বাংলাদেশঃ ‘একটু চিকিৎসা সেবা এই রাষ্ট্র আমার বাবাকে দিতে পারেনি’
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হিসেবে ঢাকার পরের অবস্থানেই রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরী। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত প্রায় ৫,০০০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন শতাধিক।
গত দুই সপ্তাহ ধরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই দুই শতাধিক ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ রোগীদের জন্য যে পরিমাণ চিকিৎসা সেবা থাকা প্রয়োজন সেটা নেই বলে অভিযোগ উঠেছে।
করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী বা ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের একে তো হাসপাতালে ভর্তি হতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কোনভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও, পাচ্ছেন না জরুরি সেবা।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দা জোবায়ের চৌধুরী তার ৬২-বছর বয়সী বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন। এক পর্যায়ে চিকিৎসা ছাড়াই তার বাবা ধুকে ধুকে মারা যান।
মি. চৌধুরীর বাবা গত কয়েকদিন ধরে তীব্র ঘাড়ে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।
পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে গত বুধবার তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আগে থেকে ফোন করে গেলেও হাসপাতালে গিয়ে মি. চৌধুরী দেখতে পান জরুরি বিভাগে কোন চিকিৎসক নেই।
রোগীকে জরুরি বিভাগ পর্যন্ত নিয়ে যেতে কোন স্ট্রেচার পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
পরে অনেক অনুরোধের পর একজন ওয়ার্ড বয় হাসপাতালের চিকিৎসককে ফোন করে রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করেন।
রোগীকে সিএনজি অটোরিকশার ভেতরে রেখেই এই পরীক্ষা করা হয়।
মি. চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বাবার অক্সিজেন স্বাভাবিকের চাইতে কম ছিল। আমি কতো অনুরোধ করলাম এখানে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে, তারা কোনভাবেই ভর্তি নিল না। অথচ আমি ফোন করে কনফার্ম হয়ে এসেছিলাম যে তারা রোগী ভর্তি রাখতে পারবে।”
এরপর তিনি দ্রুত তার বাবাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। ততোক্ষণে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
সেখানে জরুরি বিভাগে গিয়েও কোন চিকিৎসক পাননি মি. চৌধুরী। পরে দু জন স্বাস্থ্যকর্মী তার বাবার ইসিজি পরীক্ষা করে জানান তিনি মারা গেছেন।
“ওই রাতে, আমার বাবার একটা কঠিন মুহূর্তে আমি একজন চিকিৎসকের দেখা পাইনি, একটু চিকিৎসা সেবা এই রাষ্ট্র আমার বাবাকে দিতে পারেনি।” আক্ষেপের স্বরে জানান মি. চৌধুরী।
চট্টগ্রামে প্রতিদিন যে হারে রোগী আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সবার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার শয্যার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে জানান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী।
কারণ একজন রোগী ভর্তি হলে তাকে অন্তত ১৪ দিন ধরে সেবা দিতে হয়। যা এই সীমিত সংখ্যক শয্যায় ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।
সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে অক্সিজেনের। যেসব সরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া কোনটিতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই।
অথচ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না নিলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এএনএম মিনহাজুর রহমান।
এক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন সাধারণ শয্যা, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সেবা সরবরাহ এবং আইসিইউ সেবা বাড়ানোর ওপর।
বর্তমানে ৫৫০ জন রোগীকে ভর্তি রাখার মতো ব্যবস্থা রয়েছে। আইসিইউ আছে ৩৪টি।
কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজনে আসা রোগীর সংখ্যা এর চাইতে কয়েকগুণ বেশি বলে তিনি জানান।
এছাড়া শ্বাসকষ্ট নিয়ে যেসব রোগীরা আসছেন তাদের জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন দিতে হয়। কিন্তু সেই সক্ষমতা না থাকায় অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আটটি ভেন্টিলেটরসহ ১০টি আইসিইউ শয্যা পড়ে থাকলেও শুধুমাত্র অক্সিজেন সরবরাহের অভাবে সেগুলো চালু করা যাচ্ছে না।
প্রায় ১৫ দিন আগে এ সংক্রান্ত কার্যাদেশ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোন কাজ শুরু হয়নি বলে অভিযোগ করেন মি. রহমান।
এমন অবস্থায় তিনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করার বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করলেও এখনও কোন বেসরকারি হাসপাতালে একজন কোভিড ১৯এ আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়নি।
এমনকি বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ আইসিইউ সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।
এমন আরও নানা অনিয়ম ও প্রস্তুতির অভাবের অভিযোগ উঠলেও চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ফজলে রাব্বির দাবি সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছে।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে মেডিকেল কর্মীদের বড় ধরণের সংকট রয়েছে।
তার মতে, ঢাকায় যে পরিমাণ ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মী রয়েছেন চট্টগ্রামে সে পরিমাণে দক্ষ জনবল নেই বলে উল্লেখ করেন।
মি. রহমান বলেন, “একটা আইসিইউ খুলে ফেললেই হল না, এটা চালানোর মতো জনবল তো নেই। চট্টগ্রামে যারা আছেন তাদেরকেও কয়েকটা হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এজন্য তাদের সবাইকে প্রয়োজনে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এই চিকিৎসকদের ১০ দিন কাজ করার পর ১৪দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। এই রোস্টার সিস্টেমের কারণে এক ধরণের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।”
সংকট মোকাবিলায় এরিমধ্যে যেসব বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০টির বেশি সেইসব হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোর অর্ধেক শয্যায় যেন করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া যায় সেটা নিশ্চিত করতে আলোচনা চলছে বলে জানান মি. রাব্বি।
এ বিষয়ে প্রশাসন নজরদারি করছে বলেও তিনি জানান।
আইসিইউ সেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মানুষ মনে করে, করোনাভাইরাস হলেই আইসিইউ লাগবে। কিন্তু আসলে ৮০% রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিলেই সুস্থ হয়ে যান। যাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাদেরকে অক্সিজেন সেবা দেয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা সেই অক্সিজেন সেবা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।”
এদিকে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যক্তিগতভাবে যে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ করা শুরু করেছেন সেটার কারণে হাসপাতালগুলো প্রয়োজনে অক্সিজেন পাচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
সৌজন্যেঃ বিবিসি বাংলা