একটা নিজস্ব ইমেজ তৈরি হয়েছে। তিনি যে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সোজাসুজি কথা বলতে পারেন – এটাও লোকে পছন্দ করেছে – যদিও ওসব বৈঠকে তেমন কোন কাজ হয়নি।
ফরাসী রাজনীতির অনেক কিছুই ভেঙে দিয়েছেন ম্যাক্রঁ
হিউ স্কোফেল্ড লিখছেন, ফরাসী রাজনীতিতে রক্ষণশীল আর সোশাল ডেমোক্রেটদের চিরাচরিত প্রাধান্য ভেঙে দিয়েছেন এমানুয়েল ম্যাক্রঁ।
তিনি ফ্রান্সের পঞ্চম রিপাবলিকের কিছু অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করে এলিসি প্রাসাদ থেকে এক নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। ফলে তার বিরোধীরা এখন বাম ও ডান – এই দুই ‘চরম’ মেরুতে চলে গেছে। মি. ম্যাক্রঁকে তারা কেউই চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না।
মি. ম্যাক্রঁর বিরোধীদের তাই এবার হয় জঁ-লুক মেলেশঁর মত উগ্র বামপন্থী – নয়তো মারিন লো পেনের মত উগ্র ডানপস্থীকে ভোট দিতে হয়েছে।
ফ্রান্সের সমাজও হয়ে পড়েছে বিভক্ত। নির্বাচনী জয়ের পর মি. ম্যাক্রঁ-ও বলেছেন এ “বিভক্তিকে জোড়া লাগানোর” কথা, “সবার প্রেসিডেন্ট হবার জন্য” তার চেষ্টার কথা।
এ বছরের জুন মাসে ফ্রান্সে পার্লামেন্টারি নির্বাচন হবে – তাই এটা দেখার বিষয় হবে যে সেখানে কী ফল হয়।
ফ্রান্স বিভক্ত, কিন্তু উল্লসিত ইইউ
বিবিসির কাতিয়া অ্যাডলার লিখছেন – ফ্রান্সে সমাজ যে শুধু পার্টি লাইনে বিভক্ত তাই নয়, এখানে আরো নানা মেরুকরণ আছে। বিভক্তি আছে প্যারিসের মত ধনী শহুরে শ্রেণী আর অবহেলিত শহর ও গ্রামের মধ্যে, জাতীয়তাবাদী আর আন্তর্জাতিকতাবাদীদের মধ্যে, ধনী আর দরিদ্র ও প্রান্তিকদের মধ্যেও।
মি. ম্যাক্রঁর অঙ্গীকার ছিল তিনি ডান বা বাম কোন রাজনীতির প্রতিই পক্ষপাত দেখাবেন না, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবেন। কিন্তু কোভিড মহামারির মধ্যে এগুলোর অনেক কিছুই পূরণ হয়নি।
তবে মি. ম্যাক্রঁ তার দেশের ভেতরে যতই বিভাজন-সৃষ্টিকারী হোন না কেন – দেশের বাইরে বিশেষত ইউরোপিয় ইউনিয়নের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ব্রাসেলসে তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।
তার জয়লাভের পর অভিনন্দন জানাতে ইইউ নেতাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
কারণ ম্যাক্রঁ ইইউর ব্যাপারে খুবই উৎসাহী, তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ফ্রান্সের পতাকার সাথে ছিল ইইউর পতাকাও । তিনি চান খাদ্য, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপকে স্বনির্ভর করে তুলতে।
বিশেষ করে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর এসব নীতি ইইউর নেতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
হবে না-ই বা কেন? ফ্রান্স হচ্ছে ইইউর দ্বিতীয় বৃহত্তম অথনীতি, এবং – ব্রিটেন বেরিয়ে যাবার পর – একমাত্র বড় সামরিক শক্তি। ব্রাসেলসে যেমন, তেমনি নেটো জোটেও ফ্রান্স বরাবরই নেতৃস্থানীয় ভুমিকা পালন করে এসেছে।
অন্যদিকে মারিন লো পেনের ইইউ-বিরোধিতা সর্বজনবিদিত – যাকে বলে ‘ইউরোস্কেপটিক’ বা ‘ইউরো-সংশয়বাদী’। মস্কোর সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং ফ্রান্সকে নেটো জোট থেকে বের করে নিয়ে যাবার ইচ্ছের কথা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের উদ্বিগ্ন করেছে।