বাংলাদেশি বাবা বনাম জাপানি মা: কোন মেয়ে কার কাছে থাকবে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রায় তিন বছর পর অবশেষে বাংলাদেশের হাইকোর্টের আদেশে জাপানি নাগরিক মা নাকানো এরিকো তার তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ও ছোট মেয়ের জিম্মা পেয়েছেন।
রায় অনুযায়ী, বাবা ইমরান শরীফের কাছে থাকবে মেজো মেয়ে।
মঙ্গলবার দেয়া রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, বাবা–মা উভয়েই সন্তানদের সাথে দেখা করার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ পাবেন। বাবা ইমরান শরীফ বড় ও ছোট মেয়ের সাথে যাতে দেখা করতে পারেন সে বিষয়ে মায়ের আইনজীবীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নাকানো এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রায়ের ফলে বড় মেয়েকে জাপানে নিয়ে যেতে বাধা নেই। কারণ রায়ে এ বিষয়ে কোনো রেস্ট্রিকশন দেয়া হয়নি”।
একইসাথে মেজো মেয়ের জিম্মা চেয়ে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন মি. মনির।
বাবা ইমরান শরীফের আইনজীবী নাসিমা আক্তার জানিয়েছেন, “মেয়েদের দেখাশোনা কীভাবে করা হবে তা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, বড় মেয়েকে মা নাকানো এরিকোর জিম্মায় দেয়ার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে”।
তবে, মা এরিকো বড় মেয়েকে জাপানে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা তা পূর্ণাঙ্গ রায় না পেলে বোঝা যাবে না বলে মনে করছেন বাবা ইমরান শরীফের আইনজীবী মিজ আক্তার।
উভয়পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার আদালত শুধু রায়টুকু ঘোষণা করেছেন। কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি।
ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মেয়েদের দেখাশোনা কে কখন কীভাবে করবে এবং দেশের বাইরে তাদের নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা এ বিষয়টি পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝা যাবে বলে জানিয়েছেন তারা।
ঘটনার পূর্বাপর
পেশায় চিকিৎসক জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো ২০২১ সালের অগাস্টে বাংলাদেশে এসে দুই কন্যা সন্তানকে নিজের জিম্মায় পেতে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।
কারণ তাদের বাবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফ মায়ের সম্মতি ব্যতীত ১০ ও ১১ বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। এই অভিযোগে হাইকোর্টে রিটটি করেছিলেন নাকানো এরিকো।
সে সময় জানা যায়, প্রকৌশলী ইমরান শরীফের সাথে চিকিৎসক নাকানোর বিয়ে হয়েছিলো ২০০৮ সালে। পারিবারিক সংকটের জেরে এরিকো ২০২০ সালে ডিভোর্সের আবেদন করেছিলেন।
সে সময় এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে ব্যাপক আলোচনা।
এই রিটে অভিযোগ করা হয়েছিলো, টোকিওতে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় তাদের বাবা তিন মেয়ের মধ্যে বড় দুই মেয়েকে মায়ের অগোচরে অন্য কোথাও নিয়ে যান।
এছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে মেয়েদের পাসপোর্ট করিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে চলে আসে বলে অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশের হাইকোর্টে করা রিটটিতে।
এই রিটের পর মায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই মেয়েকে উদ্ধার করে। পরে সে সময় হাইকোর্ট শিশু দুটিকে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ঢাকার তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার নির্দেশও দিয়েছিলো।
বিভিন্ন সময়ে মা নাকানো মেয়েদের নিয়ে জাপান ফিরে যেতে আবেদন করলে বাংলাদেশের আদালত তা খারিজ করে দেয়।
রিটটির কয়েক মাসের শুনানির পর তখন হাইকোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে দিলেও মা যাতে সন্তানদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন সেটি নিশ্চিত করার আদেশ দেন।
সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন মা নাকানো এরিকো।
আপিল বিভাগ দুই শিশুকে তাদের মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও তাদের বাবা তা প্রতিপালন না করায় আদালত দুই শিশুকে তাদের বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সাথে কথা বলেন।
এরপর দুই শিশুকে মায়ের হেফাজতে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়।
ওই আদেশে আপিল বিভাগ বলেছিলো যে, দুই সন্তান কার হেফাজতে থাকবে সেটির নিষ্পত্তি হবে পারিবারিক আদালতে এবং সে পর্যন্ত তারা তাদের মায়ের কাছেই থাকবে।
এরপর আপিল বিভাগ পারিবারিক আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেয়।
গত বছরের ২৯ শে জানুয়ারি ইমরান শরীফের করা মামলা খারিজ করে দিয়ে দুই শিশুকে মা নাকানো এরিকোর জিম্মায় রাখার সিদ্ধান্ত দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান।
পারিবারিক আদালত নাবালিকা দুই শিশু কার কাছে থাকলে ভালো হবে সেটি বিবেচনা করে ওই রায় দেয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “জাপানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর প্রাথমিক শুশ্রূষাকারী তাদের মা নাকানো এরিকো। অথচ তাকে কিছু না জানিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসাটা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার সামিল”।
“বাবা হিসাবে ইমরান শরীফ নাবালিকা দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা করার হকদার। তবে জাপানি মায়ের কাছে দুই নাবালিকার হেফাজত তাদের শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অর্থাৎ সার্বিকভাবে মঙ্গলজনক হবে বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।”
পরে পারিবারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আবার ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল করেন ইমরান শরীফ। গত বছরের ১৬ই জুলাই আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তিনি হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন।
প্রায় তিন বছর পর অবশেষে বাংলাদেশি বাবা ও জাপানি মায়ের তিন সন্তানের অভিভাবকত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায় এলো। তবে, দুইপক্ষই আবার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা কথা জানিয়েছেন।