বাংলাদেশে নৃশংস ছাত্রহত্যাঃ ১৫ বছর বয়সী ছেলের খোঁজে বাবা
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রায় প্রতিদিনই দেখা মিলে ঢাকার আদালতে আসামির স্বজনদের ভিড়। কেউ ছেলের জামিন করাতে, আবার কেউবা স্বামীর জামিন করাতে সিএমএম আদালতের সামনে আইনজীবীদের সঙ্গে নানা সলাপরামর্শ করেন। কিন্তু গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে ভিন্ন এক দৃশ্যপট দেখা যায়। এখনো ১৮ বছর হয়নি এমন স্কুলপড়ুয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে দেখা যায়। যখনই আদালতের সামনে বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশের প্রিজন ভ্যান আসে, ঠিক তখনই সিফাত সিফাত বলে চিৎকার করতে দেখা যায় একজনকে। কিছুক্ষণ পরে আরও একটি প্রিজন ভ্যান আসা মাত্রই আল-আমিন, আল- আমিন বলে চিৎকার করতে শুনা যায়। গতকাল এভাবে শিশু আপনের (১৭) মাকেও ডাক চিৎকার করতে দেখা যায়। আপনের মায়ের কান্না দেখে এগিয়ে আসেন তরুণ এক আইনজীবী। গারদ খানায় সন্তানের খোঁজ নিয়ে জানানোর আশ্বাস দিয়ে ঠিকানা নেন ওই আইনজীবী। এ সময় তার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।
ছেলের ৫ম শ্রেণির একটি প্রত্যয়নপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন গতকাল রাতে পুলিশ আমার ১৫ বছরের ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এসেছে। সকালে থানায় গেছিলাম, পুলিশ কোর্টে যাওয়ার জন্য বলছে। তাই ছেলের সন্ধানে কোর্টে এসেছি। আমি গরিব মানুষ। ছেলেটা স্কুলে পড়ে। পরিবার নিয়ে তেজগাঁও এলাকায় বসবাস করি। আমার ছেলে বাসা থেকে এই কয়দিন বেরই হয়নি। তারপরেও পুলিশ কি জন্য আমার ছেলেকে ধরে আনলো? কোনো অপরাধ না করেও আমার ছেলেকে আসামি করেছে। বিশ্বাস না করলে এই প্রত্যয়নপত্র দেখুন। প্রত্যয়নপত্রের উপরে দেখা যায়, পাগলারপুল আরবান স্লাম আনন্দ স্কুল। নাম: মো. সিফাত, পিতা: নাসির উদ্দিন হাওলাদার, মাতা: শিউলী আক্তার, জন্ম তারিখ ২৪শে ডিসেম্বর, ২০০৮। সে অনুযায়ী সিফাতের বয়স সাড়ে ১৫ বছর। তিনি বলেন, দয়া করে আপনারা আমার সন্তানের খোঁজ দিন। আমি আমার সন্তানকে এক নজর দেখতে চাই। এভাবেই বিলাপ করতে থাকেন সিফাতের বাবা।একটু অগ্রসর হতেই সিজিএম ভবনের কোণায় জন্মসনদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শিশু আল- আমিনের বাবা, দাদি ও বোনকে। জন্মসনদ অনুযায়ী ২০১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর আল-আমিনের জন্ম। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৩ বছর। স্বজনরা জানান, ঘুমাতে যাবো এমন সময় রাত ১০টার দিকে আল-আমিনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের বাসা কদমতলী থানার কদমতলী এলাকায়। টাকার অভাবে পড়াশোনা করাতে পারিনি ছেলেকে। ইলেকট্রিশিয়ান বানাতে মহল্লার এক দোকানে কাজে লাগিয়েছি। প্রতিদিন সকাল হলেই মহল্লার ওই দোকানে কাজে যায় আল-আমিন। কাজে না গেলে মালিক খাওয়া খরচ দেয় না। মহল্লা হওয়ার কারণে ভয়ে ভয়ে কাজে গেছে। সোমবার সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আল- আমিন বাসায় আসে। হঠাৎ বাসায় ৮/১০ জন পুলিশ আসে। কিছু না বলেই পুলিশ আমার নাতিকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আটকের কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলে তোমার নাতি আন্দোলন করছে? তাই ওকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। আল-আমিনের বাবা মো. আলী বলেন, আমার ছেলে পড়ালেখা করে না। ও আন্দোলন করবে ক্যান? কাজ করেই তো সময় পায় না। একদিন কাজ না করলে আমাগো পেটে ভাত জোটে না। নাতিকে এক নজর দেখার জন্য গারদ খানার দিকে ছুটছেন দাদি। কিন্তু সিএমএম আদালতের গেটের সামনে যেতেই বাধা দেয় পুলিশ। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পরেও যেতে পারেননি বৃদ্ধ দাদি।
শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. আশিকের মা মোর্শেদার কান্না যেন থামছেই না। গত রোববার রাত থেকে ছেলের দেখা না পেয়ে গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে বিলাপ করতে দেখা যায়। আইনজীবী দেখলেই ছেলেকে দেখার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করছেন তিনি। আশিকের মা মোর্শেদা বলেন, আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। প্যাকেজিংয়ের একটি কারখানায় কাজ করে। রাতে বাসায় যায় পুলিশ। কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলেন, আন্দোলনে ভাঙচুরের সঙ্গে নাকি আমার ছেলে জড়িত। কিন্তু আমার ছেলে ঠিকমতো হাঁটতেই পারে না। এক পা ভাঙা। মোর্শেদা তার ছেলের প্রতিবন্ধী আইডি দেখিয়ে বলেন, এই দেখেন আমার ছেলের প্রতিবন্ধী কার্ড। কার্ডে দেখা যায়, ছেলেটির নাম আশিক। জন্ম সাল ২০০৮। ১৬ বছর বয়স। প্রতিবন্ধীর ধরন হিসেবে উল্লেখ করা- শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। ঠিকানা- ৩৪৩, পূর্ব নাখালপাড়া, ওয়ার্ড ২৫, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
মোর্শেদা বেগম জানান, স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে তার সংসার। মানুষের বাসায় কাজ করে চলে তাদের সংসার। স্বামীও অসুস্থ। মাথায় সমস্যা। কখনো কাজ করে আবার কখনো করতে পারে না। আমি এখন এই প্রতিবন্ধী ছেলেকে কীভাবে জামিন করাবো। পুলিশকে কতো বললাম আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী কার্ডও দেখালাম। কিন্তু পুলিশ আমার কথা শুনলো না। আদালতেও তো যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। বিচারকের কাছে যেতে দিলে দেখাতে পারতাম, আমার ছেলের শারীরিক প্রতিবন্ধীর কার্ড। এখন কি করবো আমি?