বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে মানুষের ভয়
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ “সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি কিছু কথা বলতাম। আওয়াজ দিতাম। অন্যদের বলার চেষ্টা করতাম আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিৎ বা কী হবে। কিন্তু এখন আর মুক্তভাবে অনেক কথাই লিখি না। ইনফ্যাক্ট, এখন আমি কিছুই লিখি না।”
ঢাকার এক চাকুরিজীবী নারী এভাবেই বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। নিজের নাম-পরিচয় তিনি প্রকাশ করতে চান নি। ভয়টা শুধু তার একার নয়, তাকে নিয়ে চিন্তিত তার পরিবারও।
“পরিবার থেকে একটা চাপ আছে যে তোমার এত সোচ্চার হওয়ার দরকার নেই। আমার কর্মক্ষেত্র থেকেও চাপ আছে, তার বলছে যে, আপনি এগুলো লিখবেন না। তারা আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। যেহেতু এখন পরিস্থিতি একটু অন্যরকম, ফলে আমি আর নিরাপদ বোধ করি না।”
গত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে যেভাবে তরুণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক আলোকচিত্রীকে পর্যন্ত গ্রেফতার করে জেলে ভরা হয়েছে, তাতে করে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীরা। ফেসবুকে এখন তারা কী লিখছেন, কী শেয়ার করছেন তা নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক।
বলা হচ্ছে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় যেভাবে লোকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে করেই এই শংকা তৈরি হয়েছে। মূলত ফেসবুকে তারা যা বলেছেন বা করেছেন, তার জন্যই তাদের গ্রেফতারের শিকার হতে হয় বলে মনে করা হচ্ছে।
ফেসবুক ব্যবহারকারিদের অনেকে বলেছেন, তারা এখন কোনো পোস্ট বা লাইক দেয়াসহ সামাজিক মাধ্যমে বেশ সতর্ক থেকে কর্মকান্ড চালান।
ঐ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৫০টির বেশি মামলার মধ্যে আটটি মামলা হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি আইনে।নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং তার আগে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন-এই দু’টি আন্দোলনের সময়ই এর পক্ষে আন্দোলনকারীরা ফেসবুকে নিজেদের মতামত তুলে ধরতেন।
তাদের অনেকেই বলেছেন, এখন সামাজিক মাধ্যমে এ ধরণের কোনো বিষয় বা রাজনৈতিক কোনো ইস্যু দেখলেই এড়িয়ে যান।
তারা কোনো পোস্ট বা লাইক দেয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকছেন।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলাগুলোতে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট বা লাইক দিয়ে গুজব ছড়ানো বা উস্কানি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক মনে করেন, তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারার ভয় আগেই ছিল, এখন সেটি অনেক বেড়েছে।
“৫৭ ধারা সম্বলিত আইসিটি এ্যাক্ট যখন প্রযোজ্য হয়েছে, তখন থেকেই কিছু কিছু মাত্রায় ভয়ের ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পর পর দু’টি আন্দোলন কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় বিশেষত কয়েকজনের গ্রেফতার বা মামলার ক্ষেত্রে তাদের ফেসবুকের কর্মকান্ডকে সামনে আনা হয়েছে। তখন সাধারণ ব্যবহারকারিদের মধ্যে একটা ভয় তৈরি হয়েছে। এবং সাধারণ ব্যবহারকারিরা আরও বেশি সতর্ক হয়েছেন বলে আমার ধারণা।”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে।
তিনি মনে করেন, অনেকে এখনও সামাজিক মাধ্যমে অনেক ইস্যুতেই সক্রিয় থাকলেও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার পরিবর্তন হয়েছে।
“আগে অনেকে অনেক বিষয়ে সরাসরি বলতো। এখন তারা ইনডাইরেক্টলী বলার চেষ্টা করছে। ভাষাটার পরিবর্তন হয়েছে।”
তবে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, সামাজিক মাধ্যমে কোনো ভয়ের পরিবেশ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গুজব ছড়ানোর সাথে জড়িতদেরই শুধু চিহ্নিত করা হয়েছে।
“আমিতো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখি নাই। সেই সময় যারা গুজব রটিয়েছে,তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।তাদেরকেই পুলিশ আইনের আওতায় নিয়েছে। এর মধ্যে ভয়ের কিছু দেখি না।”
তিনি আরও বলেছেন, “ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম যেগুলো আছে, এগুলোকে আমি গুজব রটানোর প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে পারি না এবং সেভাবে ব্যবহার করা উচিত না।”