বিদায় হাসিব ! কমরেড লাল সালাম
১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি । এক টগবগে যুবকের সাথে পরিচয়। নাম তার এম এ হাসিব। বাম রাজনীতি করে। সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। তার কথাবার্তায় মাধুর্যতা। আমার খুব ভালো লাগলো। তার সাথে শুরু হয় চলাফেরা। এক সময় এক নিবিড় ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সেই থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হঠাৎ হার্ট এটার্কে ১৭ ই জুন চলে গেলো হাসিব। কোন রকমে তা মেনে নিতে পারছিনা। কিন্তু কি করা যায়- একদিন সবাইকে হাসিবের পথই অনুসরণ করতে হবে। তাই মেনে নিতে হয়- এই নিষ্ঠুরতা।
হাসিবের স্বপ্ন ছিল সমাজ তন্ত্রের দুনিয়া। সমাজ ত্রান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন থেকেই ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজ পথে ছিল তার পদচারণা। সে এক নিষ্ঠ নিবেদিত বাম রাজনৈতিক সংঘঠক ছিল। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তার অংশগ্রহণ ছিল। সিলেটের রাজপথের এক অতি পরিচিত চেনা মুখ। তার রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বিচক্ষনতার কারণে ‘৯০ এর দশকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল।
১৯৯০ সালে যখন স্বৈরাচার সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, সামরিক সরকার বিরোধী কর্মসূচী পালনে একদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বাসদ) এর একদল কর্মী নিয়ে গণচাঁদা আদায়ের লক্ষে বের হয়েছিলাম। একসময় গিয়ে হাজির হলাম সিলেটের বন্দর বাজারস্থ ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির মধুবন শাখা কর্মকর্তার কার্যালয়ে। তিনি তখন অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একটু বসার জন্য অনুরোধ করলেন। আমরা বসলাম। তিনি অল্প সময়েই তাহার কাজ সেরে চেম্বারে আমাদের ডাকলেন। কুশলাদী জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন আমাদের আগমনের কারণ। খুলে বললাম সরকার বিরোধী কর্মসূচী পালনে আমাদের তহবিল প্রয়োজন। তাই তার অফিসে আসা। তিনি রশিদ বই চাইলেন। নিজ হাতে এক শত টাকার রশিদ কাটলেন। তবে তিনি নগদ টাকা দিলেন না। গ্রুপ লিডার হিসাবে আমাকে বললেন পরে এসে তার সাথে দেখা করতে। ঠিকই একদিনপর তার সাথে দেখা করলাম। তিনি একশত টাকার একটি নোট দিয়ে আমাকে বললেন, যেহেতু আপনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় তাই আপনার অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন। আপনি ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করুন। আপনি এতে উপকৃত হবেন। ততক্ষনে আমার বুঝতে বাকি রইল না ঐ কর্মকর্তা সেদিন নগদ টাকা না দিয়ে কেন পরবর্তীতে তাহার সাথে দেখা করতে আমাকে বলেছিলেন। আমি কিছুটা মৌন সম্মতি জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
সামরিক সরকার বিরোধী আন্দলন তুঙ্গে। ছাত্র রাজনীতিতে আমরা যারা খুব বেশী সক্রিয়, আমরা তখন খুবই ব্যস্ত। শ^াস নেওয়ার মতো সময় নেই। অবিরাম চলছে আমাদের সরকার বিরোধী কর্মকান্ড। তারই মধ্যে পুলিশ আমাদের হন্য হয়ে খুজছে। পুলিশের তালিকায় আমি দাগি আসামী। কারণ মদন মোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯৮৪ সালে সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ইতিহাসের খল নায়ক খুনি প্রেসিডেন্ট মোশতাকের যে জনসভা মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছিল পুলিশ বেষ্টনি ভেদ করে সেই জনসভা মঞ্চে অগ্নি সংযোগ করেছিলাম। উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের ছাত্রনেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক), জাতীয় ছাত্র লীগের মুস্তাক হোসেন (বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী) সহ আরো কয়েকজন। সবার নাম মনে পরছে না। দাউ দাউ করে জ¦লে গিয়েছিল জনসভা মঞ্চ। পুলিশ, গুয়েন্দা, সিলেটের সাধারন জনগণ সবাই হতবাক। একি কান্ড! কি করে তা সম্ভব হলো। ভেস্তে গিয়েছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট মোশতাকের জন সমাবেশের সকল প্রস্তুতি। তাই পুলিশ আমার উপর প্রচন্ড ক্ষ্যাপা। ধরতে পারলেই হাড় গুড় ভেঙ্গে দিত। এরপরও দলবল নিয়ে অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছি সরকার বিরোধী সব কর্মকান্ড। কিন্তু মজার ব্যপার হলো ঐ ইন্সুরেন্স কর্মকর্তা আমার পিছু ছাড়েননি। একদিন তারই আমন্ত্রনে তার অফিসে গিয়ে দেখলাম আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হাসিব বসে আছে। জানতে পারলাম হাসিবও ঐ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে পার্টটাইম কাজ করে। শেষ পর্যন্ত আমিও হাসিবের উৎসাহে ইন্সুরেন্সে কাজ করা শুরু করি। কিন্তু বেশীদিন আমি সেখানে টিকে থাকতে পারিনি। কারণ ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে পরবর্তীতে তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বাসদ) সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের এর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সেই সময়ের ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার সমর্থন ও অনুপ্রেরণা আমার ভরসা ছিল। ইন্সুরেন্সে যদিও আমি বেশিদিন ঠিকে থাকতে পারিনি কিন্তু ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি হাসিব তার ঐ পেশাকে ঠিকই ধরে রাখতে পেরেছিল। সে পরবর্তীতে ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স থেকে নিজকে গুটিয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স হয়ে সান লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে যোগদান করে। সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সান লাইফ ইন্সুরেন্সের সিলেট শাখার এসিসটেন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে কর্মকত ছিল। হাসিব ‘৯০ এর পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টিতে। সিলেট জেলা ইউনিটে তার গুরুত্ব ও অবদান ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি তার বিপ্লবি চরিত্র হারিয়ে নৈতিক ভাবে অধপতিত হয়ে ক্ষমতার মোহে সরকারের লেজুরবৃত্তি শুরু করলে কমরেড হাসিব সহ পার্টির অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী বিমর্ষ হতবাক হন। এতে পার্টি দিখন্ডিত হয়। লেজুরবৃত্তি ও ক্ষমতা কেন্দ্রিক হানাহানির অপরাজনীতিকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি (রাশেদ খান মেনন নেতৃত্বাধীন) ছেড়ে যোগ দেয় নতুন গঠিত বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টিতে (সাইফুল হক নেতৃত্বাধীন)। সেখানেও কমরেড হাসিব বেশীদিন নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক মতাদর্শাগত পার্থক্যের কারণে সেখান থেকে সে সরে পড়ে। কিছুদিন রাজনীতি বিমুখ হয়ে কাটায়। পরবর্তীতে রাশেদ খান মেনন নেতৃত্বধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির কয়েকজন শীর্ষ নেতা দল থেকে বেড়িয়ে বাংলাদেশ ইউনাটেড কমিনিষ্ট লীগ গঠন করলে কমরেড হাসিব তাতে যোগ দেয়। মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিল।
হাসিব এমন সময় চলে গেল যখন সারা দুনিয়ায় পুজি বাদের জয় জয়কার। পুজিবাদের শাসন- দাপট চরমে। বিশে^ ৮ জন পুজিপ্রতির কাছে ৩৬০ কোটি মানুষের সম্পদ জমা। সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে পুজির উন্মোত্ততা, মানুষের অসহায়ত্ব- বিপুল বৈষম্য। তারই প্রতিক্রিয়ায় খোদ মার্কিন মুল্লুকে চলছে ৯৯ ভাগ মানুষ বনাম ১ভাগ মানুষের লড়াই। যুক্ত রাষ্টে সাদা পুলিশ কর্তৃক কালো জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে সারা পৃথিবী উত্তাল। চলচে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। সাদা কালোর বৈষ্যম্যের লড়াই। এরই মধ্যে হাজির হয়েছে করোনা ভাইরাসের মতো অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি। সারাটা দুনিয়া স্তব্ধ করে দিয়েছে। মিসাইল, স্কার্ড, পরমানু বোমার মতো শক্তিশালী মরনাস্ত্র তার সম্মূখে ব্যর্থ। কোন কিছু কাজে আসছে না। থামাতে পারছেনা তার অপ্রতিরোধ্য গতি। হানা দিয়েছে রাজপ্রাসাদ থেকে বস্তির কুড়েঘর পর্যন্ত। গ্রাস করছে সর্বত্র। তার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কোন পেশার লোকজন। তার কাছে রাজা, বাদশা, ফকির, দরবেশ, শিক্ষক কর্মচারী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ধনকুব, সাধারণ সহ সবাই সমান। শিক্ষা দিচ্ছে সাম্য বাদের। সারা পুজিবাদি দুনিয়াটাকে উলট পালট করে দিচ্ছে। প্রাণে বাচাঁতে সব মানুষকে এক কাতারে দাড় করাতে চাচ্ছে।
হাসিব নেই রেখে গেছে স্মৃতি। হাসিবের স্বপ্ন অবশ্যই বিফলে যাবেনা। পৃথিবীতে পরিবর্তন আসবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে পুজিপতির লোভ, হিংসা, দাম্ভিকতা। উৎখাত হবে মানুষে মানুষে সামাজিক বৈষ্যম্য। হাসিব তোমাকে ভূলব না। বিদায় ! কমরেড লাল সালাম।
( লেখক: কমরেড তারেক আল মঈন,কলামিষ্ট ও রাজনৈতিক সংগঠক )