বিলেতের কমিউনিটি সংগঠনের হালচাল
আবু তাহের
বিদেশের মাটিতে স্বদেশীরা মিলে মিশে নিজেদের মত করে সমাজ গড়ে তুলেছে। নিজেদের কৃষ্টি আর সংস্কৃতি লালন করার জন্য প্রবাসীরা জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংগঠনের। এইসব সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য দেশ ও বিদেশের মাটিতে সমাজের কল্যাণ সাধন করা। সামাজিক অভাব অনটন দূর করা। তাই অনেক নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী দ্বারা সমাজ উপকৃত হয় ।
ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা যায়। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য সার্বজনীন হতে হয়। এরকম প্রতিযোগিতায় সবাই কমবেশি করা উচিত। এতে সংগঠনের মানুষকে দায়িত্বশীল করে তুলতে পারে। মানুষের অন্তর্দৃষ্টি কে প্রসারিত করতে পারে। নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করে। একে অপরকে মুল্য দিতে শেখায় । মানুষের বিপদে আপদে সহায়তা দেওয়ার মানসিকতা এনে দিতে পারে। ট্রাষ্ট অথবা সংগঠেনের কার্যক্রম দ্বারা মানুষের কাছে পৌঁছা যায়।
একটি সমাজকে উপরের দিকে টেনে তুলতে কতগুলো মানুষের চিন্তা, কর্ম আর সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সংগঠন দুরদর্শিতার অনুশীলনের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সমাজে ভালো কাজ করতে হলে দৃঢ় মনোবল, সৎ চিন্তা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে প্রাধান্য দিতে হয়। সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়। সামাজিক সংগঠনে শুধু নাম লিখিয়ে সমাজসেবী হওয়া যায় না। সমাজের কল্যাণে কাজ করার প্রেরণা থাকতে হয়।
সংগঠনের সকল কার্যকলাপে নিজ আগ্রহে সম্মুখ কাতারে থাকতে হয়। পেছনে থেকে শুধু সমালোচনা করলে সমাজ কর্ম হয় না । মানুষ সমাজ ছাড়া চলতে পারে না । একে অপরের উপর নির্ভর করতে হয়। সামাজিক সংগঠন সেই বন্ধনকে মজবুত করে । যখন সেখানে কোন দুর্বলতা দেখা দেয় তখন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মত প্রতিষ্ঠা করতে গেলে গণ্ডগোল বাঁধে। ‘ আমার কথা মানতে হবে’ এমনটি দলাদলি আর গ্রুপিংকে পোক্ত করে তোলে। এইজন্য সংগঠনে সম্মিলিত মত কে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরী।
বিলেতে স্বদেশীদের হাজারো সংগঠন রয়েছ । মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে দেশ, জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম, গোষ্ঠি এমন কি নিজের নামে কিংবা পরিবারিক বলয়ে ট্রাষ্ট ও চ্যারিটি গঠন অব্যাহত রয়েছে।এইসব সংগঠনের সঠিক পরিসংখ্যান বের করা মুশকিল।
ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে, সংগঠনগুলোর মধ্যে দলাদলি আর একে অপরকে দোষারূপ করা তীব্র আকার ধারণ করেছে। সামাজিক কল্যাণের পরিবর্তে নিজের ‘বড়ত্ব’ আর ‘আমিত্ব’ জাহির করতে ব্যস্ত।
ভাইরাসের মত বৃদ্ধি পাওয়া নাম সর্বস্ব সংগঠনের প্রতি মানুষের বিরক্তি বাড়ছে। অবিশ্বাস বেড়ে চলেছে। কিছু সংগঠনের মধ্যে দলাদলির পাশাপাশি গালাগালি আর মারামারির খবর প্রচার পাচ্ছে।লাজ শরম ভুলে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে। সংগঠনের টাকা আত্মসাতের খবর সাধারণ মানুষের কানে আসছে। এতো গ্রুপিং , মারামারি , মামলা মোকদ্দমা , জরিমানা নিয়ে যারা ব্যস্ত তারা কি আসলেই সমাজসেবী? না আত্মসাতকারী ? সমাজসেবার নামে কি চলছে তা সাধারণ মানুষ কিন্তু বোঝে।
কাগুজে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে পুঁজি করে (গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল) নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার প্রতিযোগিতা চলছে। মুখোশধারী সমাজকর্মী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের উৎপাত সমাজের জন্য সুখকর নয়। এদের না আছে শিক্ষা, না আছে সামাজিক মুল্যবোধ, না আছে লজ্জা শরম । এইসব দলাদলির অদৃশ্য হোতা আছে। তারা আড়ালে থেকে উসকে দেয়। মজা আর ফায়দা লুটে। আর তাদের চামচারা বুঝে না বুঝে লাফাচ্ছে । ফলে সংগঠনগুলোর আসল চেহারা মানুষের মাঝে ফুটে উঠছে। সংগঠন যেন টাকা কামাইয়ের হাঁড়ি, তাই এতো কাড়াকাড়ি।
আমি সামাজিক সংগঠন বিদ্বেষী নই বরং আমি একজন সংগঠন প্রিয় মানুষ।সামাজিক সংগঠন কখনো খারাপ হতে পারে না । ব্যক্তি বিশেষ যেমন সংগঠনকে চাঙা করে তোলে তেমনি ব্যক্তি বিশেষের স্বেচ্চাচারিতার কারণে সংগঠনের মহত কাজ ক্ষুণ্ন হয়।
বর্তমানে সংগঠনগুলোর মধ্যে যে কুৎসিত আচরণ দেখা যাচ্ছে তা কখনো শোভনীয় হতে পারে না।
পদ আর পদবি নিয়ে এতো কাড়াকাড়ি। চেয়ার বা পদ তার কাছে বড়। যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক ক্ষমতা চাই। একবার ক্ষমতা পেলে আর ছাড়তে রাজী না। কেউ মানুক আর নাই মানুক চেয়ার আমার । সংগঠনের পদ যেন টাকা বানানোর মেশিন। টাকা আয়ের ব্যবসা। যদি কোন কারণে পদ বা ক্ষমতা হারান তাহলে পরে আর সংগঠনের ধারে কাছে নাই। শুরু হবে সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা । সংগঠন আর সংগঠনের মানুষ নিয়ে ফেইসবুক, ওয়াটসআপ আর পত্রপত্রিকায় উল্টো পাল্টা বক্তব্য। পরবর্তীতে আরেকটি সংগঠনের জন্ম। একই সদস্যদের নাম অন্তত দশটা সংগঠন বা ট্রাস্টের মধ্যে পাবেন । কারো ইচ্ছা থাকুক আর নাই থাকুক জোর করে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সদস্য পদ এবং ইসি কমিটি অথবা উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানোর মানসিকতা খুব বেশি দেখা যায়। তাদের মধ্যে ক্ষমতার যাদু চাই।
আজকাল কাজের চেয়ে ঢোল বেশি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার বেশি। সামাজিক সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ ফটো সেশন নিয়ে ব্যস্ত। ফেইসবুক , হোয়াট্সঅ্যাপ এগুলোতে ফটো ভিডিও লোড করে সমাজসেবী হয়ে উঠেছেন। আবার পদের জন্য মারামারি কাড়াকাড়ি করেন, রক্তারক্তি করেন, গ্রুপিং করেন। সবকিছুর মূলে একটাই পরিলক্ষিত হয় – সে টা হলো নিজেকে জাহির করা। পদ পদবি ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ আদায়ের ধান্দা করা। তাতে সমাজ কি কিছু পায়? মোটেও না। তাদের ভাবসাব দেখলে মনে হবে তারা না থাকলে দেশ ও সমাজ বাঁচবে না।
অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমানে ধানের চেয়ে ছোঁচা বেশি। ধান যা আছে তার মধ্যে ইঁদুরের উপদ্রবও আছে। সেটা আমরা সবাই কমবেশি আন্দাজ করতে পারি। তাই আসুন, ‘ মানুষ মানুষের জন্য’ এই উপলব্ধিকে কাজে লাগাই। বাক্যটি শুধু আমাদের মুখের বুলি না হয়ে অন্তরের ধ্যান হোক।
দশে মিলে সততা আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে সকল অসাধ্য সাধন করা সম্ভব । আমাদের সাচ্চা পূর্বসূরিগণ যেভাবে মনপ্রাণ দিয়ে সমাজের ভাল করেছেন আমরাও তেমনটি করতে পারি । স্বরচিত অহঙ্কার দূর করে আমরা ‘সকলের তরে সকলে’ হতে পারি। আসুন, সকল ব্যক্তিবাচক আর নেতিবাচক মানসিকতা পরিহার করে ইতিবাচক আর সমষ্টিবাচক কাজ করি। তাতে দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে ।