ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে পারে বাংলাদেশ,হঠাৎ করে সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম গণবসতিপূর্ন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যায় হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল একদিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ জন, যা এখন পর্যন্ত একদিনে আক্রান্ত হওয়া সংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ সরকারের পর্যাপ্ত পরিমান পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সঠিক সংখ্যা নির্নয় করা সম্ভব হবেনা। কার্যত দেশের হাজার হাজার মানুষের শরীরে করোনভাইরাসের উপসর্গ থাকতে পারে। তাই হলে খুব অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে পারে।
যদিও সরকার বলছে তাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে । পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের সেনাবাহিনী মাঠে নামানো হয়েছে । কিন্তু তাতেও জনসাধারনকে শৃংখুলবদ্ধ করতে দেশটি ব্যার্থ হয়েছে । দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে এক ভয়াবহ অবস্থা । চাকুরী হারানোর ভয়ে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মস্থলে যোগদান করেছেন । এই জন্য বাংলাদেশকে একটা ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে পারে। কোন কিছু ঘটার আগেই জনসাধারনের মধ্যে সারা দেশে একতা বিশৃংখুল অবস্থা বিরাজ করছে।
সরকারের তথ্য মতে গত কয়েকদিন ধরে পরীক্ষা সংখ্যা বাড়ানোর পর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
গত ২৪ ঘন্টায় নুতন একজন মারাও গেছেন। এনিয়ে কোভিড-১৯এ মোট ৯ জন মারা গেলেন বাংলাদেশে।
মৃত এই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের। তিনি ৫৫ বছর বয়সী একজন পুরুষ।
এছাড়া গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৩ জন সুস্থ হয়েছেন বলেও জানানো হয়। এনিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হলেন ৩৩ জন।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৬ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে।
এই ৪৬ জনের মধ্যে ৩২ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং বাকি ১৪ জন বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আইইডিসিআরের পরিচালক জানান, বর্তমানে দেশের ১৪টি কেন্দ্রে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় মোট ৩৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
৮ই মার্চ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার কথা জানায়।
এখন পর্যন্ত ২৮ দিনে নিশ্চিত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৮ জন।
১৮ই মার্চ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে প্রথম ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
২৫শে মার্চ প্রথমবারের মত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বিভাগ জানায় যে বাংলাদেশে সীমিত আকারে কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে।
রবিবার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান নতুন করে আক্রান্ত ১৮ জনই আগে থেকে আক্রান্ত কোনো না কোনো ক্লাস্টার থেকে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৮ জনের মধ্যে ১২ জনই ঢাকার বাসিন্দা।
এখন আইইডিসিআর বলছে, অন্ততঃ পাঁচটি ক্লাস্টারে এই কম্যুনিটি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
এগুলো হচ্ছে মাদারীপুরের শিবচর, গাইবান্ধা, নারায়নগঞ্জ, ঢাকার বাসাবো, টোলারবাগ।
এসব এলাকায় আগে থেকে বিদ্যমান লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরো জোরদার করা হয়েছে।
ঢাকার মধ্যে বাসাবোতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯ জন রোগী পাওয়া গেছে।
টোলারবাগে পাওয়া গেছে ৬ জন রোগী।
আর বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় পাওয়া গেছে ৫ জন রোগী।
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, জনসমাগম এড়িয়ে না চললে এই কম্যুনিটি সংক্রমণ বৃহত্তর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এদিকে বাংলাদেশে সরকার নির্দেশিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হলেও, তৈরি পোশাক কারখানা খোলার নির্ধারিত তারিখ ছিল আজ পাঁচই এপ্রিল।
ফলে সারাদেশে ‘কার্যত লক-ডাউন’ পরিস্থিতির কারণে গণ-পরিবহন বন্ধ থাকার পরেও শনিবার হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক কর্মস্থলে ফিরেছেন।
কিন্তু শনিবার রাতে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে শ্রমিকদের বড় অংশই এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনেছেন আজ কারখানায় গিয়ে। ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে এ নিয়ে দেখা গেছে তীব্র হতাশা।
‘তিন ঘণ্টার রাস্তা আসছি দুইদিনে’
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের সাথি সরকার গাজীপুরের একটি রপ্তানি-মুখী পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
সরকারের দেয়া ১০ দিনের সাধারণ ছুটিতে পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।
তবে এরই মধ্যে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়লেও, যেহেতু শনিবার পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি, সে কারণে ধারদেনা করে শনিবার দুপুরে কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন সাথি।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন কত হেনস্থার শিকার হয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন তিনি।
“বাড়ি থেকে হাইটা আসছি অনেক রাস্তা, তারপর পিকআপে আসছি কয়েক কিলো রাস্তা। তারপর হুন্ডায় (মোটরসাইকেল) আইছি ময়মনসিংহ পর্যন্ত। সেইখানে রাইতে থাইকা সকালে কিছুদূর অটো-রিকসা ও সিএনজি, এবং পরে আবার পিকআপে চইড়া আসছি আমরা।”
“তিন ঘণ্টার রাস্তা, দুইদিন ধইরা আসছি। খরচ হইছে একেকজনের জন্যে চার হাজার টাকার মত। এত কষ্ট কইরা আসছি কারণ খোলার দিন না থাকলে যদি চাকরি না থাকে! আবার এখন তো বেতনের টাইম, যদি বেতন না দেয়, সেই ভয়ে।”
এত কষ্ট করে কর্মস্থলে পৌঁছে শনিবার রাত পর্যন্তও কিছু জানতে পারেননি তিনি।
রোববার সকালে কারখানায় গিয়ে জানতে পারেন আগামী ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে।
সাথির মতই কারখানার প্রধান ফটকে টাঙ্গানো নোটিস দেখেই ছুটি বাড়ার বিষয়ে জানতে পেরেছেন টঙ্গীর পোশাককর্মী চুমকি সুলতানা।
এখন কবে কারখানা খুলবে আর কবে বেতন পাবেন তা নিয়ে রীতিমত দুর্ভাবনায় পড়েছেন চুমকি
“গেটে নোটিস লেইখা দিছে যে বন্ধ, কিন্তু বেতন কবে দিবে সেই বিষয়ে কিছু বলে নাই। ফ্যাক্টরির গেটে বড় সাহেবরাও (কর্মকর্তা) ছিলেন, তারাও কিছু স্পষ্ট করলেন না। এখন খামু কী, চলমু কেমনে, সেই চিন্তায় আছি।”
“বাড়িওয়ালারা এখনও কিছু বলতাসে না, কিন্তু দোকানদাররা দশ টাকার জিনিসও বাকি দিতে চাইতাসে না। হেরা মনে করতাসে বেতন পাইনা, বাকি নিয়া পালাইয়া যামু, তাই বাকি দিতাছে না।”
কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে কেন দেরি?
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে।
এর মধ্যে বাস-ট্রেন-লঞ্চসহ সব ধরণের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ এবং সংবাদপত্র ছাড়া সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরণের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
পোশাক মালিকেরা বলছেন, যেহেতু কারখানা বন্ধ করার জন্য সরকারের নির্দেশ ছিল না, সেজন্যই অনেক কারখানা খোলা রাখা হয়েছিল।
এমনকি যথাসময়ে অর্থাৎ প্রথম দফায় ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ শেষে রোববার কারখানা খোলা রাখার ভাবনাই ছিল মালিকদের।
কিন্তু একদিকে গণপরিবহন বন্ধের কারণে কর্মস্থলে ফিরতে শ্রমিকদের ভোগান্তি এবং অন্যদিকে সামাজিক দূরত্বের নিয়ম না মেনে হাজার হাজার কর্মী দলবেঁধে ফেরত আসায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ার আশংকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শনিবার সন্ধ্যার পরে কারখানা বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিজিএমইএ।
বিজিএমইএর একজন সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল দিপু বলেছেন, সরকারের নির্দেশনার বাইরে কিছু করেননি তারা।
“কিছু কারখানা খোলা ছিল, এদের মধ্যে কেউ পিপিই এবং মাস্কের মত পণ্য বানাচ্ছিল। এর বাইরে কিছু কারখানায় যেমন কোন অর্ডারের ৮৫ শতাংশ বা ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে, দুয়েকদিন কাজ করলেই শেষ হবে অর্ডারের কাজ সেসব কারখানা সীমিত পরিসরে খোলা ছিল।”
তিনি বলছেন, বিজিএমইএর এখতিয়ার নেই কারখানা বন্ধ করার এবং সরকারের কারখানা খোলা রাখা সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনেই কারখানা খোলা রাখা হয়েছিল।
তিনি বলছেন, সরকারের নির্দেশনার বাইরে কিছু করা হয়নি।
সরকার কী বলছে?
এদিকে, পোশাক কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণের এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ওঠার পর, মালিক বা সরকার কেউই এককভাবে এর দায় নিচ্ছে না।
সরকার বলছে এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিক যে ঢাকা, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে বাইরে গেছে সে সম্পর্কে ধারণা করতে পারেননি তারা।
যে কারণে শনিবার বিভিন্ন সরকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের রিপোর্টের পরই আঁচ পাওয়া যায় যে বিপুল পরিমাণ মানুষ ফিরতে শুরু করেছে কর্মস্থলে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলছিলেন, ওই প্রেক্ষাপটে পোশাক কারখানা বন্ধের ব্যাপারে শনিবার সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।
“আমাদের কাছে রিপোর্ট ছিল যে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন শতাংশ শ্রমিক শহরের বাইরে চলে গেছে। কারণ সে রকমই নির্দেশনা দেয়া ছিল যে তারা যেন যেখানে আছে সেখানেই থাকে, মানে কর্মস্থলের কাছেই যেখানে তারা বাস করছে। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা ফোন পেতে শুরু করি।”
“আমাদের জানানো হয় মিছিলের মত শ্রমিকেরা আসছে, তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। তারা বলছে না পৌঁছালে তাদের চাকরি চলে যাবে, বা বেতন পাবে না। তখন আমাদের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
তবে মন্ত্রী সমন্বয়হীনতার অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করে বলেছেন, পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। একই সঙ্গে চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছে বহু শ্রমিক।
এদিকে, বাংলাদেশে সাধারণ ছুটির মেয়াদ ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ছে। এর মধ্যে আগে থেকেই ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ছিল।
প্রথম দফায় ২৬শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত দশদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশের সরকার।
এরপর ৩১শে মার্চ জানানো হয় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরো পাঁচদিন, অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত। আর ১০ ও ১১ই এপ্রিল শুক্র ও শনিবার হওয়ায় ১২ তারিখ থেকে কর্ম-দিবস শুরু হবার কথা ছিল।