বঙ্গবন্ধু নামটি দেশবাসীকে তিতা বানিয়ে ফেলেছে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করার সুযোগ নেই তবে গত পনের বছরে তাকে নিয়ে যে ভাবে মাতামাতি করা হয়েছে তা তার সম্মান বৃদ্ধির পরিবর্তে সম্মান হানিকর হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন বই-পুস্তক থেকে শুরু করে হাটে-বাজারে, রেডিও-টিভি মিডিয়ার এহেন কোনো স্থান নেই যেখানে শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া নেই। বঙ্গবন্ধুর অলীক স্বপ্ন ছিলো সর্বত্র। আর তা হয়েছিল অতিউৎসাহী আওয়ামী দালাল, সবে গত হওয়া স্বৈরাচারী সরকারের অতিকথন, অদূরদর্শিতার জন্য। যার পিছনে লুকায়িত ছিলো অনেক বড়ো বড়ো দুর্নীতি।
ধরুন আপনি বিদেশ থেকে এসেছেন এখন আপনার নিজ বাড়িতে যাচ্ছেন। তার একটা যাত্রা বিবরণী দেই।
বিমান থেকে নেমে মাত্র দশ কদম, মানে মাত্র দশ কদম পার হতেই দেখতে হতো শেখ মুজিবের এক ব্যানার, যেখানে বলা হয়েছে Welcome to the land of Mujib অর্থাৎ মুজিবের ভূমিতে বা দেশে আপনাকে স্বাগতম। মুজিবের ছবি দেখার মধ্যদিয়ে আপনার বাংলাদেশ ভ্রমণ শুরু হলো। সিকিউরিটি চেক পার হয়ে, লাগেজ কালেক্ট করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হবে মুজিবের ছবি দেখতে দেখতে। এরপর আপনি যেখানেই যান না কেন শেখ মুজিব যেন আপনাকে আর পিছু ছাড়ছে না। রাস্তা পারাপার হয়ে উঠলেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসে, তাও দেখি বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেস। এক্সপ্রেস থেকে নামলেন যে রাস্তায় তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে গেলেন হাসপাতালে তাও দেখি বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল। রিক্রিয়েশনের জন্য খেলা দেখতে যাবেন সেটিও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু কাপ, বাচ্চাদের নিয়ে একটু ঘুরতে যাবেন সেখানেও বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, জাদুঘর বা চিড়িয়াখানায় যাবেন তাও বঙ্গবন্ধু। ভাবলেন শহরে আর থাকবেন না, চলে যাবেন গ্রামে, পার হতে হবে নদী, শান্তি নাই আপনাকে যেতে হবে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে। কোথায় যাবেন, যেখানেই যাবেন সেখানেই বঙ্গবন্ধু। ধ্যাৎ, দেশেই থাকবোনা চলে যাবো বিদেশে, ব্যবহার করবেন আকাশ সেখানেও আছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ইত্যাদি ইত্যাদি।
সরকারি কাজের প্রতিটি প্যাডে, প্রতিটি এডে বঙ্গবন্ধু আর মুজিবের বন্দনার ছড়াছড়ি । বই-পুস্তক, চারু ও কারুকলা, স্থাপনা, শিল্প-সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, এমন একটি ক্ষেত্রও নেই যেখানে বঙ্গবন্ধু আর শেখ মুজিব নামের উপস্থিতি নেই। গড়ে উঠেছে নাম বেনামে শত শত প্রতিষ্ঠান, মূর্তি, ভাস্কর্য আপনি ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক বঙ্গবন্ধু বা শেখ মুজিব নামকে জপতে হবেই। সদ্যগত হওয়া স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবকে লেবুর মত অতিরিক্ত কচলায় একেবারে তিতা বানায়া ফেলেছে দেশবাসীর কাছে। শেখ সাহেবের ইমেজ, সম্মান, তার ব্যক্তিত্ব, সংগ্রাম সব কিছু ফিকে করে দিয়েছে সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না।
অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একটি নাম, একটি ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক নাম। তার স্থান অনেক উঁচুতেই ছিলো, সম্মানের জায়গাতে, ছিলো মানুষের ভালোবাসায় আর আবেগে। কিন্তু অতি তোষণ, সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, এবং আওয়ামী দালালির কারণে বঙ্গবন্ধু মানুষের কাছে বিতশ্রদ্ধার পাত্র হয়েছে। সম্মান কখনও জোর করে আদায় করা যায় না। সম্মান আসবে মানুষের মন থেকে, মানুষকে বাধ্য করে না। গত পনের বছরে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান শ্রদ্ধা করতে বাধ্য করেছে, ফলে মানুষের ভিতর ভিতরে বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ পরিবারের উপর মানুষের অসম্মান, রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, বিতৃষ্ঞা বাড়তে থাকে মনের অজান্তেই।ক্ষমতা হারানোর পরে সর্বস্তরের মানুষ তাদের মনের মধ্যে চেপে রাখা সমস্ত ক্ষোভ ও বিদ্বেষ আগ্নেয়গিরি জ্বলন্ত লাভারমতো উদগীরণ করেছে।
আপনাদের নিশ্চয়ই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বৈরশাসক যেমন তুরুস্কের কামাল আতাতুর্ক, জার্মানির হিটলার, ইতলীর মুসোলিনি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির, পাকিস্তানের পারভেজ মোশারফ, সুদানের ওমর আল বাসার ও জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের কথা মনে আছে। তাদের পতনের পর মানুষ সবার আগে যে কাজটি করেছিলো তাহলো তাদের মূর্তি, প্রতি মূর্তি, স্ট্যাচু, তাদের নামের স্থাপনা, অর্থাৎ এই স্বৈরাচারী শাসকগণ যা নিয়ে বেশী গর্ব করতো তা সবার আগে ভেঙে ফেলেছে।আমরা দেখেছি কিভাবে তাদের মূর্তিগুলো গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, তাদের মূর্তিগুলোকে গলায় রশি দিয়ে টেনে জমিনে ফেলে দিয়েছিলো। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশের তরুণরা যখন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিক আন্দোলন করছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক, হাসিনা সরকার সেই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার করার জন্য ভুল পথ বেছে নিয়ে প্রায় হাজার খানেক নিরস্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে, হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত ও পঙ্গু করে, এবং গ্রেফতার করে হাজারে হাজার। আল্টিমেটলি, ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে জয়ী হয় আর স্বৈরশাসক পরাজিত ও পরাভূত হয়, সরকার প্রধান দেশ ছেড়ে পালতে বাধ্য হয়। বিজয়ের আনন্দ উৎযাপন করতে গিয়ে কিছু লোক উত্তেজিত হয়ে সবার আগে স্বৈরশাসকের অহংকারের প্রতীক, গর্বের চিহ্ন, আত্মতৃপ্তি ও জৌলুসের স্থাপনা বঙ্গবন্ধুর মূর্তির উপর আঘাত করে, দেশের যেখানে যেখানে শেখ মুজিবের মূর্তি ছিলো তা সব ভেঙে ফেলে, ঠিক একই কায়দায়, একই পদ্দতিতে, একই গতিতে যেভাবে অন্যান্য দেশের পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছিলো।
আওয়ামী সরকারের অনেক আগেই বুঝা উচিত ছিলো যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, চিরকাল সবাই ক্ষমতায় থাকে না। ক্ষমতা থেকে আজ হোক, কাল হোক নামতেই হবে।ইতিহাস থেকে তাদেরও শিক্ষা নেয়া দরকার ছিলো যে আগের স্বৈরশাসকদের প্রতি মানুষের আচরণ কেমন ছিলো ক্ষমতা হারানোর পর।কেমন নিষ্ঠুর ছিলো সে আচরণ। জনগণের ভাষা ও মেজাজ তারা বুঝতে ভুল করেছিলো, ফলে স্বৈরশাসক হাসিনা শুধু ক্ষমতাই হারায় নি বরং তার ও তাদের দলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হলো বাংলাদেশে।আগামী পঁচিশ বছরেও আওয়ামীলীগ আজকের এই ধংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াতে পারবে না, এটি অন্তত নিশ্চিত। এখান থেকে পরবর্তী সরকারের জন্যও রয়েছে শিক্ষা যদি তারা বুঝে থাকে।
লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
১৫/০৮/২০২৪, লন্ডন।