বন্ধ বিদ্যালয়, ধ্বংস প্রজন্ম
বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্বাবিদ্যালয় এক বছরের অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে, কবে স্কুল খুলবে তারও নেই কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা পরিকল্পনা। হ্যা, করোনার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই সাময়িক সময়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ ছিল; আবার মাঝে মাঝে একটি রেগুলার ইন্টারভ্যাল দিয়ে স্কুল সমূহ খোলা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশও নিয়মিত বিরতি দিয়ে করোনা কালীন সময়ে স্কুল পরিচালনা করেছে। যেমন নেপাল টিচার্স এসোসিয়েশন (NTA) প্রথমে Every Home a School চালু করলেও পরবর্তীতে সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করে স্কুল কার্যক্রম ঠিক ঠিকই পরিচালনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর চিত্র সমূর্ণ ভিন্ন। এখন শিক্ষার্থীরা ভুলতে বসেছে শেষ কবে তারা স্কুলে গিয়েছিলো, কে কোন ক্লাছে পড়ে সেটাও ভেবে বলতে হচ্ছে মা-বাবার, এমনকি ছাত্র ছাত্রীরই। এর মধ্যে দিয়ে পার হয় বেশ কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষার সময়। নানান গড়িমসির মধ্য দিয়ে অবশেষে এইচএসসি পরীক্ষার অটো ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে মোটেও শিক্ষার্থীদের মেধার প্রতিফলন ঘটেনি। আবার এসএসসি পরীক্ষার সময়তো অলরেডি গতই হয়ে গেছে, আর পরবর্তী এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও গত হয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় আসন্ন প্রায়, যেখানে গত বছরের লক্ষ শিক্ষার্থী এখনও জানে না তার পরবর্তী প্রতিষ্ঠান কোনটি! কিন্তু কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে নেই কোনো পরিকল্পনা, নেই কোন মাথা ব্যাথা। কেন তাদের মাথাব্যাথা থাকবে? তাদের ছেলে মেয়েরাতো আর দেশে পড়াশুনা করেন না। থাক সে কথা।
দেশবাসী অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে অবলোকন করছে যে, করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের সমস্ত জায়গা থেকে ঝাড়ুপেটা খেয়ে শুধু মাত্র স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে; যার কারণে সরকার কোনোভাবেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ খুলতে নারাজ। এই ভেবে যে, যদি দেশে সংক্রমণ আরো বেড়ে যায়। দেখুন না, এক মাত্র বিরল দেশ বাংলাদেশ, যেখানে করোনা বিরোধী মিছিল হয়, করোনা পজিটিভ ও করোনা নেগেটিভ প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হয়, করোনার মধ্যে বই মেলা ঠিক ঠিক হয়েছে, রজত জয়ন্তী পালনে নেই কোন কোনো ব্যত্যয়, মোদির সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতের হরতাল হয়, আবার সেই হরতাল ঠেকাতে পুলিশ, বিজিবি ও সরকার দলীয় কর্মীদের হরতাল বিরোধী মিছিল হয়, ন্যাশনাল ক্রিকেট লীগ অনুষ্ঠিত হয়, বিসিএস পরীক্ষাও হয়, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাও নাটকীয়তার সাথে সম্পন্ন হয়, ঈদের সময়ে মার্কেট, দোকান-পাট ঠিকই খোলা থাকে, গার্মেন্টস আর কলকারখানা চলছে আগের মতোই, লঞ্চ, ট্রেন ও বাসের গাদাগাদি চলছে চোখে পড়ার মতো; শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ করে রাখা হয়েছে তালাবন্ধ। সরকার কি অনির্দিষ্টকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে চিন্তা করছেন না? তাহলে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে না?
অনির্দিষ্ট কালীন বন্ধের জন্য নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর উপর। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের উপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রায় ১.৬ বিলিয়ন স্কুল শিক্ষার্থীরা খতিগ্রস্থ হয়েছে এই করোনা কালীন সময়ে। UNESCO ১৩টি ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছে। দীর্ঘদিন যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, কিভাবে একটি প্রজন্ম নিঃশেষ (Generation Lost) হতে পারে সেই দিক নিয়েই আজকের আলোচনা।
অনির্দিষ্ট কালীন বন্ধের জন্য পড়াশুনা বিঘ্নিত হওয়া খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া আর এর ফলাফল হল পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠদান করে থাকে সময়ের সাথে সাথে, আবার পাঠদানের সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরীক্ষার আয়োজন করে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন করে থাকে। এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন নিজেরদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারে, ঠিক তেমনি তাদের দুর্বলতাও চিহ্নিত করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে। অভিভাবকরা দেখতে পারে তাদের সন্তানদের অবস্থা। যখন স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে তখন ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নতুন শিক্ষাগ্রহন, মূল্যায়ন, সংস্কার ও বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও করোনা কালীন সময়ে সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে Hybrid ও digital teaching পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু ক্লাশ নেয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই অপ্রতুল। কেননা বাংলাদেশে আজও অনেক গরিব পরিবার রয়েছে যাদের বাসায় টিভি নেই, ইন্টারনেট তো অচেনা শব্দ তাদের কাছে। তাহলে সেই শিশুটি (ছাত্র-ছাত্রী)কি করে টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাশে অংশগ্রহন করবে? সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীরা যাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, সেই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অনির্দিষ্ট কালীন বিদ্যালয় বন্ধের কারণে, এমনকি তাদের পড়া লেখা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীদের কথা কখনো চিন্তা করে দেখেছেন কি? কখনো কি এই বিষয়টি টকশো ও অন্যান্য আলোচনায় ও লেখনীতে উঠে এসেছে?
বাংলাদেশ সম্প্রতিকালে মধ্যম আয়ের দেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যদিও বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। থাক সে কথা। বঙ্গবন্ধু sattelite এর মাধ্যমে দেশবাসীকে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে দেশের মানুষ এখনো পর্যন্ত তাদের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণের জণ্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা কি তাদের বাচ্চাদের হোম স্কুলিং ও ডিসটেন্স লার্নিংয়ের জন্য প্রস্তুত? অবশ্যই না। অন্যদিকে হোমস্কুলিং ও ডিসটেন্স লার্নিংয়ের জন্য যে পরিমান টেকনোলজি, লজিস্টিক সাপোর্ট, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ও আইপ্যাড ছাত্র ছাত্রীদের হাতে থাকা প্রয়োজন তা এখন পর্যন্ত তাদের অভিভাবকের কাছে অথবা সরকার বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দিতে পারে নি। অথচ আজ সরকারের কর্তা ব্যক্তিদেরকে বলতে শুনা যায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নাকি চায়না কে ছাড়িয়ে গেছে, আবার বাংলাদেশ এই প্রথম বারের মতো ভিনদেশীকে ঋণ দিতে চাচ্ছে। বিষয়টা তামাশা ছাড়া আর কি কিছু হতে পারে?
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে স্বল্প-স্বচ্ছল/ অসচ্ছল পরিবারগুলির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি ৫৮% শিক্ষার্থীর পড়াশোনার নিজস্ব কোন উপকরন নেই। ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদেরকে বিনামূল্যে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বিতরণ করছে, যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে। তার সাথে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা নামমাত্র মূল্যে ল্যাপটপ কিনতে পারছেন। তারপরও BBCর রিপোর্ট বলছে, ইংল্যান্ডের মতো দেশেই ৩৩% শিক্ষার্থীর কোন গ্যাঁজেট (শিক্ষা উপকরণ) নাই। ভাবুন তো বাংলাদেশের কি অবস্থা?
অনেকে আবার বলার চেষ্টা করবেন আরে ভাই বাংলাদেশ কি আর ইংল্যান্ড? বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা কি আর ইংল্যান্ডের মতো? অবশ্যই না। মালদ্বীপ একটি ছোট্র দ্বীপদেশ। সেখানে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না বা তারা মধ্যম আয়ের দেশও না। ড. আব্দুল্লাহ রশিদ (মালদ্বীপের ডেপুটি শিক্ষা মন্ত্রী) তার এক আলোচনায় কন্ফার্ম করেছেন যে, তাদের দেশের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর হাতে শিক্ষা উপকরণ পোঁছে দিয়েছেন এই করোনা কালীন সময়ে। অথচ আমার দেশের সরকার? আসুন ধাপগুলি ভাবি; ধরুন সরকার যদি চায় ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ তুলে দিবে, তাহলে দেখা যাবে শিক্ষা উপকরণ কেনার/দেখার জন্য ৪৮ সদস্যের (রূপক অর্থে) এক প্রতিনিধি দল যাবে ইউরোপের কোনো একটি দেশে কয়েক সপ্তাহের জন্য। আর এতে খরচ হবে ২০ কোটি টাকা (রূপক অর্থে),যেমনটি আমরা দেখেছি স্কুল মিল (খিচুড়ি রান্না) শিখতে গিয়েছিলো এক প্রতিনিধি দল। তারা ফিরে আসবেন, যাচাই বাছাই হবে, টেন্ডার বরাদ্দ হবে, কিছু পকেট ফুলে ফেঁপে উঠবে আর হয়ত কিছু শিক্ষার্থীরা ভাগ্য খুব ভালো হলে সামান্য কিছু শিক্ষা উপকরণ পাবেন। কেমন হবে সেই শিক্ষা উপকরণ বিতরনের দৃশ্যটি?
হোম স্কুলিং এর জন্য ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের অভাবে আমার দেশের শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে ঠিক তেমনি উপকরণের ব্যবস্থা করতে না পেরে অভিভাবকেরাও পড়ছেন চরম বিপদে, তাদের মধ্যেও হতাশা কাজ করছে, বিরাজ করছে টেনশন। পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও টেনশন বিরাজ করছে। যখন অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অজানা সময়কালের জন্য স্কুল কলেজগুলি বন্ধ হয়, তারাও জানেননা কিভাবে তারা ডিজিটাল পদ্দ্বতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন, এই অনিশ্চয়তা আরো হতাশা বাড়িয়ে তোলে। আর শিক্ষার্থীরা হতাশ, মুলত যারা শিক্ষা উপকরণ পাচ্ছেন না। পাশাপাশি উঁচুতলার যারা সুবিধা পেয়েছেন অনলাইনে শিক্ষা গ্রহনের, সেই ডিভাইস গুলো শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও এই গ্যাঁজেটই আবার নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের কর্মদক্ষতা এবং মনোযোগীতার সক্ষমতা। নেশার মতো নানা অনলাইন গেম এ আসক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ইউকের শিক্ষা মাননিয়ন্ত্রণ সংস্থা (OFSTED) প্রধান আমান্ডা স্পায়েলম্যান বলেছেন ইউকে সরকারের সার্বিক সহযোগিতার পরেও শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ পড়াশুনায় উন্নতি করতে পারছে না। যারা সুবিধা বঞ্চিত ও সুবিধা প্রাপ্ত তাদের মধ্যে এক অসম ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। ভাবুনতো তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা কি হতে পারে?
লকডাউনের সময় প্রতিটি শিশু কতটা শিখছে তা অনুমান করা শক্ত। যে সমস্ত পরিবাবের পিতামাতা তেমন শিক্ষিত নন, তাঁদের পক্ষে হোম স্কুলিং মনিটর করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের চেয়ে ধনী পরিবারের শিশুরা হোম হোম স্কুলিংর ক্ষেত্রে প্রায় ৩০% শতাংশ বেশি সময় ব্যয় করে, বা সুবিধা ভোগ করে। স্কুল বন্ধের কারনে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমে বৈষম্য বেড়েছে ইংল্যান্ডের মতো দেশে, যেখানে বাংলাদেশের এখনও ৬০% অধিক লোক অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত। তাদের পক্ষে তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রম মনিটর করা সম্ভব নয়। ফলে, ছাত্র-ছাত্রিরা তাদের পিতা মাতাকে ভুল বুঝিয়ে অধিক মাত্রায় স্ক্রীন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পিতামাতার সাথে সন্তানের দূরত্ব বাড়ছে। স্কুল খোলা ছাড়া সমাধানের পথ আছে কি?
অর্থনৈতিক ব্যায় যেমন বাড়ছে তেমন বাড়ছে চাকরি ছাঁটাই প্রবণতা। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে জব কাট (চাকরি ছাঁটাই) হয়েছে প্রচুর দেশে বিদেশে সব জায়গাতেই। অনির্দিষ্টকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা গৃহবন্দী, তাদেরকে পাঠে মনোনিবেশ করানোর জন্য পিত-মাতাকে অত্যন্ত বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যস্ত রাখতে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের, তাদেরকে রাখতে হয় চোখে চোখে, করতে হয় সার্বক্ষণিক মনিটর। একদিকে এতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে চাকরিজীবী অনেক মাকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়েছে। সাধারণত চাকরিজীবী মায়েরা চাকরিতে যাওয়ার সময়ে তাদের সন্তাদেরকে স্কুলে ড্রপ করে নিজ কর্মস্হলে চলে যেতেন, এখন যেহেতু স্কুল বন্ধ আর বাচ্চারা বাসায়, তাই তাদেরকে একা বাসায় রেখেও চাকরিতে যাওয়া যাচ্ছেনা, সুতরাং বাধ্য হয়েই মায়েদেরকে চাকরি ছেড়ে দিতে হচ্ছে, ফলে পরিবার পড়ছে আর্থিক চাপের মধ্যে। যেসব শ্রমজীবী বাবা-মা কাজকর্ম বা চাকরি ছাড়তে পারছেন না, তাদের সন্তানাদি বাসায় থাকার কারণে সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য লোক রাখতে হচ্ছে, অতিরিক্ত পয়সা গুনতে হচ্ছে, সীমিত আয়ের পিতা-মাতারা পারিবারিক অধিক ব্যায় বহন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। গবেষণা বলছে পারিবারিক উত্তেজনা এবং আন্তঃপি তা-মাতা দ্বন্দ্ব বাড়ছে দিনের পর দিন। আর দারিদ্রতার কারণ পিতা মাতা যখন পরিবারের উচ্চ অর্থনৈতিক ব্যায় মেটাতে পারছেনা, তখন শিশুরাও শিশুশ্রমে ঢুকে পড়ছে, বাড়ছে শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন। শিশুশ্রম শুরু করা বহু শিক্ষার্থীর আর কখনই স্কুলে ফেরা হবে কি?
আবার শিশুরা গৃহবন্দী থাকার কারণে, স্কুলে না যাওয়ার কারণে, খেলার সাথী ও খেলা-ধুলা বঞ্চিত হওয়ার কারণে, স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিশতে না পাড়ার কারণে, তাদের মধ্যে নেতিবাচক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে, হয়ে পড়ছে ডিপ্রেসেড ও মনমরা, বাড়ছে মানসিক সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে বন্ধুদের সাথে সামাজিক যোগাযোগের নিষেধাজ্ঞার কারণে ও অনির্দিষ্টকালীন স্কুল বন্ধের কারনে অল্পবয়সী কোমলমতি শিশুরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা, যা ইতিমধ্যে পরিবারগুলতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। নর্থ আফ্রিকান কমিউনিটি সংগঠন মুসানা (MUSANA) যেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছে; তার মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর সামাজিক ও নৈতিক সমস্যার নানারকম দিক। অনৈতিকতা আর অসামাজিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; শিক্ষার্থীরা সামাজিকতা, ছাড় দেয়া, উদারতা, অন্যকে সম্মান করা, ভাগাভাগী আর মিলেমিশে থাকা কি জিনিস ভুলতে বসেছে। তারই সাথে বাল্য বিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের মধ্যে অবৈধ যৌন মেলামেশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। (MUSANA) যেই সমস্যাগুলোর কথা বলেছে তার বাস্তব চিত্র যেন বাংলাদেশ। এইতো গত কয়েক মাস আগে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের আনুশকাকে প্রাণ দিতে হয়েছে তারই বয়ফ্রেন্ড দিহানের দ্বারা বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে। মেয়েশিশু ও যুবতী নারীদের যৌন শোষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিশোরীর গর্ভধারণ ও গর্ভপাতও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়েছে মাদক গ্রহনের ভয়াবহ নেশাতুর প্রবনতা, হিংস্রতা, শিশুশ্রম ও স্কুল ড্রপআউট। এখনও কি আমরা ভেবে দেখব না?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো হলো সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এবং শিক্ষার্থীদের মিথস্ক্রিয়ার কেন্দ্রস্থল।বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং ইলেট্রনিক ডিভাইসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘকালীন। ইটালির এক সায়েন্স জার্নালে বলা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রিরা দীর্ঘ সময়ে ঘরে বন্দী থাকার কারনে তাঁদের মধ্যে স্ক্রীন টাইম যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি তাঁদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর ও অধিক খাবার গ্রহনের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে, যা তাদেরকে স্বাস্থ্য ঝুকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি স্প্যানিশ গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাড়ির কারাবন্দি জীবনের একদিকে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে স্ক্রিন সময় বাড়ছে এবং ঘুমের বিঘ্ন ঘটছে এবং নানা শারীরিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ওবেসিটি কি বাংলাদেশের অন্যতম শহুরে সমস্যা হিসেবে বাড়ছে না?
স্কুল বন্ধ থাকায় শুধুমাত্র একাডেমিক শিক্ষার ক্ষতিই সাধিত হচ্ছে, তা নয়, এর সাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, আচরণের ভারসাম্যহীনতা, আর্থ-সামাজিক-সংবেদনশীল জটিলতা, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ হ্রাস ইত্যাদি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকাবস্থায় শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হতো (যেমন নিয়ম করে ঘুমোতে যাওয়া ও উঠা, সময়মত নাস্তা, লাঞ্চ ও ডিনার করা, শারীরিক কসরৎ বা ব্যায়াম করা) যা কিনা একটি শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক গঠনে সহায়ক ভুমিকা রাখে। অনির্দিষ্টকালীন স্কুল বন্ধ থাকা শিক্ষার্থীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দুটো চাইনিজ গবেষণায় দেখা গেছে অনির্দিষ্টকালীন স্কুল বন্ধ থাকার কারনে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের মাত্রা বেড়েছে ব্যাপক হারে। উত্তর আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বন্ধুদের সাথে ডিজিটাল সময় কাটানোর সাথে উদ্বেগ, স্ট্রেস বেড়েছে হাজারগুণে। কিশোর বয়সীদের মধ্যে আরও নিঃসঙ্গতা এবং হতাশার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে এই ডিজিটাল সামাজিকতা। দীর্ঘকালীন স্কুল বন্ধের কারনে বেড়েছে আত্মহত্যার হার। SAGE জার্নালে ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ১০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার মাত্রা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েছে। এইতো কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্র স্ট্রেসের কারনে মাদকাসক্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের গত কয়েক মাসের পত্রিকাতে চোখ বুলালে এর ব্যতিক্রম চিত্র চোখে পরে কি?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার জন্য ক্রমান্বয়ে যদিও দাবী জোরদার হয়ে উঠছে, জনরোষ বাড়ছে, মানব বন্ধন হচ্ছে, কোথাও কোথাও জোর করে আবাসিক হল সমূহে অবস্থানের নজির দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সরকার এতে কোনো কর্ণপাতই করছে না। এতে করে সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনেও নেতিবাচক ধারণা কি তৈরী হচ্ছে না? তাইতো অভিভাবকেরা চাচ্ছেন দ্রুত এই অবস্থার অবসান। চাচ্ছেন স্কুল, কলেজ, বিশ্বাবিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন দ্রুত খুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশে যেখানে সব কিছুই খুলে দেয়া হয়েছে, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে; আর সে ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী, টকশোজীবি, চেতনাবাজ ও তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের মধ্যে নেই কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। মাঝখান থেকে কি বলির পাঠা হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা?
এই নেতিবাচক প্রভাবগুলি কেবলমাত্র যে দীর্ঘমেয়াদি তাই নয় বরং এর ক্ষতি অপরিমাপযোগ্য। ইউকের সাবেক Education Secretary (২০১৬-২০১৮) বলেছেন এই প্রজন্ম সত্যি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভোগান্তিতে পড়বে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের, জাতির ও দেশ গড়ার কারিগর, দেশ ও জাতির কল্যাণে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হউক।
লেখকঃ ব্যারিস্টার ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস