বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ বদলে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। আসছে নানা পরিবর্তন। দীর্ঘ বছর থেকে চলে আসা এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নানা নিয়মকানুনে আসছে পরিবর্তন। পরিমার্জিত এই শিক্ষাক্রমের পাইলটিং চলবে ২০২২ সাল থেকে আর তার পরের বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে বাস্তবায়ন করা শুরু হবে। আর সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হবে ২০২৭ সাল থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গতকাল সোমবার জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত রূপরেখা উপস্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। পরে সচিবালয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডা. দীপু মনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিমার্জিত কারিকুলামের খসড়া অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী।
২০২৩ সাল থেকে হবে না পিইসি ও জেডিসি পরীক্ষা। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০২৩ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা থাকবে না। সাময়িক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ এবং অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা থাকবে না।
বদলে যাচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল মিলিয়ে এইচএসসি’র ফলাফল হবে। বদলে যাবে গ্রেডিং পদ্ধতি। ডা. দীপু মনি বলেন, নবম ও দশম শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা নামে বিভাগ তুলে দেয়া হচ্ছে। একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম থাকবে এই পর্যায়ে। ১০ শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয় ঠিক করা হয়েছে। সেগুলোই সবাই পড়বে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো পড়বে শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যে বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিক থেকে। পরিবর্তন হতে পারে এইচএসসি পরীক্ষার নাম ও গ্রেডিং পদ্ধতি।
মন্ত্রী বলেন, আগের কারিকুলামে এসএসসি’র পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো নবম ও দশম শ্রেণির কারিকুলামে। ২০২৩ সাল থেকে শুধু দশম শ্রেণির কারিকুলামেই এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। নবম শ্রেণিতে যে বিভাজন ছিল সেটা রাখছি না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে সব বিষয়গুলো পড়তে হবে।
এখন থেকে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা হবে বলেও জানান মন্ত্রী। দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পরীক্ষায় বসবে শিক্ষার্থীরা। দশম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা এসএসসি আর একাদশ ও দ্বাদশ সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে প্রকাশ করা হবে এইচএসসি’র ফল।
মন্ত্রী জানান, নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হবে আগামী বছর। এক্ষেত্রে প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণি আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু হবে। আর প্রয়োগ শুরু হচ্ছে ২০২৩ সালে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে হবে শিক্ষা উন্নয়ন, শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রণয়ন ও এবং পাইলটিংয়ের প্রস্তুতি। ২০২২ সালে হবে নির্বাচিত বিদ্যালয়ে শিক্ষাক্রম ও শিখন-শেখানো সামগ্রী পাইলটিং। ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কার্যক্রম প্রবর্তন। পরের বছর তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে প্রবর্তন। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম। ২০২৬ সালে একাদশ ও এরপরের বছর হবে দ্বাদশের প্রবর্তন।
এতে আরও দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত হবে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন অর্থাৎ হবে না পরীক্ষা। ৪র্থ থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে পরীক্ষায় মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। আর বাকি ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে শিখনকালীন সময়ে। আর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা এই বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হবে শতভাগ শিখনকালীন সময়ে।
৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হবে ৬০ শতাংশ। আর বাকি ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে শিখনকালীন সময়ে। জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই বিষয়গুলোর হবে না পরীক্ষা অর্থাৎ শতভাগ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন।
৯ম ও ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হবে ৫০ শতাংশ। আর বাকি ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে শিখনকালীন সময়ে। জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই বিষয়গুলোর হবে না পরীক্ষা অর্থাৎ শতভাগ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন। দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
১১শ ও ১২শ শ্রেণির আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। নৈর্বাচনিক বা বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রায়োগিক বিষয়ে অর্থাৎ প্রাকটিক্যাল বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির উপর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি পরীক্ষা কমানোর সিদ্ধান্তটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। আমি একাধিকবার বলেছি অধিক পরীক্ষার ফলে আমাদের দেশে এখন পরীক্ষার্থী আছে শিক্ষার্থী নাই। আইনস্টাইন বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের জীবনে দুটোর বেশি পরীক্ষা থাকা উচিত নয়। পরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। পরীক্ষা কমানোর সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। এ ছাড়াও তিনি বিলম্বিত হলেও বোধোদয়ের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানান।