বিচারাধীন মামলায় আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
তুচ্ছ, রাজনৈতিক বা অনির্ভরযোগ্য অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের, যারা গ্রেপ্তার এড়াতে কখনও শক্তি প্রয়োগ করবেন না বা পলায়ন করবেন না এবং যাদের সামাজিক অবস্থান, সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে – এমন গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তিদেরও অহরহ ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করাতে মিডিয়ায় দেখা যায়।
সম্প্রতি পিতামাতা বা নিকটাত্মীয়দের জানাজায় অংশ নিতে কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করাতে দেখা গেছে।
ডান্ডাবেড়ি হচ্ছে বন্দি বা বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তির পায়ে মোটা লোহার রিং পরিয়ে তাতে শেকল এঁটে তা ওই বন্দির হাতে ধরিয়ে দেয়া। জেল কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেয়া সময় পর্যন্ত তাকে এটি পরে থাকতে হয়। ওঠা, বসা, হাঁটা-চলা, ঘুমানো সবই এ বেড়ি পরেই করতে হয় ওই বন্দির। এর ফলে বন্দি দু’পা একত্রে করতে পারে না। তাকে হাঁটতে হয় দু’পা ফাঁক করে, ঘুমাতে হয় চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে। ডান্ডাবেড়ি পরার কারণে অনেক আসামি বা কয়েদি আঘাতপ্রাপ্ত হন, শরীরের অনেক জায়গায় জখম ও ঘাঁ হয়ে যায়। কি নিস্টুর ও বর্বর নির্যাতন চলে আশরাফুল মখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) মানুষের দ্বারা মানুষের ওপর!
জেল কোডের উপর মূলত: ভিত্তি করে জেল হেফাজতে থাকা কাউকে ডান্ডাবেড়ি বা হাতকড়া পড়ানো হয়। এই বিধান গড়ে উঠেছে ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্ট, ১৯৮১ সালের প্রিজনার্স অ্যাক্ট এবং ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনের ভিত্তিতে। শেষেরটি “বেঙ্গল কোড” নামেই পরিচিত। জেলের ভেতর কেউ অপরাধ করলে তার নিষ্পত্তির নিয়ম রয়েছে জেল কোডের ১৯ নং অধ্যায়ে।
এ অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী জেল সুপারিনটেনডেন্ট কারাগারের অভ্যন্তরে অপরাধের জন্য ১১ ধরনের লঘু ও ১১ ধরনের গুরুতর শাস্তি বিধানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। গুরুতর শাস্তির মধ্যে রয়েছে সকল বন্দিদের থেকে আলাদা করে কাউকে ৭ দিনের জন্য কোনো সেলে আটক রাখা, ৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানো ইত্যাদি। তবে এসব শাস্তি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কিছু কিছু বিশেষ কয়েদিদের ক্ষেত্রে অতি বিরল পরিস্থিতিতে প্রয়োগের বিধান রয়েছে জেল কোডে।
বিচারাধীন মামলার আসামি বা রাজবন্দীদের এ ধরনের গুরুদণ্ড দেয়ার কোনো বিধান নেই। কারণ ১৯ নং অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধানটি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জেল কোড ও কারা আইনে ‘কারা অপরাধ’-এর বর্ণনার পাশাপাশি শাস্তি হিসেবে অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি ব্যবহারের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, কারাভ্যন্তরে কয়েদিরা সংশ্লিষ্ট ‘কারা অপরাধ’ করলে তার শাস্তি হিসেবে এর ব্যবহার করা যাবে। মূলত: ডান্ডাবেড়ির ব্যবহার কেবল জেল কোড ও কারা আইনের আওতাধীন। অথচ এই বিধানটি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ছাড়াও বিচারাধীন মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে যারা এখনও সাজাপ্রাপ্ত হন নাই।
বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ৩৩০-এ হাতকড়াসংক্রান্ত বিধান রয়েছে। সেখানে শুধু পলায়ন রোধ করতে যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপে নিষেধ করা হয়েছে। যদি কোনো শক্তিশালী বন্দি সহিংস অপরাধে অভিযুক্ত হয় বা কুখ্যাত হিসেবে পূর্বপরিচিত হয় বা অসুবিধা সৃষ্টিতে উন্মুখ থাকে বা রাস্তা দীর্ঘ হয় বা বন্দির সংখ্যা অনেক বেশি হয়, সেক্ষেত্রে হাতকড়া ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতকড়া না থাকলে দড়ি বা কাপড় ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এই প্রবিধানে আরও বলা হয়েছে যে হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অমর্যাদাকর। বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ, তাদের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি করা উচিত হবে না। এই প্রবিধানের কোথাও ডান্ডাবেড়ি ব্যবহারের কথা নেই।
জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ যেভাবে প্রায়ই তাদের খেয়ালখুশিমতো বিচারাধীন বন্দি এবং আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরাচ্ছেন তা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সরাসরি লংঘন। এমনটা করার কোনো আইনগত অধিকার বা এখতিয়ার তাদের নেই। তারা যুক্তি হয়ত দেখাবেন যে নিরাপত্তার কারণে এমনটি করা হচ্ছে। কিন্তু এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। আর সংবিধান লঙ্ঘিত কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিরাপত্তার ব্যাপারটি অন্যভাবে ও সভ্য (civilised) পন্থায় ডীল করা যেতে পারে। আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতিত কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না। ৩৫(৫)নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না। এছাড়া আইনসম্মত অধিকার ছাড়া কারো শারীরিক ক্ষতিসাধন সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।
Universal Declaration of Human Rights (UDHR) এবং International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) – এ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য ও signatory বাংলাদেশ। তাই এ দুটি সংস্থা ও ডকুমেন্টের অনুচ্ছেদগুলো মানতে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। UDHR-এর Article 5 এবং ICCPR-এর Article 7 – এ প্রায় অভিন্ন ভাষায় কাউকে নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর অবস্থায় ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। উভয় সংস্থা ও ডকুমেন্টের যথাক্রমে ৫ ও ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “No one shall be subjected to torture or to cruel, inhuman or degrading treatment or punishment” (অর্থাৎ কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেয়া যাবে না)। এই অধিকার হচ্ছে unlimited (সীমাহীন) ও unrestricted (অনিয়ন্ত্রিত) অধিকার। অর্থাৎ এই অধিকার যদি, কিন্তু বা অন্য কোন শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়।
বৃটেনে বিচারাধীন মামলায় আসামিদের বা আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত কয়েদিদের জন্য ডান্ডাবেড়ি ব্যবহারের প্রচলন মোটেই নেই, তাতে আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি যতই ভয়ংকর হোক না কেন। ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা দাগী ও বিপজ্জনক আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের বড়জোর হাতকড়া পরানো হয় বা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ, মনিটর, অনুসরণ ও ডিটেক্ট করা হয়। কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয় না।
মনে রাখা দরকার গ্রেপ্তার মানেই দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। মিথ্যা অজুহাতে, মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বা মিথ্যা সন্দেহে যে কেউ গ্রেপ্তার হতে পারেন। পরবর্তীতে বিচারে সম্পূর্ণ নির্দোষ বা বেকসুর খালাস পেয়ে তিনি বের হয়ে আসতে পারেন। তাই আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। নির্দোষীতার অনুমান (The presumption of innocence) একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি নীতি (legal principle) যা আবহমানকাল থেকে চলে আসছে যার উপর ভিত্তি করে ফৌজধারী বিচার ব্যবস্থা দাঁড়িয়েছে। আর এই প্রতিষ্ঠিত নীতির মূল কথা হচ্ছে “Every person accused of any crime is considered innocent until proven guilty in a competent court” (অর্থাৎ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্থ হবার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে)। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের বহু রায় ও পর্যবেক্ষণ আছে।
যেখানে আইনের শাশ্বত বিধান হচ্ছে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বলা যাবে না, সেখানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কোনো সম্মানীত বা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অথবা বিচারাধীন মামলায় আসামীদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে অযথা নাজেহাল ও সম্মানহানি করা কোনো মতেই ঠিক না। কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের আওতায় আনার মূল দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে পুলিশের। সেটা করতে গিয়ে কাউকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করার সচেতন বা অবচেতন চেষ্টা খোদ পুলিশের ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অথচ পুলিশের হওয়ার কথা দলমত নির্বিশেষে জনগণের বন্ধু।
বিচারাধীন মামলায় আসামিদের অথবা দোষী সাব্যস্ত কয়েদিদের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানো অত্যন্ত বর্বোরোচিত, অমানবিক ও মধ্যযুগীয় মেথড যা আধুনিক ও সভ্য সমাজে চলতে পারে না। বিচারাধীন মামলায় আসামিরা তো এখনও নিরপরাধ, কেননা তারা এখনও দোষী সাব্যস্ত হননি। এমতাবস্থায় তাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো সরাসরি সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সময় এসেছে এই বর্বর ও অমানবিক পদ্ধতির পরিবর্তনের। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আদি, সহজাত ও অসিম ক্ষমতা এবং জুরিসডিকশন আছে। হাইকোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। হাইকোর্ট চাইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে intervene (হস্তক্ষেপ) করে বা কারো আবেদনের প্রেক্ষিতে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যখ্যা করে চিরদিনের জন্য এই অমানবিক ও বর্বর নিয়ম ও শাস্তি বন্ধ করে দিতে পারেন।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
ই-মেইল: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk