বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা

Spread the love

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ও সফল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১ সালে নিবন্ধিত প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও উৎসবমুখর জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সাল ও ২০০১ সালে সর্বশেষ অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন সম্পন্ন নয়। দল, মত নির্বিশেষে দেশের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের কাঙ্খিত ও পছন্দনীয় সরকার গঠন করে। এই তিনটি নির্বাচনের কারিগর ছিলো তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই নির্বাচন সমূহ ছিলো স্বচ্ছ, অংশগ্রহণ মূলক এবং সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য।

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু হয় মূলত সেনা সেনাসমর্থিত মঈনুদ্দিন ও ফখরুদ্দিন সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় আওয়ামীলীগকে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসানোর মধ্য দিয়ে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করার জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কাঁধে বন্দুক রেখে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কবর দেয়। খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে একটি রায় প্রদান করে। ঠিক দশ মাস পরেই ৩০শে জুন সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর পরই শুরু হয় একতরফা নির্বাচন, ভোটার বিহীন নির্বাচন, একক নির্বাচন, এক দলীয় নির্বাচন, বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন, গৃহপালিত বিরোধী দলের নির্বাচন, রাতের নির্বাচন, তাহাজুদ্দের নির্বাচন ও ডামী নির্বাচনের তামাশা।

দেশের সিনিয়র সিটিজেন যেমন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সিনিয়র আইনজীবী ড. এম জহির, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক উল হক, সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. আকবর আলি খান, সুলতানা কামাল, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ও সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম মূসা এনারা সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত দিলেও তারা সকলেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার পক্ষে মত দেন, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণ মূলক ও গহনযোগ্য নির্বাচনের তাগাদা দেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ অনুসারে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব হল অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা। কমিশন রাষ্ট্রপতি ও সংসদে নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ, আইন কর্তৃক নির্ধারিত অন্যান্য নির্বাচন পরিচালনা (এর মধ্যে সকল স্থানীয় সরকার পরিষদ যেমনঃ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ অর্ন্তভুক্ত) এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকবে, তারা থাকবে সরকারের প্রভাবমুক্ত। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন কি আদৌ সরকারের প্রভাব মুক্ত ছিলো?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির পর ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিন তিনটি নির্বাচন কমিশন যেমন রকিব উদ্দিন কমিশন, হুদা কমিশন ও আউয়াল কমিশন দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও তারা সকলেই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন করতে পারেনি।তারা পারেনি সরকারের প্রভাব মুক্ত থাকতে।তারা তাদের শপথ ভুলে গিয়ে আওয়ামীলীগকে চিরকালের জন্য ক্ষমতায় রাখার জন্য নির্বাচন নামক নাটকের মঞ্চায়ন করেছিল।

২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের প্রতি মানুষের ছিলো বিতশ্রদ্ধা। এই কমিশন মানুষকে আশ্বস্থ করতে পারেনি যে তারা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে, তারা স্বাধীনভাবে ভোটের ব্যবস্থা করতে পারবে।নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তারা তৈরী করতে পারে নি, তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের কথা মতো নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। এর ফলে মানুষ ভোট কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।তাদের কারণে মানুষ তার ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়, অনেকের বয়স ৩৫ হলেও এখনো পর্যন্ত তারা ভোট দিতে পারেনি।একটি জাতীয় নির্বাচনে মাত্র ৫-৭% ভোট প্রদান রেকর্ড হয় যদিও তারা তা মানতে নারাজ ছিলো। তাদের মিথ্যা ক্লেইম প্রায় ৩৩% ভোট পড়েছে। এমনকি নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রের মধ্যে মানুষের পরিবর্তে কুকুরের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। ভোটে মারাত্মক কারচুপি, একজনই শত শত ভোট দিয়েছে, একজনই পুরো এক ব্যালট বই সিল মেরেছে। আনসার, পুলিশ,ও প্রিসাইডিং অফিসারের সামনেই আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা যে যার মতো করে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রথা, সিস্টেম, ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। জাতি ঘৃণাভরে দেখেছে একতরফা নির্বাচন, তামাশার নির্বাচন যেখানে বিনাভোটে ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলো, অর্থাৎ নির্বাচন না করেই আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছিলো।

সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কমিশন তাদের দায়িত্বকে আমানত হিসেবে গ্রহণ করে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পথকে সুগম করে দিবে, এটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশনের কাছে। কিন্তু রকিব উদ্দিন কমিশন, হুদা কমিশন ও আউয়াল কমিশন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধীদল বিহীন নির্বাচন, রাতের নির্বাচন ও ডামী ও প্রহসনের নির্বাচন উপহার দিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে, নির্বাচনকে হাসিরপাত্র বানানোর ক্ষেত্রে তারা তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার দায়ভার এড়াতে পারবে না। তারা সংবিধান লংঘন করেছে।প্রচলিত আইনে তাদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় দাড় করানো, এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার।

যেকোনো দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য স্বাধীন, সুষ্ঠ, ও সকল দলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য একটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও মেরুদন্ড ওয়ালা নির্বাচন কমিশ খুবই দরকার। আমরা কথায় কথায় শুধু পাকিস্তানের বিরোধিতা করি, অথচ সে দেশের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে সক্ষম।তাদের নির্বাচন কমিশনের উপর ক্ষমতাসীন দলের কোন প্রভাব চলে না, বিভিন্ন সময়ে আমরা তাদের উদাহরণ দেখেছি। ছোট দেশ নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এমনকি শ্রীলংকার মতো দেশেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে জাতীয় নির্বাচন করতে সক্ষম।আর ভারতের নির্বাচন কমিশনতো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাকে যেন তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মনে করে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন হলেও এখনও যেমন পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারেনি ঠিক তেমনি দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য গুরুত্তপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সমূহ যেমন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসনও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম।
নির্বাচন কমিশন যতদিন পর্যন্ত কোনো একটি দলের বা ক্ষমতাসীন দলের ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করবে বা নির্বাচন পরিচালনা করবে, ততদিন পর্যন্ত দেশের মানুষ সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে না। তাই, দরকার নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। আমরা আশাবাদী যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের কাজেও মনোনিবেশ করবে।

লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব, সলিসিটর সিনিয়র কোর্ট অফ ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস।
৩০/০৯/২০২৪, লন্ডন।


Spread the love

Leave a Reply